ভারতে আগ্নেয়াস্ত্রের ইতিকথা
ঠিক ৫০০ বছর আগের কথা। মধ্য-এশিয়ার ফরগনা উপত্যকায় রাজনৈতিক অস্থিরতা তখন তুঙ্গে। যুদ্ধের তীব্রতা... পারস্পরিক অবিশ্বাস... ভয়াবহ শূন্যতার এক পরিবেশ।

বর্তমান ওয়েবডেস্ক
এপ্রিল ২২, ২০২৫
ডঃ বিদ্যুৎ পাতর
ঠিক ৫০০ বছর আগের কথা। মধ্য-এশিয়ার ফরগনা উপত্যকায় রাজনৈতিক অস্থিরতা তখন তুঙ্গে। যুদ্ধের তীব্রতা... পারস্পরিক অবিশ্বাস... ভয়াবহ শূন্যতার এক পরিবেশ। এক কিশোরের চোখের সামনেই পৈতৃক রাজ্য ধীরে ধীরে চলে গিয়েছিল শত্রুদের কবলে। যুদ্ধের ময়দানে ধারাবাহিক পরাজয় এবং স্বজন হারানোর যন্ত্রণায় তার হৃদয় ভারাক্রান্ত। মনে তখন এক অদ্ভুত দোলাচল। থেমে থাকার উপায় নেই, যাওয়ার তেমন পথও নেই। সে বিভোর হয়ে থাকে ছোটবেলায় ঠাকুমার মুখে শোনা গল্পে। এক স্বর্ণালী দেশের গল্প... যেখানে আমির খসরুর জাদুকরি ছোঁয়া আছে, গজলের সুরে মুগ্ধ হয় সবাই। সেখানকার রাজপ্রাসাদ, মণিমানিক্য, মিষ্টি ফলের বাগান ও অসীম সমৃদ্ধির ছবি কিশোর মনে গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছিল। সেই স্বপ্নরাজ্য—হিন্দুস্তান জয় করার স্বপ্ন তখন থেকেই তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ফরগনার রাজনীতিতে ব্যর্থ নায়ক তখন শুধু সিংহাসন নয়, বরং একটি নতুন দিগন্তের সন্ধান চায়- যেখানে পরিবার, আত্মীয় ও বন্ধুদের নিয়ে স্থায়ীভাবে থিতু হওয়া যাবে। ইতিমধ্যে এমন এক শক্তির সঙ্গে পরিচিত হল সে, যা হিন্দুস্তানের মাটিতে তখনও জনপ্রিয় হয়নি। সেই শক্তির নাম আগ্নেয়াস্ত্র (Firearms) আর কিশোরের নাম জালালউদ্দিন বাবর। ভারতে এসে তিনি বুঝলেন, আগ্নেয়াস্ত্রই হয়ে উঠবে তাঁর জিয়নকাঠি। যুদ্ধ কৌশল, আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার এবং নতুন নিয়ম প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা—সব মিলিয়ে তৈরি হবে এক বিরাট সাম্রাজ্যের ভিত্তি। তবে, সেই কাজ মোটেই সহজ নয়। উত্তর ভারতে তখন লোদি বংশের শাসন। সমগ্র উত্তর-পশ্চিম ভারতে একাধিক দুর্ধর্ষ শাসকের দাপট, সঙ্গে স্থানীয় উপজাতিদের উপদ্রব। সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে দিল্লি ‘বহুত দূর’!
