চৌধুরীদের আমবাগানে
অমরেশবাবু আবার ছেলেবেলার গল্প বলতে শুরু করলেন, ‘আমি পড়তাম বারুইপুর হাই স্কুলে। আমাদের বাড়ি থেকে স্কুলটা ছিল অনেক দূরে। তাই আমি, তাপস আর শেখর— আমরা তিন বন্ধু সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতাম। তাপস আর শেখর আমাদের পাড়াতেই থাকত।’

বর্তমান ওয়েবডেস্ক
এপ্রিল ২২, ২০২৫
অঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়
—দাদু, তুমি বলেছিলে আজ আমাকে তোমার ছোটবেলার গল্প শোনাবে।
—শোনাব তো। কিন্তু তার আগে তুমি তোমার হোমওয়ার্কটা চটপট সেরে ফেল।
—সে তো আমি কখন কমপ্লিট করে ফেলেছি!
—আচ্ছা, তাহলে বোসো এখানে। আমি তোমাকে আমার ছেলেবেলার গল্প শোনাই।
একগাল হাসি নিয়ে দাদুর বিছানায় বাবু হয়ে বসল ঋক। অমরেশবাবু পানের ডিবে থেকে একটা পান বের করে মুখে দিলেন। তারপর নাতির দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন তাঁর ফেলে আসা দিনের গল্প।
—আমার ছোটবেলা কেটেছে বারুইপুরে। আমার ঠাকুরদার বাড়িতে। কলকাতা থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরের একটি বর্ধিষ্ণু মহকুমা শহর হল এই বারুইপুর। এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয়েছিল এখানকার আদি বাসিন্দা পান ব্যবসায়ী ‘বারুই’ সম্প্রদায়ের নামের সঙ্গে মিল রেখে। পঞ্চদশ শতকের শেষভাগে কবি বিপ্রদাস পিপলাই রচিত মনসামঙ্গল কাব্যেও এই বারুইপুরের উল্লেখ আছে। আদিগঙ্গা বিধৌত বারুইপুরের ভূখণ্ডে একসময় মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের পদধূলিও পড়েছিল।
—শ্রীচৈতন্যদেবের একটা মন্দিরও আছে বারুইপুরে। তার নাম মহাপ্রভুতলা।
নাতির কথায় অবাক হয়ে অমরেশবাবু জিজ্ঞেস করলেন ‘তুমি এত কিছু জানলে কী করে?’
ঋক মুচকি হেসে বলল, ‘মা বলেছে।’
অমরেশবাবু আবার ছেলেবেলার গল্প বলতে শুরু করলেন, ‘আমি পড়তাম বারুইপুর হাই স্কুলে। আমাদের বাড়ি থেকে স্কুলটা ছিল অনেক দূরে। তাই আমি, তাপস আর শেখর— আমরা তিন বন্ধু সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতাম। তাপস আর শেখর আমাদের পাড়াতেই থাকত।’
অমরেশবাবু এবার ঋককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি মায়ের কাছে বারুইপুরের জমিদার বাড়ির কথা শুনেছ?’
ঋক বলল, ‘হ্যাঁ, শুনেছি। চৌধুরীদের জমিদার বাড়ি। রাস পূর্ণিমার সময় জমিদারবাড়ির লাগোয়া বিশাল মাঠটাতে বড় একটা মেলা বসে। রাসের মেলা। বারুইপুরের এই রাস উৎসব প্রায় তিনশো বছরের পুরনো।’
নাতির কথা শুনে অমরেশবাবু খুশি হয়ে বললেন, ‘বাহ! তুমি তো বেশ অনেক কিছুই জানো দেখছি বারুইপুর সম্বন্ধে।’ তারপর বললেন, ‘আজ তোমাকে যে গল্পটা বলব, সেটাও ওই জমিদারবাড়ির আমবাগান নিয়ে। আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন বারুইপুরে এত দোকানপাট, এত লোকজন ছিল না। আমরা যে রাস্তা দিয়ে স্কুলে যেতাম, সেটা বেশ নিরিবিলি ছিল। রাস্তার দু’ধারে ছিল বড় বড় পুকুর। আম, জাম, লিচু আর কাঁঠাল গাছ। গরমকালে স্কুল থেকে ফেরার সময় আমরা ওইসব গাছে ঢিল মেরে মেরে ফল পাড়তাম।’
দাদুকে থামিয়ে দিয়ে ঋক জিজ্ঞেস করল, ‘কেউ বকত না তোমাদের?’
‘দেখতে পেলে তো বকবে! তিন বন্ধুর একজন সবসময় নজর রাখত কেউ আসছে কি না,’ অমরেশবাবু হেসে উত্তর দিলেন।
—তারপর কী হল?
