বৃহস্পতিবার, 15 মে 2025
Logo
  • বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫

অমৃতকথা (২৭/০৪/২০২৫)

পূর্ণযোগ, নরদেহে দেবজীবন, আত্মপ্রতিষ্ঠিত, ভগবৎশক্তিচালিত পূর্ণ-লীলা, যাহাকে আমরা মনুষ্যজন্মের চরম উদ্দেশ্য নির্দ্দেশ করিয়া প্রচার করি, এই সিদ্ধান্তের মূল ভিত্তি যেমনই বুদ্ধি-গঠিত নূতন চিন্তা নহে, তেমনই কোনও প্রাচীন পুঁথির হরফ, কোনও লেখা-শাস্ত্রের প্রমাণ বা দার্শনিক সূত্রের দোহাই তাহার নহে। 

অমৃতকথা (২৭/০৪/২০২৫)

পূর্ণযোগ, নরদেহে দেবজীবন, আত্মপ্রতিষ্ঠিত, ভগবৎশক্তিচালিত পূর্ণ-লীলা, যাহাকে আমরা মনুষ্যজন্মের চরম উদ্দেশ্য নির্দ্দেশ করিয়া প্রচার করি, এই সিদ্ধান্তের মূল ভিত্তি যেমনই বুদ্ধি-গঠিত নূতন চিন্তা নহে, তেমনই কোনও প্রাচীন পুঁথির হরফ, কোনও লেখা-শাস্ত্রের প্রমাণ বা দার্শনিক সূত্রের দোহাই তাহার নহে। ভিত্তি পূর্ণতর অধ্যাত্মজ্ঞান, ভিত্তি আত্মায় বুদ্ধিতে হৃদয়ে প্রাণে দেহে ভাগবত সত্তার জ্বলন্ত অনুভূতি। এই জ্ঞান কিছু নূতন আবিষ্কার নয়, অতি পুরাতন, নিতান্ত সনাতন। এই অনুভূতি বেদের প্রাচীন ঋষির, উপনিষদের সত্যদ্রষ্টা চরম জ্ঞানীর,—“সত্যশ্রুত কবয়ঃ” যাঁহারা, তাঁহাদেরই অনুভূতি। কলির পতিত ভারতের নৈরাশ্যে-ঘেরা, ক্ষুদ্রাশয়তায় ও বিফল প্রযত্ন প্রাণে নূতন শোনায় বটে,—যেখানে অধিকাংশই আধ-মানুষ হইয়া জীবন যাপন করিতে সন্তুষ্ট, পুরা মনুষ্যত্বের সাধনা কজন করে, সেখানে নবদেবত্বের কা কথা। কিন্তু এই আদর্শ লইয়াই আমাদের শক্তিধর আর্য্য পূর্ব্বপুরুষেরা জাতির প্রথম জীবন গঠন করিলেন। এই জ্ঞানসূর্য্যের উল্লাসভরা ঊষাকালে আত্মস্থ আনন্দবিহঙ্গের সোমরস-প্লাবিতকণ্ঠে বেদগানের আহ্বান-ধ্বনি উঠিয়া বিশ্বদেবতার চরণপ্রান্তে পৌঁছিল। মনুষ্যের আত্মায়, মনুষ্যের জীবনে সর্ব্ববিধ দেবত্ব গঠন দ্বারা সেই অমর বিশ্ববেদের মহীয়সী প্রতিমূর্ত্তি স্থাপন করার উচ্চাশা ছিল ভারত-সভ্যতার বীজমন্ত্র। ক্রমশঃ সেই মন্ত্র ভুলিয়া যাওয়া, হ্রাস করা, বিকৃত করা, এই দেশের ও এই জাতির অবনতি ও দুর্গতির কারণ। আবার সেই মন্ত্র উচ্চারণ, আবার সেই সিদ্ধির সাধনা, পুনরুত্থান ও উন্নতির একমাত্র শ্রেষ্ঠপথ ও একমাত্র অনিন্দ্য উপায়। কেননা, ইহাই পূর্ণ সত্য,—যেমন ব্যষ্টির তেমনি সমষ্টির সাফল্য এইখানে। মনুষ্যের সাধনা, জাতির গঠন, সভ্যতার সৃষ্টি ও ক্রমবিকাশ, এই সকলের গূঢ় তাৎপর্য্য ইহাই। অন্য যে সকল উদ্দেশ্যের পিছনে আমাদের প্রাণ ও বুদ্ধি হয়রান হয়, সে সকল গৌণ উদ্দেশ্য, আংশিক, দেবতাদের সত্য অভিসন্ধির সহায় মাত্র। অন্য যে সকল খণ্ড-সিদ্ধি লইয়া আমরা উল্লসিত হই, সেই সকল কেবল পথের আরাম-গৃহ, মার্গস্থ পর্ব্বতশিখায় জয়পতাকা প্রোথিত করা। আসল উদ্দেশ্য আসল সিদ্ধি মনুষ্যের মধ্যে, কয়েকজন বিরল মহাপুরুষ নয়, সকলের মধ্যে জাতিতে, বিশ্বমানবে ব্রহ্মের বিকাশ ও স্বয়ং-প্রকাশ, ভগবানের প্রকট শক্তিসঞ্চারণ, জ্ঞানময় আনন্দময় লীলা। এই জ্ঞান, এই সাধনের প্রথম রূপ ও অবস্থা আমরা দেখিতে পাই ঋগ্বেদে। ভারত-ইতিহাসের মুখেই আর্য্যধর্ম্ম মন্দিরের দ্বারস্থ স্তূপে খোদিত আদি-লিপি। ঋগ্বেদই যে তাহার আদিম বাণী, সেকথা আমরা ঠিক নিঃসন্দেহে বলিতে পারি না, কারণ ঋগ্বেদের ঋষিগণও স্বীকার করেন যে তাঁহাদের অগ্রবর্ত্তী যাঁহারা ছিলেন, আর্য্য জাতির আদি পূর্ব্বপুরুষেরা, “পূর্ব্বে পিতরো মনুষ্য।” এই পন্থা আবিষ্কার করিয়াছিলেন, তাঁহাদেরই দেবজ্জীবনলাভের সাধনমার্গ পরবর্ত্তী মানবের সত্যের ও অমৃতত্বের পন্থা।


 শ্রীঅরবিন্দের ‘বিবিধ রচনা’ থেকে