আগ্রা-দিল্লি দখলের আগে অন্তত চারবার হিন্দুস্তান আক্রমণ করে বাবরের বাহিনী। এর মধ্যে বাজাউরের অভিজ্ঞতা তাঁর আত্মজীবনীতে চিত্রিত, ‘... সেদিন পাহাড়ের ঢালে সন্ধ্যা যেন আগেই নেমে এসেছে। মুঘল সৈন্যরা তখন তাঁবুতে বিশ্রামরত। এমন সময় কিছু স্থানীয় যুবক, মুঘলদের বিশাল বন্দুক দেখে বিদ্রুপের হাসিতে ফেটে পড়ে। সেই হাসি সৈন্যদের মধ্যে বিরক্তি ছড়িয়ে দেয়। একজন সৈন্য হঠাৎ বন্দুক তুলে গুলি ছোঁড়ে, আর সেই গুলির শব্দ আকাশে প্রতিধ্বনিত হয়। যুবকদের চোখে ভয়ের ছায়া নেমে আসে। রাতের নীরবতা ভেঙে বন্দুকের গর্জন বাজাউরের বাতাসে মিশে যায়। পুরো গ্রাম অজানা ভয়ে কাঁপতে শুরু করে।’ বাবর বুঝতে পারলেন, এই অঞ্চলের লোকজন কখনওই বন্দুকের ভয়াবহ শক্তি দেখেনি। এই উপলব্ধি ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের দিককে ইঙ্গিত করে।
অবশেষে বাবরের জীবনে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ—১৫২৬ সাল, পানিপথের প্রান্তর। দিল্লির সুলতানি সেনাবাহিনী নিজেদের অপ্রতিরোধ্য মনে করে এগিয়ে আসছে। চারপাশে অদ্ভুত এক নীরবতা, সময় থমকে গেছে। তারপর, কামানের প্রথম গর্জন—শত্রুপক্ষের চোখে আতঙ্কের ছোঁয়া। সবচেয়ে ঘাতক অস্ত্র ছিল গাদাবন্দুক ‘ফিরাঙ্গি’ এবং ‘জার্ব-জান’ নামের কামান। বাবরের প্রধান সামরিক প্রকৌশলী ছিলেন উস্তাদ আলি কুলি। পানিপথের যুদ্ধে তিনি এমন এক পরিকল্পনা করেছিলেন, যাতে মুঘল বন্দুকধারীরা শত্রুর তীর থেকে সুরক্ষিত থাকতে পারে। সামনে ছিল প্রায় সাতশো ঠেলাগাড়ির সারি। দু’টি করে ঠেলাগাড়ির মাঝে পাঁচ-ছ’টি ঢাল বসিয়ে বন্দুকধারীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়। মুঘল বন্দুকবাহিনী সেই আড়াল থেকে গুলি চালাতে লাগল। তাতেই ভেঙে গেল শত্রুদের মনোবল। বিজয়ী বাবর প্রতিষ্ঠা করলেন মুঘল সাম্রাজ্য।
সেই সাম্রাজ্যকে সমগ্র উপমহাদেশে প্রসারিত করেন সম্রাট আকবর। সাম্রাজ্য বিস্তারে তিনি সেনাবাহিনী ও আগ্নেয়াস্ত্রের উপর গুরুত্ব দিলেন। তখন মুঘল সামরিক প্রযুক্তি ও কাঠামোতে বড় পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। আকবর জানতেন, বন্দুকের কার্যকারিতা, নির্ভুল লক্ষ্য এবং দ্রুত গুলি চালানোর ক্ষমতা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাবরের আমলে যেসব বন্দুক ও কামান ছিল, সেগুলি অনেক বড়, ভারী ও বিপজ্জনক। একবার তো স্বয়ং আলি কুলি বন্দুকের নল ফেটে আহত হন। আফগান শাসক শেরশাহও অস্ত্র পরীক্ষা করতে গিয়ে মারা যান। এসব ঘটনার পর সেনার নিরাপত্তার দিকটি নিশ্চিত করার কথা ভাবলেন আকবর। নতুন ধরনের ছোট ও হাল্কা কামান তৈরির নির্দেশ দিলেন। নতুন কামানগুলিকে বলা হতো ‘তোপ বদলি’, যা ছিল বহনযোগ্য এবং খরচেও সাশ্রয়ী। আকবর আরও একটি নতুন কৌশল উদ্ভাবন করলেন। কামানকে হাতির পিঠে বসিয়ে তৈরি করা হল ‘গজনাল’। ফলে, শত্রুর উপর দ্রুত আক্রমণ চালানো সহজ হয়ে গেল। পরে তৈরি হল ‘শাতুরনাল’ নামে এক উন্নত অস্ত্র। সেটি উটের পিঠে স্থাপন করা যেত। গুলি চালাতে হলে অবস্থানও বদলাতে হতো না। রাজপুতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহু প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছিল মুঘলরা। সুদূর দিল্লি থেকে ভারী কামান আনা ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। আর রাজপুতদের দুর্গগুলি ছিল