বুধবার, 25 জুন 2025
Logo
  • বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫

কীভাবে এল সাইকেল?

প্রয়োজনীয়তাই উদ্ভাবনের জন্মদাত্রী। আর প্রয়োজনের সামগ্রী তৈরি করতে যুগের পর যুগ ধরে কাজ করেছেন চণ্ডীদাসের খুড়োরা। সেই সময় তাঁদের নিয়ে কেউ কেউ উপহাসও করত।

কীভাবে এল সাইকেল?

স্বরূপ কুলভী
কল করেছেন আজব রকম চণ্ডীদাসের খুড়ো-
সবাই শুনে সাবাস্ বলে পাড়ার ছেলে বুড়ো।’
কেমন কল?
‘... খুড়ো আজ কল করেছেন আপন বুদ্ধি বলে,
পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা যাবে দেড় ঘণ্টায় চলে।’
সুকুমার রায়ের এই ‘খুড়োর কল’ ছড়া তো আমরা সবাই জানি। মজার হলেও একটা কথা কিন্তু সত্যি— ‘নেসেসিটি ইজ দ্য মাদার অব ইনভেনশন’। অর্থাৎ প্রয়োজনীয়তাই উদ্ভাবনের জন্মদাত্রী। আর প্রয়োজনের সামগ্রী তৈরি করতে যুগের পর যুগ ধরে কাজ করেছেন চণ্ডীদাসের খুড়োরা। সেই সময় তাঁদের নিয়ে কেউ কেউ উপহাসও করত। কিন্তু তাঁরা হয় নিজে এমন কিছু আবিষ্কার করেছেন, যা তাক লাগিয়ে দিয়েছে। নাহলে এমন কিছুর পথ দেখিয়ে গিয়েছেন, যা ভবিষ্যতে দুনিয়াটাই বদলে দিয়েছে। আজ আমরা আমাদের চারপাশে অনেক যন্ত্রপাতি, গাড়ি, বাইক কত কিছু দেখতে পাই। কিন্তু এগুলো কি হঠাৎ করে আবিষ্কার হয়েছে? না। বহু বছরের পরিশ্রম ও মেধার ফল এই সব আবিষ্কার। এই যেমন ধর, তোমরা তো সাইকেলে ঘুরে বেড়াও। দেখতে তো সহজ-সরল লাগে। কিন্তু আদতেই কি তাই? এই সাইকেলও আবিষ্কার হয়েছে অনেক অনেক বছরের চেষ্টার ফলে। প্রাচীনকালে তো যানবাহন বলতে তেমন কিছু ছিল না। কয়েক হাজার বছর ধরে ঘোড়া, উটের মতো প্রাণীর পিঠে সওয়ারি হয়ে মানুষ যাতায়াত করত। চাকার উপর পাটাতন বিছিয়ে গোরু, ঘোড়ার গাড়িও ব্যবহার করা হতো। সেসব বহু ঝক্কির ব্যাপার। তাই কয়েক শতাব্দী ধরেই নির্ঝঞ্ঝাট কোনও যান তৈরির চেষ্টা করছিলেন অনেকেই। আর এই প্রয়োজনীয়তার সূত্র ধরেই চলে আসে সাইকেল। এর জন্য সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছিল প্রাকৃতিক একটা দুর্যোগ। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। ১৮১৫ সাল। ইন্দোনেশিয়ার একটি আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে  আকাশ ছাইয়ে ঢেকে গিয়েছিল। এজন্য তাপমাত্রা নেমে যায়। ইউরোপেও এর প্রভাব পড়ে। ফলে চাষবাসের ব্যাপক ক্ষতি হয়। আবার খাবার না থাকায় তখন ঘোড়ার মতো প্রাণী পালন করাও কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক পশু মারাও যায়। ইউরোপে তখন ঘোড়ায় যাতায়াত চলত। কিন্তু ওই সঙ্কটের সময় ঘোড়ায় যাতায়াত প্রায় থমকে যায়।  