শনিবার, 14 জুন 2025
Logo
  • শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫

শত্রুতা আর অক্ষম নকলনবিশি সম্বল

‘আজ সকালে প্রধানমন্ত্রী আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি চান, আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানের শান্তির বার্তা তুলে ধরতে। এই উপলক্ষ্যে পাকিস্তানের একটি প্রতিনিধি দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তিনি আমাকে অনুরোধ করেছেন।

শত্রুতা আর অক্ষম নকলনবিশি সম্বল

হারাধন চৌধুরী: ‘আজ সকালে প্রধানমন্ত্রী আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি চান, আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানের শান্তির বার্তা তুলে ধরতে। এই উপলক্ষ্যে পাকিস্তানের একটি প্রতিনিধি দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তিনি আমাকে অনুরোধ করেছেন। পাকিস্তানের সঙ্কটমুহূর্তে এই দায়িত্ব পালনসহ দেশের সেবায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে পেরে আমি সম্মানিত বোধ করছি।’ —১৮ মে এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করেন প্রাক্তন পাক বিদেশমন্ত্রী বিলাবল ভুট্টো।
মজার ব্যাপার হল, পশ্চিম দিকের পড়শি দেশের এই পদক্ষেপের ভিতরে নতুনত্ব কিছু নেই। কেননা, ভারতের তরফে বিশ্বব্যাপী প্রচার পদক্ষেপের একদিন পরই, তাদের পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে পাকিস্তান। পহেলগাঁও টার্গেট কিলিংয়ের জবাবে ভারত ‘উপহার’ দিয়েছিল ‘অপারেশন সিন্দুর’। ৭-১০ মে, ভারতের চারদিনের সামরিক অভিযানে ত্রাহি মধুসূদন রব উঠে গিয়েছিল পাকিস্তানের, সঙ্গে জঙ্গি-রাষ্ট্রের জিগরি দোস্তদেরও। এই চরম বেইজ্জতির পর পাকিস্তানের ‘শান্তির বার্তা’ বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জুনিয়র ভুট্টোকে।
শেষবার পাকিস্তান ভারতকে টুকেছে সামান্য ক’দিন আগেই। মোদিজির বায়ুসেনা ঘাঁটি পরিদর্শনের পরই পাক সেনাঘাঁটিতে হাজির হন শরিফ। ১৩ মে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পাঞ্জাবের আদমপুর বিমান ঘাঁটি পরিদর্শনে গিয়ে বায়ুসেনা জওয়ানদের পাশে দাঁড়ান, তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন এবং সাহস জোগান। পাকিস্তানের ভুয়ো দাবি ছিল যে, তারা ভারতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আদমপুর বায়ুসেনা ঘাঁটি ধ্বংস করে দিয়েছে। তাদের হরিহর আত্মা চীনের তৈরি জেএফ-১৭ ফাইটার বিমানের আঘাতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে আদমপুরে বসানো এস-৪০০ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম। রাশিয়ার তৈরি ওই ব্যবস্থাই শুধু বিকল হয়নি, তারা বিধ্বস্ত করে দিয়েছে ভারতের অনেকগুলি ফাইটার জেট এবং র‍্যাডার স্টেশন। এমনকী ভারতের ৬০ জন জওয়ানকেও হত্যা করেছে তারা।
একটি রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান কী ভয়ানক মিথ্যাবাদী, তার প্রমাণ ভারত দিয়েছিল আদমপুর এয়ারবেসে অক্ষত এস-৪০০ সিস্টেমের সামনে মোদিজির টাটকা ছবি পোস্ট করে। মোদিজি সেদিন দুপুরে এক্স-এ লেখেন, ‘আজ সকালে আমি এএফএস আদমপুর গিয়েছিলাম এবং সাহসী বীর সেনাদের সঙ্গে দেখা করেছি। যাঁরা সাহস, লক্ষ্য এবং ভয়শূন্যতার সমন্বয় ঘটিয়েছেন তাঁদের সঙ্গে মিলিত হতে পারাটা দারুণ অভিজ্ঞতা। সশস্ত্র সেনারা জাতির স্বার্থে যা করেন তার সবকিছুর জন্যই ভারত আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।’      
মোদিজির এই অনবদ্য ভূমিকার হুবহু নকল করতে দেখা গিয়েছে পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফকে। ১৪ মে শরিফ সিয়ালকোট সামরিক ঘাঁটি পরিদর্শন করেন এবং পাক সেনাদের উদ্দেশে ভাষণও দেন। মুখরক্ষার জন্য তিনি দাবি করেন যে, চারদিনের সংক্ষিপ্ত বিমান-যুদ্ধে পাকিস্তানেরই ‘জয়’ হয়েছে!