দুর্ভেদ্য। দুর্গের প্রাচীর ভাঙতে কামান দাগা ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না। আকবরও ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাই, দিল্লি থেকে ষাঁড় ও হাতির মাধ্যমে রাজপুতানায় কামান আনা হয়। ১৫৬৮ সালে, আকবর তার গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে চিতোর দখল করেন। পরের বছর রণথম্ভোর দুর্গ অবরোধ, যেখানে ব্যবহৃত হয় ‘গজনাল’ কামান । এসব কৌশল ও প্রযুক্তি প্রয়োগ করে রাজপুতদের শক্তি ভেঙে দিতে সক্ষম হন আকবর।
অন্যান্য দেশীয় রাজাও পিছিয়ে ছিলেন না। দক্ষিণ ভারতের বিজয়নগর সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় দেবরায়ের শাসনামলে বন্দুকের গর্জন শোনা গিয়েছিল। মুঘলরা এদেশে আসার অনেক আগেই, তুর্কি সেনাদের কাছ থেকে তারা বন্দুকের কৌশল আয়ত্ত করে। বিজয়নগরের বন্দুকের নাম ছিল ‘তুফাং’। বন্দুকবাহী সৈন্যদের বলা হতো ‘কোবিকার’। মধ্যযুগে কাশ্মীর এবং বাংলার রাজা- বাদশারা বন্দুক ব্যবহার করতেন। কাশ্মীরের সুলতান জয়ন-আল আবিদিন একধরনের গাদাবন্দুক ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়। পশমিনা শাল, কাগজ, চর্মজাত দ্রব্যের পাশাপাশি কাশ্মীর সুপ্রসিদ্ধ ছিল বন্দুক নির্মাণে। ধারালো তরবারিকে বন্দুকের নলের আকার দিতে পারদর্শী ছিলেন সেখানকার কারিগররা। বন্দুকের নলকে নানা কারুকর্যের মাধ্যমে সাজানো হতো। গুজরাতের শাসকদের সঙ্গে মিশর ও আরবের সম্রাটদের সম্পর্কের সুবাদে পশ্চিম ভারতীয়দের হাতে আসে আরবি কামান। আরব সাগরে জলদস্যুদের দমনের জন্য গুজরাতের সুলতান বন্দুক ও কামান ব্যবহার করতেন। ১৪৯৮ সালে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামাকে কালিকট বন্দরে স্বাগত জানাতে আকাশে গুলি ছোঁড়া হয়েছিল। বাংলায় দুর্গাষ্টমীর সময় জমিদার বাড়িতে যে কামান দাগা বা গুলি ছোঁড়ার রীতির সূচনাও মধ্যযুগের শেষের দিকে। ষোড়শ শতকে বিষ্ণুপুর রাজবাড়ির পুজোতে রাজা ধরী মল্লর শুরু করা সেই ঐতিহ্য আজও বজায় হয়েছে।
বন্যপ্রাণী শিকার ছিল মধ্যযুগে সাহস, দক্ষতা এবং সম্মানের প্রতীক। রাজা, সামন্ত ও অভিজাতদের কাছে একটি জনপ্রিয় বিনোদনের মাধ্যমও। মুঘল সাম্রাজ্যে শিকারের জন্য ‘তোরেদার’ নামক বন্দুকটি খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেটির নলে মহিষ, প্যান্থার প্রভৃতি খোদাই করা থাকত। সম্রাট আকবরের প্রিয় বন্দুক ছিল ‘সংগ্রাম’। তা দিয়ে ১,০১৯টি প্রাণী শিকার করেছিলেন। আবুল ফজল ‘আকবরনামা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘চিতোর দুর্গ দখলের সময় সংগ্রাম বন্দুকটি নিয়ে রাজপুতদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলেন আকবর। সেই বন্দুকের গর্জন রাজপুতদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে এবং শেষ পর্যন্ত রাজপুত বীর জয়মল পরাজয় স্বীকার করেন।’ বেগম নূরজাহান বন্দুকচালনায় অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। কিংবদন্তি শোনা যায়, একবার জাহাঙ্গীরের সঙ্গে শিকারে গিয়ে মাত্র ছ’টি গুলিতে তিনি চারটি বাঘ মেরেছিলেন। বন্দুক হাতে নূরজাহানের চিত্র আঁকার জন্য শিল্পীদের ভিড় জমতে শুরু করে মুঘল দরবারে।
