শনিবার, 17 মে 2025
Logo
  • শনিবার, ১৭ মে ২০২৫

আয়নার মানুষটা

এই পাড়ায় বাড়ি কিনলে কিংশুক, আগে একটু খোঁজখবর নেবে তো?’ কিংশুক গৃহপ্রবেশের সারাদিনের ধকল সামলে সবে সোফাতে বসে আরাম করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছে তখনই ব্রজমোহন কথাটা ওর দিকে ছুড়ে দিলেন।

আয়নার মানুষটা

অর্পিতা সরকার: এই পাড়ায় বাড়ি কিনলে কিংশুক, আগে একটু খোঁজখবর নেবে তো?’ কিংশুক গৃহপ্রবেশের সারাদিনের ধকল সামলে সবে সোফাতে বসে আরাম করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছে তখনই ব্রজমোহন কথাটা ওর দিকে ছুড়ে দিলেন। কিংশুক জানে আত্মীয়রা যতই বাড়ির প্রশংসা করুক ওর শ্রদ্ধেয় শ্বশুরমশাই খুঁত ধরবেনই। জামাই হিসেবে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হতে ওর এমবিবিএস, এমএস করা হয়ে গেল। এমনকী একটা বছর দশেকের কন্যার পিতাও হয়ে গিয়েছে ডক্টর কিংশুক রায়। নেহাতই মেয়ে জেদ ধরেছিল বলে নিমরাজি হয়ে বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন ভদ্রলোক। কিংশুককে বাঁচাতেই ব্রজমোহনের একমাত্র সন্তান বৈশালী এগিয়ে এসে বলল, ‘বাবা তুমি ওকে কেন দোষ দিচ্ছ? বাড়িটা তো আমি পছন্দ করেছি। এটা আমার কলেজের সিনিয়র প্রফেসরের বাড়ি ছিল। উনি রিটায়ারমেন্টের পর ছেলের কাছে বিদেশে শিফট করে গেলেন, আমরা বাড়িটা কিনে রেনোভেট করে নিলাম। নীচের তলায় কিংশুকের চেম্বার থাকবে আর ওপরে আমরা থাকব। তোমাদের বাড়ি থেকেও তো গাড়িতে মাত্র কুড়ি মিনিট লাগবে।’ মেয়ের পছন্দ শুনে বাবা একটু বেসুরো গলায় বললেন, ‘শুনছিলাম নাকি এখানে কিছু উঠতি মস্তানের খুব প্রতিপত্তি। নতুন বাড়ি কিনলে মোটা টাকা ওদের দিতে হয়। না দিলে বেঁচে থাকা দায় হয়ে যায়।’ কথাটা নেহাত ভুল বলছেন না শ্বশুরমশাই। তবে এমন অভিজাত এলাকায় এত বড় বাড়ির লোভটা ছেড়ে দিতে পারেনি। তাছাড়া কিংশুক প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই ভদ্রলোক। তাই সচরাচর ওর সঙ্গে কারওর তেমন সমস্যা হয় না। তাছাড়া এই বাড়ি থেকে ওর নার্সিংহোমের দূরত্বও ঢিল ছোড়া। তাই এই পাড়া সম্পর্কে ফিসফাস শুনলেও সেটাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি ও। মোটামুটি সব আত্মীয়রাই একে একে বাড়ি চলে গিয়েছেন, শ্বশুরমশাই আর শাশুড়িমা আজ রাতটা থাকবেন মেয়েকে সাহায্য করার জন্য। চা শেষ করে উঠতেই বেল বাজল। কিংশুক দরজা খুলতেই অদ্ভুত পোশাকের তিনটে ছেলে লালচে দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘কী ডাক্তারবাবু, লোকজন ডেকে এত মাছ-মাংস খাওয়ালেন আর যারা আপনার দরকারে-অদরকারে থাকবে তাদেরই ডাকলেন না? বহুত না ইনসাফি হ্যায়। যাইহোক, আমরা এসব ধরে বসে থাকি না। নতুন বাড়ি কিনেছেন, আপনি এখন এই অভিজাত পাড়ার বাসিন্দা। তাই ট্যাক্স স্বরূপ আপনার বা বউদির সুরক্ষার জন্য কালকের মধ্যে লাখ পঞ্চাশেক পাঠিয়ে দেবেন।’ কিংশুক ঠোঁট খুলতেই একটি ছেলে বলল, ‘বেশ আপনি ডাক্তারমানুষ আপনাকে পাঠাতে হবে না। আমরাই বরং কাল ঠিক এই সময় এসে নিয়ে যাব। যদি খোকনের দল আসে বলে দেবেন বাদশার সঙ্গে সেটিং হয়ে গেছে। খোকনকে দেবেন মিষ্টি খাইয়ে।’