পাকিস্তানের টুকলি অবশ্য সিয়ালকোটই প্রথম কিংবা শেষ নয়, ‘অপারেশন সিন্দুর’-এর পাল্টা তারা ঘোষণা করেছিল ‘অপারেশন বুনিয়ান আল-মারসুস’। ‘বুনিয়ান আল-মারসুস’ হল একটি আরবি প্রবাদ, কোরান থেকে নেওয়া, যার অর্থ—‘একটি দৃঢ় এবং ঘনসংঘবদ্ধ কাঠামো’। সেনাদের মনোবল ফেরাতে প্রবাদটির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, ‘যারা 
সৎ উদ্দেশ্যে লড়াই করে আল্লাহ তাদের 
সত্যিই ভালোবাসেন।’ রাওয়ালপিন্ডির নুর খান, চাকওয়ালে মুরিদ এবং ঝংয়ে রফিকি বায়ুসেনা ঘাঁটি ভারত আক্রমণ করার পর, ১০ মে আসিম নুরের 
দেশ ‘অপারেশন বুনিয়ান আল-মারসুস’ 
ঘোষণা করেছিল।
এরপর সামনে এল পাকিস্তানের তরফেও 
বিশ্বে প্রতিনিধি দল প্রেরণের কাহিনি। স্বভাবতই 
ধরা পড়েছে ভারতীয় কৌশল চুরির প্রবণতা, যদিও তা অক্ষমের অনুকরণ বলেই নিন্দিত হচ্ছে দেশে বিদেশে সর্বত্র। 
গণতান্ত্রিক দুনিয়ার সমর্থন আদায়ে মোদি সরকার বিশ্বের নানা প্রান্তে মোট সাতটি প্রতিনিধি দল পাঠাচ্ছে। তাতে কারা থাকছেন? রাজনৈতিক নেতা, অভিজ্ঞ কূটনীতিক এবং সফল স্ট্র্যাটেজিক এক্সপার্টরা। সরাসরি পাক মদতপুষ্ট সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদ বিশ্বের সামনে তুলে ধরবেন তাঁরা। ওইসঙ্গে প্রদর্শিত হবে ভারতের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য এবং শান্তিকামী চরিত্র। তার প্রথম প্রমাণ হিসেবে প্রতিনিধি দলে থাকবেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি একাধিক ধর্ম, বর্ণ এবং আঞ্চলিক পটভূমি থেকে উঠে আসা ব্যক্তিত্বরা। ভারতের পবিত্র ভিত্তির একটি প্যানোর‌্যামিক শো সেখানে প্রকাশ পাবে। আধুনিক ভারত যাবতীয় বৈচিত্র্যের সহাবস্থান-সহ সবার বিকাশ ঘটাতে প্রয়াসী ও সক্ষম। সারা পৃথিবীর সামনে পরিষ্কার—পাকিস্তানের অবস্থান তাদের সূচনালগ্ন থেকেই এর সম্পূর্ণ বিপরীত। গত ২২ এপ্রিল পহেলগাঁও সন্ত্রাসী হামলার অব্যবহিত পূর্বে পাক সেনাপ্রধান আসিম মুনির সভ্যতা মানবতার সমস্ত সীমা অতিক্রম করেই কথাটি ফের খুঁচিয়ে দেন। তিনি জোর দেন পাকিস্তানের মূল মন্ত্র ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’-এর উপর এবং বস্তুত একজন নষ্ট রাজনীতিকের মতোই বলেন, ‘হিন্দু এবং মুসলিমরা একই নেশনের অংশ হতে পারে না!’ উপমহাদেশ বারবার রক্তাক্ত হয়েছে এই ঘৃণ্য তত্ত্বেই ভর করে। এটা ভালো মতো জানেন বলে, গত ২২ এপ্রিল তারই পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন মুনির স্বয়ং। এত কাণ্ডের পরেও ভারত তার বহুত্বের সাধনা, ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র কোনোদিন ত্যাগ করতে পারে না; এভাবেই বৃহত্তম গণতন্ত্র এবং সবচেয়ে গতিশীল অর্থনীতির দায়িত্ব ধারাবাহিকভাবে পালন করে যাবে। বিশ্বের সামনে ভারতের বার্তা এটাই। 