মুঘল দরবারে চিত্রকরদের নিয়মিত আহ্বান জানানো হতো, একনলা এবং দু’নলা বন্দুক হাতে প্রতিকৃতি আঁকার জন্য। মুঘল আমলের মিনিয়েচার চিত্রগুলিতে দেখা যায়, এই সময়ে প্রধানত দুই ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ছিল—হাল্কা গাদাবন্দুক বা মাস্কেট আর ভারী তোপ বা কামান। বাদশারা বন্দুক বা কামানের বিশেষ বিশেষ নাম দিতেন। বন্দুকের মুখগুলি প্রায়ই পদ্মফুল বা সিংহের মুখের আকৃতিতে তৈরি করা হতো। কামানের গায়ে থাকত নানারকম ফুল, লতাপাতা বা ধর্মীয় বাণী। আর যুবরাজদের জন্য বাঘ-মার্কা বন্দুকের (tiger-mark gun) হাতল। দুর্ভাগ্যের কথা, এই সুন্দর বন্দুকগুলির বেশিরভাগ এখন বিদেশের বিভিন্ন মিউজিয়ামে।
ভারতবর্ষে আগ্নেয়াস্ত্রের ইতিহাস পঞ্চদশ শতক থেকে শুরু হলেও, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে মুঘলদের হাত ধরে তার প্রসার। দেশীয় রাজাদের তখন হয় মুঘল, নয় বিদেশিদের থেকে বন্দুক কিনতে হতো। তবে অষ্টাদশ শতকের দিকে এসে মুঘলদের সেই একাধিপত্য আর থাকেনি। মহীশূর, মারাঠা, অযোধ্যা, বাংলার নবাবরাও সেকাজে পারদর্শী হয়ে ওঠে। মুঘল বন্দুকের জনপ্রিয়তা তলানিতে পৌঁছয়। ভারত ইউরোপীয় আধুনিক মডেলের বন্দুকের বড় বাজার হয়ে ওঠে। গ্রামীণ জমিদারদের পাইক-বরকন্দাজের হাতেও তা আসতে শুরু করে। স্থানীয় কর্মকাররা বিদেশি মডেল নকল করে সস্তায় গাদাবন্দুক বানিয়ে দিত। কৃষক-উপজাতির বিদ্রোহগুলিতে তীর-ধনুকের সঙ্গে সেগুলিরও ব্যবহার শুরু হয়। পরিস্থিতি কতকটা, ‘রাজার কাছে যে ধন আছে, আমার কাছেও সেই ধন আছে।’ মুঘল শাসনের সূর্য অস্তমিত হতে থাকে। বিশ্বস্ত মিত্র রাজারা স্বাধীন হতে শুরু করে। কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের অভাবে দেশীয় রাজাদের মধ্যে সন্দেহ আর অবিশ্বাস বাসা বাঁধে। পারস্পরিক হিংসা আর রেষারেষি যেন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সেই দুর্বলতার আগুনে আরও ঘি ঢালে ইংরেজরা। পরস্পরের শত্রুতায় ছিন্নভিন্ন রাজারা শক্তি হারাতে থাকে। ফলে, ভারতের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রটিতে ইংরেজদের পূর্ণ আধিপত্য স্থাপিত হয়।
রাশিফল
-
আজকের রাশিফল (১৬/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 16, 2025
-
আজকের রাশিফল (১৭/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 17, 2025
এখনকার দর
-
নিফটি ব্যাঙ্ক (১৬/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 16, 2025
-
নিফটি ৫০ (১৬/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 16, 2025
-
ইউরো (১৬/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 16, 2025
-
পাউন্ড (১৬/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 16, 2025
-
ডলার (১৬/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 16, 2025
-
রূপোর দাম (১৭/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 17, 2025
-
সোনার দাম (১৭/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 17, 2025
-
সোনার দাম (১৬/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 16, 2025
-
রুপোর দাম (১৬/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 16, 2025
-
ডলার (১৭/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 17, 2025
-
পাউন্ড (১৭/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 17, 2025
-
ইউরো (১৭/০৫/২৫)
- post_by Admin
- মে 17, 2025