দরজাটা বন্ধ করে চুপচাপ কিংশুক নিজের ঘরে ঢুকে গেল। বৈশালী দুর্দান্ত করে সাজিয়েছে ওদের মাস্টার বেডরুমটা, চারদিকটা তাকিয়ে কিংশুক ভাবছিল আদৌ এই বাড়িতে ওরা বাস করতে পারবে তো? ও ঘরে ঢুকতেই বৈশালী বলল, ‘কে এসেছিল গো?’ কিংশুক একটু থমকে বলল, ‘ওই দু’জন পেশেন্ট, ভেবেছে আজ থেকেই চেম্বার শুরু করছি।’ বৈশালীর ঠোঁটে আত্মতৃপ্তির খুশি।
কিংশুক এদের কিছুতেই টাকা দেবে না। প্রয়োজনে পুলিসের সাহায্য নেবে। তাছাড়া এই সবে বাড়ি কিনেছে, নার্সিংহোমেও বেশ কিছু ইনভেস্টমেন্ট আছে ওর। এখন এতগুলো টাকা পাবেই বা কোথায়?
....
সকাল ন’টায় চেম্বারে গিয়ে বসতেই কিংশুক দেখল একটা চাপ দাড়িওয়ালা ছেলে এসে বসে পড়ল ওর সামনের চেয়ারে। কিংশুক নিজের প্যাড বের করে জিজ্ঞাসা করল, ‘নাম?’ ছেলেটা খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলল, ‘খোকন প্রামাণিক। কী ভেবেছিলেন, বাদশার সঙ্গে সেটিং করে আমার ভাগ ফাঁকি দেবেন? বাদশাকে এই লাইনে আনল কে?’ কিংশুক এতক্ষণে মুখটা তুলল। ওকে দেখেই খোকন আচমকাই একটা ড্রাইভ দিয়ে কিংশুকের পা ধরে বলল, ‘ডাক্তারবাবু আপনি এখানে?’ ঘটনার আকস্মিকতায় কিংশুক কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে বলল, ‘কী হচ্ছেটা কী এখানে?’ কিংশুককে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে খোকন বলল, ‘আপনি হয়তো আমায় চিনতে পারেননি কিন্তু আমি আপনাকে ভুলব কী করে? আমার ছেলেটা মরতে বসেছিল, হাসপাতালে রাতে নিয়ে ছুটেছিলাম, আপনিই তাকে বাঁচিয়েছিলেন।’ খোকন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘চিন্তা করবেন না ডাক্তারবাবু আমার ফোন নম্বরটা রাখুন। এই চত্বরে কেউ আপনার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।’ খোকন নিজের ফোন নম্বর দিয়ে চলে গেল।
রোগীর লাইন দেখেই বুঝতে পারল কিংশুক অনলাইন এবং অফলাইনে প্রচারটা নেহাত কম করেনি ওর দু’জন অ্যাসিস্ট্যান্ট। সবকিছুর মধ্যে একটা অদ্ভুত বিরক্তি যেন বারবার ঘুরে ফিরে ওর মনের দরজায় টোকা দিয়ে যাচ্ছিল। এই বাদশা আবার কখন আসবে কে জানে! নাকি খোকন ব্যবস্থা করে ফেলেছে ওকে। কালকের কথা অনুযায়ী চলে আসার কথা ছিল, এতক্ষণেও যখন এল না তখন একটু আশা করাই যায়। চেম্বার সেরে নার্সিংহোমে ঢুকবে। দুটো সার্জারি আছে আজ কিংশুকের। বাদশা বা খোকনের ঘটনা বৈশালীর কাছে কিছু বলেনি ও। এমনিতেই বৈশালীর কলেজে ছাত্র ইউনিয়ন নিয়ে বেশ ঝুটঝামেলা চলছে। তারপর আবার এসব বললে বেচারা ঘাবড়ে যাবে। এটা একাই সামলে নেবে কিংশুক। বাদশার মতো ছুরি না ধরলেও জীবনে ছুরি-কাঁচি কিংশুকও কিছু কম ধরেনি। এটুকু নার্ভের জোর ওর আছে। চেম্বার ছেড়ে সোজা ওপরে উঠে গেল কিংশুক। ওপরে গিয়েই দেখল, বৈশালী তৈরি হয়ে গিয়েছে কলেজের জন্য। কিংশুকও রেডি হয়ে নার্সিংহোমে ছুটল।
....