ভারতের নকলই যদি করতে হয় ভারতের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি এবং সন্ত্রাসবাদ বিরোধী পথগুলোই অনুসরণ করুক পাকিস্তান। বৈদেশিক ঋণের অর্থে সন্ত্রাসবাদীদের কোটি কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ এবং ভাতা প্রদানের রাস্তা অবিলম্বে ছাড়ুক তারা। তারা ভেবে দেখুক—পাকিস্তানে এক কেজি আটার দাম কত? ক’জন মেয়ে স্বাধীনভাবে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারে? শিক্ষার হার কেমন? স্কুলছুট কত? কত শিশুশ্রমিক? শিক্ষক ও ডাক্তার ঘাটতি কতটা? বেকারত্বের হার কত? শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি কতকাল বাড়েনি? নারী-পুরুষে মজুরির হারে তফাত কেমন? জনসংখ্যার কত শতাংশ ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত? সাধারণ নাগরিকের ব্যক্তিগত সঞ্চয় এবং ঋণের বোঝা কেমন? ব্যাঙ্কগুলি কি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী? গৃহহীন মানুষ কত? সারাবছরে কত খাদ্য প্রয়োজন এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কত? প্রয়োজনের তুলনায় রাস্তা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কতটা? বিদ্যুৎ এবং রান্নার গ্যাসের সুবিধাহীন পরিবার কত শতাংশ? কত ভাগ মানুষ পরিস্রুত পানীয় জল পায়? নারী এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় দেশের স্থান কোন উচ্চতায়? বিশ্ব ক্ষুধা এবং স্বচ্ছতায় কোন স্থান? শিশুমৃত্যুর হার কি কমছে? কত শতাংশ শিশু ও নারী অপুষ্টির শিকার? দেশে ওষুধ উৎপাদন এবং চিকিৎসা পরিষেবার কী হাল? বেকার ভাতা, ছাত্রবৃত্তি, মহিলাদের হাতে নগদের জোগানের চিত্র কেমন? সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলি কেমন চলছে? প্রাদেশিক এবং আঞ্চলিক বৈষম্য বাড়ছে না কি? বাণিজ্য ঘাটতির ছবিটা কেমন? বৈদেশিক ঋণবৃদ্ধির হার কি ভয়াবহ নয়? শিল্প এবং কৃষি কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি ক্ষেত্রে কতটা উন্নতি হয়েছে? যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণে দেশ কতটা স্বয়ম্ভর? শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতের বিপরীতে প্রতিরক্ষা বাজেট কী হারে বাড়ছে? 
