শনিবার, 17 মে 2025
Logo
  • শনিবার, ১৭ মে ২০২৫

হাতে পাঁজি মঙ্গলবার

সাতটি বার, ১৫টি করে শুক্ল ও কৃষ্ণপক্ষের তিথি, ২৭টি নক্ষত্র, ২৭টি যোগ ও ১১টি করণ—মোট পাঁচটি অঙ্গের মেলবন্ধন একই মলাটে। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে তাই এর পরিচয় ‘পঞ্চাঙ্গ’।

হাতে পাঁজি মঙ্গলবার

কিঞ্জল রায়: সাতটি বার, ১৫টি করে শুক্ল ও কৃষ্ণপক্ষের তিথি, ২৭টি নক্ষত্র, ২৭টি যোগ ও ১১টি করণ—মোট পাঁচটি অঙ্গের মেলবন্ধন একই মলাটে। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে তাই এর পরিচয় ‘পঞ্চাঙ্গ’। সেটিই বঙ্গজীবনে চৈত্রশেষে বর্ষবরণের অপরিহার্য অঙ্গ—পঞ্জিকা। ডাকনাম পাঁজি। সৃষ্টিকাল থেকেই বাঙালির নিজস্ব গাইডবুক। বছরে পর বছর ধরে বেস্টসেলার। যা না থাকলে তিথি নক্ষত্রের বিচার, পূর্ণিমা-অমাবস্যা, একাদশী, জোয়ার-ভাটা, বিয়ে-গৃহপ্রবেশ-অন্নপ্রাশনের লগ্ন জানা যেত কোথা থেকে! কোবরেজি ওষুধ থেকে বেনারসি, গন্ধতেল থেকে বন্দুক, সব কিছুর মুশকিল আসান বাড়ির এককোণে পড়ে থাকা এই সামান্য বইটি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যার মলাট একইরকম, অদ্ভুত গোলাপি রঙের। আর সবথেকে আশ্চর্য বিষয় হল, পাঁজি দেখা। হ্যাঁ, দু’মলাটের এই বই কেউ পড়ে না, শুধু দেখে।
পয়লা বৈশাখের আগে পরিবার-পরিজন এবং ঘনিষ্ঠ সকলে তো বটেই, ঠাকুরঘরে গোপালও পায় নতুন জামা। সঙ্গে মিষ্টি-ধুতি। এসবের পাশাপাশি ধনী-গরিব নির্বিশেষে বাঙালি পরিবারে যে নতুন অতিথির আগমন এক্কেবারে পাকা, সেটি পঞ্জিকা। পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক সদস্যটির একান্ত সঙ্গী। বছর বছর যা বদলে গিয়েও কখনও পুরনো হয় না। 
সুদূর অতীতে কোনও এক দিন আমাদের পূর্বপুরুষরা উপলব্ধি করেছিলেন সময় গণনার গাণিতিক কৌশল। সেই থেকে যা চলে আসছে। মায়া সভ্যতা যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। সুপ্রাচীন ভারতে মুনিঋষিরা শুরু করেছিলেন ঋতুভিত্তিক বছর গণনা। ঋগ্‌঩বেদে যেমন দ্বাদশ মাসের উল্লেখ মেলে। সেগুলি হল,  মধু (ফাল্গুন), মাধব (চৈত্র), শুক্র (বৈশাখ), শুচি (জ্যৈষ্ঠ), নভঃ (আষাঢ়), নভস্য (শ্রাবণ), ঈষ (ভাদ্র), ঊর্জ (আশ্বিন), তপঃ (কার্তিক), তপস্য (অগ্রহায়ণ), সহস (পৌষ), সহস্য (মাঘ)। যজুর্বেদের সময়, ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সূর্যের উত্তর ও দক্ষিণ গতি অনুযায়ী প্রতিটি বছরকে উত্তরায়ণ এবং দক্ষিণায়ন হিসেবে ভাগ করা হয়েছিল। তপঃ থেকে শুচি পর্যন্ত উত্তরায়ণ এবং নভঃ থেকে সহস্য পর্যন্ত দক্ষিণায়ন। গণনায় মূলত তিনটি তিথি গুরুত্ব পেত, পূর্ণিমা, অমাবস্যা ও অষ্টকা। বৈদিক সাহিত্যে উল্লেখ মেলে চান্দ্রমাসের। যদিও সেই মাসের শেষ হতো পূর্ণিমায়। পরবর্তীতে ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ বেদাঙ্গ-জ্যোতিষ পঞ্জিকায় বছর গণনা শুরু হতো উত্তরায়ণের দিন থেকে। তা মেনেই মহাভারতে পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের সময়সীমা নির্ধারণ করা  হয়েছিল। ১২টি চান্দ্রমাস, ২৭টি নক্ষত্র এবং ৩০টি তিথি ধরে 
কালগণনার সেই সূত্র আজও বদলায়নি। পরবর্তীকালে আর্যভট্ট, বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্তের মতো জ্যোতির্বিদরা কালগণনার আরও সূক্ষ্ম পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। বরাহমিহির রচনা করেন কালনির্ণায়ক গ্রন্থ ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’। 
মুঘল আমলের চান্দ্রমাসের হিসেবে বছর গণনা হতো। পরে সৌরমাসকেই প্রামাণ্য নির্ধারণ করা হয়। তার ভিত্তিতে শুরু হয় বাংলা সন। মেষ রাশিতে সূর্য প্রবিষ্ট হওয়ার সময় ধরা হয় পয়লা বৈশাখ। অনুসারে বাংলা সন শুরু হয় পয়লা বৈশাখ থেকে। অনেকে অবশ্য মানেন, আকবরের আগেই রাজা শশাঙ্কের শাসন শুরুর দিন থেকে বঙ্গাব্দের হিসেব শুরু হয়। ৯৬৩ হিজরি হয়ে যায় ৯৬৩ বঙ্গাব্দ।