ওটির পরে রাউন্ডে ঘোরার সময়েই বৈশালী ফোন করল। সাধারণত ওরা দু’জনেই খুব প্রয়োজন না হলে কাজের জায়গায় ফোন করে না। ফোনটা রিসিভ করতেই বৈশালী উৎকণ্ঠা মেশানো গলায় বলল, ‘বাদশা কে কিংশুক? তুমি একে পঞ্চাশ লাখ টাকা দেবে বলে কমিট করেছ! এসব আমায় বলনি তো?’ কিংশুক তবুও শান্ত গলায় বলল, ‘বাদশাকে তুমি চিনলে কী করে?’ বৈশালী বলল, ‘তিনটে ছেলে আমার গাড়ি আটকে দাঁড়িয়ে আছে। বলছে, টাকা না দিলে নাকি আমায় বাড়ি ফিরতে দেবে না! কারা এরা?’ কিংশুকের মাথাটা এবারে গরম হচ্ছিল। নার্সিংহোম থেকে বেরিয়ে সোজা লোকাল থানায় গেল। বাদশার নামে ডায়রি লিখতে লিখতেই পুলিসটা হেসে বলল, ‘একটু কম-বেশি করে টাকাটা দিয়ে দিন না এদের। পরে দেখবেন এরাই ম্যাডামের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিচ্ছে। আমরা দু’দিন ধমকাব, তিনদিন পরে আবার এরা এলাকার দখল নেবে।’ কিংশুক রেগে গিয়েই বলল, ‘মানে! প্রশাসনের কোনও দায়িত্ব নেই সাধারণ মানুষকে প্রোটেক্ট করার তাই তো?’ পুলিসটা মুচকি হেসে বলল, ‘আমরা চেষ্টা করব স্যার।’
বৈশালীকে ওরা ছেড়ে দিয়েছে। সাজানো ড্রয়িংরুমের সোফায় বড্ড ম্রিয়মাণ লাগছে ওকে। সামনে মিতাদির করে দেওয়া চায়ের কাপে চুমুক না দিয়েই আকাশ পাতাল ভাবছে। কিংশুক পাশে গিয়ে বসতেই বিধ্বস্ত গলায় বলল, ‘এখন কী হবে? ওদের টাকাটা কোনওভাবে লোন করে দেওয়া সম্ভব?’ কিংশুক বিরক্ত হয়ে বলল, ‘টাকা? লোন? কেন দেব ওদের টাকা? আমি বাড়ি কিনেছি, ওদের কেন টাকা দেব? দেখ বৈশালী, আমি জীবনে কখনও অন্যায় কাজ করিনি। এসব অন্যায়কে প্রশ্রয় দেব না।’ বৈশালী উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল, ‘আমাদের জীবনটা এরা নরক করে দেবে।’ কিংশুক বলল, ‘আমি কোর্ট কেস করব ওর নামে।’ বৈশালী অন্যমনস্ক হয়ে বলল, ‘আমার ভয় করছে কিংশুক, এরা যদি তোমার কোনও ক্ষতি করে দেয়। মেয়েটা ফিরবে হস্টেল থেকে, যদি ওর কোনও ক্ষতি করে দেয়?’ অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় কাটল ডিনার টেবিলের মুহূর্তটুকু।

পরের দিন সকালে উঠেই কিংশুক বুঝতে পারছিল একটা নিতান্ত ছন্দহীন দিন শুরু হল। ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট অভিষেক চেম্বার খুলে বসে আছে। ব্রেকফাস্ট করে নেমেই কিংশুক দেখল বাইরে একজন রোগীও নেই। উল্টে বাদশার একটা ছেলে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লালচে দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল, ‘আজ থেকে আর চেম্বারে রোগী আসবে না ডাক্তারবাবু। আমরা সব রোগীকে বলে দিয়েছি, আপনি আর ডাক্তারি করবেন না। তাই আর কষ্ট করে কাল থেকে চেম্বার খুলতে হবে না। ওহ ডাক্তারবাবু আপনাকে কষ্ট করে নার্সিংহোমেও যেতে হবে না। আপনার আর যে তিনজন পার্টনার আছে তাদের আমরা রাজি করিয়ে ফেলেছি আপনার পার্টনারশিপের টাকাটা বাদশাদাকে দিয়ে দেবে। আপনি বাড়িতে রেস্ট করুন। এত টাকা দিয়ে নতুন বাড়ি কিনলেন, বিশ্রাম নিন।’ লোকটা হাসতে হাসতে চলে গেল। কিংশুক মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। অসহ্য রাগে মাথার দু’পাশটা দপদপ করছে। এভাবে হার স্বীকার করে নিতে হবে ভাবেনি কোনওদিন। নেহাতই মফস্‌স঩লের ছেলে ও। ওর মধ্যবিত্ত বাবা এতদিন ধরে শিখিয়েছিলেন, সৎ পথে সৎ ভাবে থাকলে নাকি কেউ ওর ক্ষতি করতে পারবে না। এখন বেশ বুঝতে পারছে সততার কোনও জায়গা নেই।
অভিষেক একবার বলার চেষ্টা করেছিল, টাকাটা দিয়ে দিলে যদি শান্তি পাওয়া যায়, তাহলে এবার চেষ্টা করা উচিত। কিন্তু স্যারের মুড দেখে আর সাহস করেনি পুরো বাক্যটা শেষ করার।
....
প্রায় দিন সাতেক একইরকমভাবে কাটছে কিংশুকের। কোনও ব্যস্ততা নেই। চেম্বার নেই, নার্সিংহোমে যাওয়ার তাড়া নেই। বৈশালী কাস্টমার দেখছে বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে অন্য কোথাও ফ্ল্যাটে চলে যাবে এই ভাবনায়। হঠাৎই কিংশুকের মধ্যে ঘুমন্ত রাগটা জেগে উঠল ব্যালকনিতে বসে সিগারেট খেতে খেতে। রাস্তায় তিনটে বাইক ভয়ঙ্কর আওয়াজ করে ওর বাড়ির ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে বিশ্রীভাবে হাসতে হাসতে চলে গেল। বাইক তিনটেই কিংশুকের চেনা। বাদশার দল গেল পাড়া কাঁপিয়ে। মাথার মধ্যে সব তালগোল পাকিয়ে গেল কিংশুকের। ওই ব্যঙ্গাত্মক হাসি, এই ব্যস্ততাহীন জীবন, এই ফাঁকা চেম্বার যেন ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। ফোনটা হাতে নিয়ে খোকনের নম্বরটা ডায়াল করেই বলল, ‘আমি ডাক্তারবাবু বলছি।’ খোকন একটা হিসহিসে আওয়াজ করে বলল, ‘জানি ডাক্তারবাবু ওই শালার বাচ্চা এখন বিশাল মস্তান হয়েছে। চারটে ছেলে নিয়ে গ্যাং চালাচ্ছে। আমি ওকে বলার পরেও ও কোনও কথা না শুনে আপনার ক্ষতি করেছে। ওকে আমি হাতে পাই তারপর দেখুন কী হয়?’ কিংশুক ভারী গলায় বলল, ‘আমি তোমায় দশ লাখ দেব খোকন, আজ রাতের মধ্যেই ওকে মার্ডার করতে হবে। দেখ পারবে?’ খোকন একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘কাজ হয়ে যাবে।’
বৈশালী আজ বাড়িতে নেই, বাপের বাড়ি গিয়েছে। কিংশুকেরও নিমন্ত্রণ ছিল, কিন্তু যেতে ইচ্ছে করেনি। আবারও সেই কথার পুনরাবৃত্তি হবে, আবার সেই চর্বিতচর্বন, তাই মাথার যন্ত্রণার দোহাই দিয়ে যায়নি সে। ঘনঘন ঘড়ি দেখছে কিংশুক। বাদশা কোন দিকে গিয়েছে সেটাও খবর দিয়ে দিয়েছে খোকনকে। দশ লাখের লোভও ধরিয়ে দিয়েছে। এবার শুধু জীবন থেকে বিষাক্ত কাঁটাটাকে উপড়ে ফেলার অপেক্ষা। খোকন নিজের জীবন বাজি রেখে এই কাজটা করবে কথা দিয়েছে।
