শনিবার, 14 জুন 2025
Logo
  • শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫

‘ড্যামেজ কন্ট্রোলে’র কৌশল

পহেলগাঁওয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ ভারতের ছবি দেখেছে গোটা বিশ্ব। সেসময়ে মোদি সরকারের ‘পাশে থাকার’ বার্তা দিয়েছিল দেশের সব বিরোধী দল। 

‘ড্যামেজ কন্ট্রোলে’র কৌশল

পহেলগাঁওয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ ভারতের ছবি দেখেছে গোটা বিশ্ব। সেসময়ে মোদি সরকারের ‘পাশে থাকার’ বার্তা দিয়েছিল দেশের সব বিরোধী দল। সেই ঐক্যে এখন কি ফাটল চওড়া হচ্ছে? কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বদলীয় কূটনৈতিক দৌত্যে প্রতিনিধি নির্বাচন করা নিয়ে সরকার ও বিরোধীপক্ষের মধ্যে বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছে। সৌজন্যে: মোদি সরকারের ‘দাদাগিরি’। কার্যত বিরোধী দলের সঙ্গে সেভাবে পরামর্শ না করে তাদের মতামতকে চরম তাচ্ছিল্যে উপেক্ষা করে একটা সহজ-স্বাভাবিক বিষয়কে অহেতুক জটিল করে তুলেছে মোদি সরকার। ফলে বিশ্বের ৩৩টি দেশে সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের কঠোর অবস্থানের বার্তা তুলে ধরতে যে কৌশলী পরিকল্পনা করেছেন নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরা— তা কতটা সফল ও কার্যকর হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে। কারণ, শেষ পর্যন্ত যদি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী দল তাদের প্রতিনিধি প্রত্যাহার করে নেয় তাহলে যে এই দৌত্যের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে, তা বলাই বাহুল্য। 
পহেলগাঁওয়ের হাড়হিম করা ঘটনার পর সন্ত্রাসবাদী ও তাদের আঁতুড়ঘর গুঁড়িয়ে দিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কার্যত ‘যুদ্ধ’ (সংঘর্ষ) ঘোষণা করেছিল ভারত। দু’ দুটি সর্বদলীয় বৈঠক থেকে সরকারের সেই ঘোষণায় সিলমোহর দিয়েছিল বিরোধী সব দল। গোটা দেশ দেখেছিল, একদিকে ভারতীয় সেনা কীভাবে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আকাশপথে হামলা চালিয়ে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। অন্যদিকে, সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত, বাণিজ্য বন্ধের মতো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে কূটনৈতিক পথেও সন্ত্রাসবাদের মদতদাতা পড়শি রাষ্ট্রকে ‘ভাতে মারার’ কঠোর বার্তা দিয়েছে আমাদের দেশ। পরিকল্পনামাফিক টানা চারদিন যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন হামলার পর সংঘর্ষ বিরতির ঘোষণা হলেও কূটনৈতিক পথে লড়াই জারি রেখেছে ভারত। তারই অঙ্গ হিসেবে গোটা বিশ্বের কাছে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ ভারতের বার্তা দিতে সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মোদি সরকার। সাদা চোখে এতে কোনও অস্বাভাবিকত্ব নেই। বিশেষত, বিশ্বের দুই প্রবল শক্তিধর দেশ আমেরিকা ও চীন খাতায়-কলমে ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে’ বললেও যেভাবে চোরাগোপ্তা পথে পাকিস্তানের হয়ে ‘ব্যাট’ করে চলেছে, তাতে ভারতের বক্তব্য তুলে ধরতে এই প্রতিনিধিদল পাঠানোর পদক্ষেপে কোনও ভুল নেই। কেন্দ্র ঠিক করেছে, সাতটি সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল বিভিন্ন দেশে যাবে। কিন্তু এই দলগুলির প্রতিনিধি নির্বাচন করা নিয়েই সরকার ও বিরোধীপক্ষের মধ্যে বিতর্ক বেঁধেছে। কারণ, প্রতিনিধিদলগুলির নেতা ও সদস্যদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে কেন্দ্র, তা একতরফাভাবে ঠিক করেছে মোদিবাহিনী। যা একেবারে স্বেচ্ছাচারী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। চাপিয়ে দেওয়ার বিজেপি রাজনীতি। এখানেই কংগ্রেস, তৃণমূল, সমাজবাদী পার্টি, উদ্ধবপন্থী শিবসেনা সহ বিরোধীদের বক্তব্য, তাদের নেতৃত্বের সঙ্গে কোনওরকম আলোচনা ছাড়াই প্রতিনিধি ঠিক করেছে মোদি সরকার। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলে বলেছেন, প্রতিনিধি দলে নিজেরাই যখন নাম ঠিক করবে তাহলে আমাদের থেকে নাম চাওয়া হল কেন? এমনকী কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী যে চার জনের নাম পাঠিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে তিনজনকে কোনও দলেই রাখা হয়নি। শাসকগোষ্ঠীর এই ‘দাদাগিরি’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে তৃণমূল তাদের একমাত্র প্রতিনিধির নাম ফিরিয়ে নিয়েছে। কারণ প্রতিনিধির নাম তৃণমূল থেকে না চেয়ে কেন্দ্র নিজেই প্রতিনিধির নাম ঠিক করেছে। আরও কোনও কোনও দল তৃণমূলের মতোই ভাবনাচিন্তা করছে। যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, কেন্দ্র আমাদের কাছে প্রতিনিধির নাম চাইলে আমরা তা পাঠাতাম। দেশের স্বার্থে আমরা কেন্দ্রের পাশে আছি। অভিযোগ উঠেছে, রাজনীতির অঙ্ক মেনে অনেক ছোট সংসদীয় দলের এমপিদেরও প্রতিনিধি করা হয়েছে। 
একথা ঠিক যে, সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল পাঠানো নিয়ে সরাসরি কেউ বিরোধিতা করেনি। কিন্তু এই তাড়াহুড়ো আসলে মোদির ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’-এর চেষ্টা বলে বিরোধীরা মনে করছে। ভারত-পাক সংঘর্ষ বিরতি ঘোষণার আগে-পরের ঘটনা পরম্পরা বলছে, এই সংঘর্ষ বিরতির কথা প্রথম ঘোষণা করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বলেছিলেন, দু’ দেশকে বাণিজ্যের টোপ দিয়ে তিনি সংঘর্ষ বিরতিতে রাজি করিয়েছেন। হুমকি দিয়েছিলেন, সংঘর্ষ বিরতি না করলে বাণিজ্য বন্ধ করে দেবেন। এও বলেছিলেন, তিনি দুই রাষ্ট্রপ্রধানকে নৈশভোজ দিতে আগ্রহী। আগ্রহী কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের মধ্যস্থতা করতেও। ট্রাম্পের অঙ্গুলিহেলনেই পাকিস্তান আইএমএফ থেকে ঋণ পাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। উপরন্তু পহেলগাঁওয়ের হত্যাকারীদের এখনও ধরতে না পারায় জনমানসে যথেষ্ট উষ্মা তৈরি হয়েছে। ফলে ঘরে-বাইরের এই প্রবল চাপ থেকে দৃষ্টি ফেরাতেই তড়িঘড়ি সর্বদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মোদি সরকার, মনে করছেন অনেকেই। কিন্তু তা কতটা সফল হবে সেটাই দেখার। দুর্ভাগ্যের যে, প্রতিনিধিদল ঠিক করার ক্ষেত্রেও পদ্মশিবির রাজনীতি করা থেকে বিরত থাকল না!