বাংলায় পাঁজি গণনা ৫০০ বছরের বেশি পুরনো। দৈবজ্ঞ-পণ্ডিতরা নববর্ষের সময় তুলোট কাগজের পুঁথি বগলে অবস্থাপন্নদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গ্রহসন্নিবেশের ব্যাখ্যা শুনিয়ে আসতেন। নদীয়ায় স্মার্ত রঘুনন্দনের জন্ম চৈতন্যদেবেরও ২৫ বছর পর। রঘুনন্দনের প্রেরণায় প্রচলন হয় বাংলা পঞ্জিকার। তবে তাতে গণনার অনেক পার্থক্য ছিল। সেই দোষ নিরসনে নবদ্বীপ পঞ্জিকার প্রচলন করা হয়। সেটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। তাঁর অনুরোধে রামচন্দ্র বিদ্যানিধির মতো পণ্ডিতরা পঞ্জিকার প্রতিলিপি বানিয়ে উপহার পাঠাতেন সমাজের বিশিষ্টজনদের কাছে। সেগুলির নামপত্রে উল্লেখ থাকত ‘মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অনুমত্যানুসারে সঙ্কলিত’। ১৮১৮ সালে শ্রীরামপুরে প্রথম ছাপা হয় পঞ্জিকা। সংকলক-প্রকাশক ছিলেন রামহরি। সেই পাঁজি ছিল ১৫৩ পৃষ্ঠার। আজও ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে তা সংরক্ষিত। এছাড়া জোড়াসাঁকোর দুর্গাপ্রসাদ বিদ্যাভূষণের সম্পাদনায় একটি পঞ্জিকা ছিল বিখ্যাত। বাংলা হরফের জনক পঞ্চানন কর্মকারের জামাই মনোহর দাস ১৮৩৯ সালে নিজেদের প্রেস থেকে একটি পাঁজি প্রকাশ করেছিলেন। রেভারেন্ড লং সাহেব লিখে গিয়েছেন, ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে রামপুরের ‘চন্দ্রোদয়’ প্রেস থেকে এক আনা দামের আশি পৃষ্ঠার একটি পাঁজি প্রকাশিত হতো। প্রতি বছর প্রায় লক্ষাধিক কপি। তার ত্রিশ বছর পর, ১২৭৬ বঙ্গাব্দে দুর্গাচরণ গুপ্তের প্রেস থেকে প্রকাশ হয় একটি ‘গুপ্ত প্রেস পঞ্জিকা’। আজও তা স্বনামে হইহই করে বিকোচ্ছে।
সেই সময় বাংলায় প্যারীমোহন বাকচি নামে এক ব্যবসায়ী ছিলেন। দোয়াতের কালি, চুলের তেল, সেন্ট, রবার স্ট্যাম্পের ব্যবসা ছিল তাঁর। সেই ব্যবসার বিজ্ঞাপন দিতেই পঞ্জিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন প্যারীমোহনের বড় ছেলে কিশোরীমোহন। সেইমতো ১৮৮৮ সালে শরচ্চন্দ্র মৌলিক, অমূল্যচরণ মিত্র, মণিভূষণ বসুর প্রকাশিত হয় পি এম বাকচির ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা। অবিভক্ত বাংলায় প্রায় আড়াই লক্ষ কপি বিক্রি হতো সেই সচিত্র পাঁজির। এসব ছাড়া পূর্ণচন্দ্র (১৩২৫), মদন গুপ্ত (১৩৯০), বেণীমাধব শীল প্রমুখের পঞ্জিকা তো বিখ্যাত। সঙ্কলক মাধবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা ১২৯৭ সনে পাওয়া গিয়েছিল।
শুধু ব্রতপার্বণ নয়, বাঙালির বেঁচে থাকার জন্য যা যা দরকার সবই থাকত সেই সব পাঁজিতে। শুধু শুভ অশুভ অমৃতযোগ নয়, পঞ্জিকায় পাওয়া যেত বাংলা প্রতিটি মুলুকের নানা জিনিসের সুলুকসন্ধান। প্রতিটি জেলার সম্পূর্ণ বিবরণ, ডাক মাশুল, শিক্ষা, সওদাগরি অফিস, রাস্তার তথ্য  এবং অতিঅবশ্যই আশ্চর্য সব পণ্যের সচিত্র বিজ্ঞাপন। আদিরসাত্মক জিনিসও বাদ থাকত না। আঁতেল ও বুদ্ধিজীবীরা যতই তাচ্ছিল্য করুক, এসবের পাঠক কম ছিল না। রেডিও, দূরদর্শন, ইন্টারনেটহীন জগতে সেটিই ছিল সবথেকে কাজের জিনিস।
আজ এই ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামের মতো সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে মুখোমুখি হয়ে পয়লা বৈশাখের শুভেচ্ছা বিনিময়ের গুরুত্ব কমে আসছে। বিশ্বায়ন ঘটছে বাংলা নববর্ষের। নতুন জেন-জি প্রজন্ম উদাসীন হয়ে পড়ছে বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্যের প্রতি। তারপরেও নববর্ষে নতুন জামার মতো পঞ্জিকা ছিল, আছে এবং আগামী দিনেও থাকবে স্বমহিমায়।