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে প্রহর গুনছিল কিংশুক।
ঘনঘন ফোনটা চেক করছিল, কখন ফোনটা আসবে তার অপেক্ষা। হঠাৎই লক্ষ করল, ওর গেটের সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। আলো আঁধারিতে দেখা যাচ্ছে গোটা তিনেক ছেলে কাউকে একটা ধরে ধরে নামাচ্ছে। চমকে উঠল কিংশুক, সর্বনাশ খোকন কি বাদশাকে মেরে এখানে নিয়ে এসেছে নাকি প্রমাণ করার জন্য? এরপর তো পুলিস আসবে। কিংশুকের নির্দেশে খোকন ওকে গুলি করেছে এটাও হয়তো লোকজন জেনে যাবে। ভাবনার মধ্যে একটা আর্ত চিৎকার কানে এল, ‘ডাক্তারবাবু, ডাক্তারবাবু আমার বাবাকে বাঁচান।’ কিছুই বুঝতে না পেরে সিঁড়ি দিয়ে প্রায় ছুটে নামল কিংশুক। গেটটা খুলতেই চোখে পড়ল বাদশার দলের ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে। একটা বছর বারোর ছেলে কাঁদো কাঁদো গলায় বলছে, ‘ডাক্তারবাবু আমার বাবাকে বাঁচান। আমার মা নেই, বাবা মরে গেলে আমি অনাথ হয়ে যাব।’ বাদশা এখন কিংশুকের চেম্বারের বেডে শুয়ে আছে। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। সিপিআর দিতে হবে। এই লোকটাকে আর কিছুক্ষণ সিপিআর না দিয়ে ফেলে রাখলেই এমনিই মারা যাবে। কারওর কোনও দোষ হবে না। বাইরে থেকে ভেসে এল ছেলেটার কান্না ভেজা গলা। আর একমুহূর্তও দেরি করল না কিংশুক। চিকিৎসা শুরু করে দিল। প্রায় আধঘণ্টার চেষ্টায় এ যাত্রায় বেঁচে গেল বাদশা। বার তিনেক ফোন এসেছে খোকনের। শেষে ভয়েস মেসেজ এল। কানে হেডফোন লাগিয়ে অন করতেই খোকনের গলা, ‘ডাক্তারবাবু, বাদশা এমনিতেই বাঁচবে না। হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। তিনটে জায়গায় ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল কেউ দেখেনি। তাই আর গুলি করলাম না।’
বাদশা চোখ মেলতেই চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেল কিংশুক। বাইরে বেরিয়ে বলল, ‘আপাতত ঠিক আছে, তবে নিয়ে গিয়ে কোনও নার্সিংহোম বা হাসপাতালে ভর্তি করে দাও। অনেকগুলো টেস্ট করা হবে।’
সোজা ওপরে উঠে গেল কিংশুক। নিজের হাতে নিজের সব থেকে বড় শত্রুকে বাঁচিয়ে এল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে কিংশুক, আয়নায় এখনও একটা মানুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট।
...
বৈশালী কখন বাড়ি ফিরেছে জানে না কিংশুক। মিতাদি রাতে দরজা বন্ধ করে এসেছে। বেশ বেলায় ঘুম ভাঙল কিংশুকের, বৈশালীর ডাকে। শুনছ, অভিষেক এসেছে। বলছে চেম্বারে রোগী এসেছে। ওই বাদশার দলের লোকজন নাকি ভোর থেকে সবাইকে ডেকে ডেকে আনছে চেম্বারে। কী ব্যাপার বল তো? কিংশুক আরও একবার আয়নায় নিজেকে দেখল, হ্যাঁ এখনও ওকে মানুষের মতোই দেখতে লাগছে।