এই সময় কার্ল ভন ড্রেইস নামে এক জার্মান ভদ্রলোকের প্রিয় ঘোড়াটি মারা যায়। ১৮১৭ সালে মাথা খাটিয়ে প্রথম দুই চাকার যান সাইকেল তৈরি করেন। এই সাইকেলের ওজন ছিল ২৩ কেজি। কাঠের তৈরি দু’টি চাকার সঙ্গে জোড়া ছিল একটা কাঠের কাঠামো। ওই কাঠামোর উপর থাকা আসনে বসে পা দিয়ে টেনে টেনে সাইকেলটি চালাতে হতো। সামনের চাকা ঘোরানোও যেত। ফলে প্রয়োজন মতো দিক বদলানো যেত।  তিনি তাঁর আবিষ্কার আরও উন্নত করেন। কিন্তু এই সাইকেল বেশিদিন চলেনি। ততদিনে ফসল উৎপাদন স্বাভাবিক হয়েছে। আর ওই সাইকেলে দুর্ঘটনাও ঘটত আকছার। ফলে ড্রেইসের এই ‘শখের ঘোড়া’ নামে পরিচিত সাইকেল নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল বেশ কিছু শহরের পুর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাঁর এই আবিষ্কার আরও উন্নতমানের দুই চাকার যান তৈরির পথ খুলে দেয়। ড্রেইসের সাইকেল জনপ্রিয়তা হারালেও এধরনের আরও সুবিধাজনক যান তৈরির চেষ্টা থামেনি। বিভিন্ন ধরনের অদ্ভুতদর্শন সহ দ্বিচক্র যানেরও দেখা মিলেছে। 
এরইমধ্যে চলে আসে গত উনিশ শতকের ছ’য়ের দশক। এবার চলে এল প্যাডেল যুক্ত সাইকেল। এই ধরনের সাইকেল কে আবিষ্কার করলেন, তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে এরসঙ্গে তিন ফরাসির নাম উল্লেখ না করলেই নয়। তাঁরা হলেন— পিয়েরে মিচাউ, পিয়েরো লাল্লেমেন্ট ও আর্নেস্ট মিচাউ। তাঁদের সাইকেলে ধাতব কাঠামো ব্যবহার করা হয়েছিল। এই সাইকেলে সামনের চাকার সঙ্গে যুক্ত ছিল প্যাডেল। ফলে এই যান চালানো অনেক সহজ হয়। গতিও বাড়ে। কিন্তু অনেকটাই উঁচু এই সাইকেল চালাতে বেশ কসরত করতে হতো। গায়ে বেশ জোর না থাকলে সাইকেল চালানো যেত না। আর তখন তো এমন রাস্তাঘাট ছিল না। এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় সাইকেল চালাতে গিয়ে হাড়গোড় কেঁপে যাওয়ার অবস্থা হতো। তাই ইউরোপে তা ‘বোন-শকার’ নামে পরিচিতি পায়। ১৮৬০ সালের পর এই সাইকেল তৈরি হয়েছিল। 
কিন্তু ‘চণ্ডীদাসের খুড়ো’রা তো আর বসে থাকার পাত্র নন। ১৮৭০ সাল নাগাদ চলে এস চেন-যুক্ত সাইকেল। পিছনের চাকার সঙ্গে চেন যুক্ত করে প্যাডেল। এটাই সাইকেলের যাত্রায় যেন বিপ্লব এনে দিল। আটের দশক অর্থাৎ ১৮৮০ সাল নাগাদ নিউম্যাটিক টায়ার মানে হাওয়া ভরা টায়ারের আবির্ভাব হয়। এমন সাইকেল চালানো অনেক নিরাপদ ও আরামদায়ক। এই নকশাই আধুনিক সাইকেলের অগ্রদূত হয়ে উঠল। ১৮৮৫ সাল নাগাদ জন কেম্প স্টার্লি নামে এক ব্রিটিশ প্রথম আধুনিক সাইকেল তৈরি করেন। পিছনের চাকার সঙ্গে যুক্ত চেন ও প্যাডেল ছিল তাঁর সাইকেলে। সেইসঙ্গে দু’টি চাকাও ছিল সমান। সাইকেলে বসার আসনও খুব উঁচু ছিল না। এজন্য এর নাম হয় সেফটি সাইকেল বা নিরাপদ সাইকেল।  পরে সারা বিশ্বেই এই সাইকেলের মডেলই ছড়িয়ে পড়ে।