যে ক্ষেত্রগুলির কথা বলা হল সেগুলির সবেতে যে ভারত ‘এক্সেল’ করেছে এমনটা অবশ্যই নয়। তবু, হলফ করেই বলা যায়, সমস্ত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান প্রতিটি প্রশ্নে ভারতের চেয়ে অনেক পিছনে পড়ে রয়েছে। এই আক্ষেপ, হতাশা পাকিস্তানের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকরাও গোপন করেন না। তাঁরা এও জানেন, সবেতে পিছিয়ে থেকে সবার আগে কেবল দেশের যুব শ্রেণি জেহাদে নাম লেখাবার বেলায়! এই সর্বনাশা খেলায় জিন্নার স্বপ্নের রাষ্ট্রই উৎসাহ জোগাচ্ছে। ভারত কখনও ঋণ নিয়ে যুদ্ধ করার কথা ভাবে না। ভারত কোনোভাবেই সেনাবাহিনীর দ্বারা কিংবা কোনও গোলমেলে বিদেশি শক্তির দ্বারা পরিচালিত নয়। পাকিস্তান জানে না, সে-দেশের আসল মাতব্বর কে? ‘নির্বাচিত’ সরকার নাকি সেনাবাহিনী নাকি নাটের গুরু গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই? ভারতের বিরুদ্ধে ‘হাজার বছরের লড়াই’ এবং তস্করের মতো ছায়াযুদ্ধ জারি রেখেছে পাকিস্তান। কিন্তু এই সিদ্ধান্তটা আসলে কে নেন—প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রেসিডেন্ট, নাকি পাক সেনাপ্রধান অথবা আইএসআই? ভারতের ক্ষেত্রে এমন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। ভারতের প্রতিটি রাজ্য এবং কেন্দ্র সবসময় পরিচালিত হয় নির্বাচিত সরকারের দ্বারা। নির্দিষ্ট সময় অন্তর এবং যথেষ্ট স্বচ্ছতার সঙ্গেই অনুষ্ঠিত হয় প্রতিটি নির্বাচন। তিন বাহিনীর সর্বাধিনায়ক রাষ্ট্রপতির অনুমতি নিয়েই ভারত সরকার যুদ্ধবিষয়ক যেকোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সরকারই প্রয়োজনে তিন বাহিনীকে ফ্রি হ্যান্ড দেয়। সর্বতোভাবে সেই সিদ্ধান্তের পাশে থাকে গোটা দেশ। এর মধ্যে কোনও ধোঁয়াশা নেই। 
উল্টো দিকে পাকিস্তান? পাকিস্তানে গণতন্ত্রের কোনও অবকাশ নেই, এবং তারই সুযোগে সে-দেশের সেনাবাহিনী বারবার রক্তের স্বাদ গ্রহণে লালায়িত থাকে। ভারত তার নাগরিকদের 
যাবতীয় চাহিদা পূরণের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু এখনও ঘাটতি রয়েছে বহু ক্ষেত্রে, তার পিছনে পাকিস্তানের নষ্টামি অনেকাংশেই দায়ী। ভারতের উন্নয়ন এবং শান্তির প্রক্রিয়া বহুলাংশে বাধাপ্রাপ্ত হয় পাকিস্তানের অসূয়ার দ্বারা। ভারতের ধ্বংস কামনাই তাদের রাষ্ট্রীয় স্বপ্ন। আর এই স্বপ্নপূরণের পথে অবিচল থেকেই পাকিস্তান বস্তুত নিজের ধ্বংসসাধনই নিশ্চিত করে ফেলছে।  
পাকিস্তান কি মনে রেখেছে, ১৯৪৭-এ ভারতের একদিন আগেই (১৪ আগস্ট) স্বাধীনতা পেয়েছিল তারা। কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি অর্জন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার প্রভৃতি সবেতেই ভারতের পাশে এক পিগমি রাষ্ট্রের নাম পাকিস্তান। যে অনাবশ্যক শত্রুতা বৃদ্ধি করে এবং অক্ষম নকলনবিশ, তার ভাগ্যে এর অধিক কীই-বা লিখতে পারেন ঈশ্বর!