—রাস্তার ধারের ওইসব গাছ থেকে ফল পেড়ে আমাদের তেমন আনন্দ হতো না। তাই আমরা ঠিক করলাম, এবার একদিন চৌধুরীদের আমবাগানে গিয়ে আম পাড়ব। চৌধুরীদের আমবাগানটা ছিল ওদের ওই জমিদারবাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে। এক মানুষ সমান উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। আমরা রোজ স্কুলে যাতায়াতের পথে আমবাগানটাকে দেখতাম, আর তিন বন্ধুতে মিলে ফন্দি আঁটতাম কী করে ওই উঁচু পাঁচিল ডিঙিয়ে বাগানের ভেতরে ঢোকা যায়।
একদিন আমাদের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল। দেখলাম, পাঁচিলের পিছন দিকটায় খানিকটা অংশ একটু ভেঙে গিয়েছে। তখন আমাদের আর পায় কে! ঠিক করলাম সেদিনই স্কুল থেকে ফেরার পথে হবে আমাদের আমবাগান অভিযান।
স্কুল ছুটির পর তিন বন্ধুতে মিলে পাঁচিলের গায়ে সাইকেলগুলোকে হেলান দিয়ে চুপি চুপি বাগানের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। আমাদের মধ্যে একমাত্র তাপস গাছে চড়তে পারত। ঠিক হল তাপস গাছে উঠে আম পাড়বে আর আমরা দু’জন গাছতলায় দাঁড়িয়ে আম কুড়োব। সেইমতো বাগানে ঢুকে তাপস গাছে উঠে পড়ল। দুটো-চারটে আম পেড়েছে কি পাড়েনি, এমন সময় বাগানের ভেতর থেকে পালোয়ানের মতো চেহারার এক ভোজপুরী চৌকিদার ‘কৌন হ্যায় রে’ বলে লাঠি উঁচিয়ে আমাদের দিকে তেড়ে এল। চৌকিদারের সে কি চেহারা! যেমন লম্বা, তেমন চওড়া। তার ওপর আবার ইয়া লম্বা গোঁফ। তাকে দেখে আমাদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেল। আম কুড়োনো ভুলে গিয়ে আমরা পড়ি-কি-মরি করে দৌড় লাগালাম। পাঁচিলের কাছে পৌঁছে বেরতে যাব, এমন সময় মনে পড়ল তাপসের কথা।
আমরা গাছের নীচে ছিলাম তাই চৌকিদারকে তেড়ে আসতে দেখেই পালিয়ে এসেছি। কিন্তু তাপস তো ছিল গাছের ওপর!
দূর থেকে দেখতে পেলাম চৌকিদারের হাতে ধরা পড়েছে তাপস। আর চৌকিদার লাঠি উঁচিয়ে ওকে বেশ ধমক-ধামক দিচ্ছে। যা পরিস্থিতি তাতে তাপস ওই পালোয়ান চৌকিদারের হাত থেকে সহজে ছাড়া পাবে বলে তো মনে হচ্ছে না।
তাপসকে কীভাবে ছাড়িয়ে আনা যায় ভাবতে ভাবতে আমার মাথায় চট করে একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সেদিন মা আমাকে লুচি আর সুজি দিয়েছিল টিফিনে খাওয়ার জন্য। কিন্তু টিফিনের সময় ফুটবল খেলতে গিয়ে আমার আর টিফিন খাওয়া হয়নি। আমি এক দৌড়ে চৌকিদারের কাছে গিয়ে স্কুলের ব্যাগ থেকে টিফিন-বক্সটা বের করে বললাম, এই নাও পাঁড়েজি, লুচি আর মোহনভোগ খাও। আমার মা অনেক ঘি দিয়ে মোহনভোগ বানিয়েছে। এমন মোহনভোগ তুমি আগে কখনও খাওনি।
আমার কথা শুনে চৌকিদার অবাক হয়ে আমার দিকে বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। আমি ততক্ষণে টিফিন বক্স থেকে একটা লুচি বের করে তার মধ্যে খানিকটা সুজি দিয়ে চৌকিদারের দিকে এগিয়ে দিলাম। হতভম্ব লোকটা কিছু না বলে আমার হাত থেকে লুচিটা নিয়ে মুখে পুরে দিল। ওর মুখ দেখে বুঝলাম লুচি খেয়ে ও বড়ই তৃপ্তি পেয়েছে। আমি আরও একটা লুচি-সুজি দিলাম। তারপর আরও একটা। এই করে আমার টিফিন বক্সের সবকটা লুচি আর সবটুকু সুজি খেয়ে চৌকিদার বলল, বহুত বড়িয়া!
তাপস ততক্ষণে সুযোগ বুঝে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। চৌকিদার আমাদের তিনজনকে ভালো করে দেখে নিয়ে বলল, তোমাদের দেখে ভালো ছেলে বলে মালুম হচ্ছে। তোমরা ওভাবে আম চুরি করছ কেন? কাল এই সময় এসো। আমি তোমাদের জন্য পাকা আম পেড়ে রাখব।
পরের দিন স্কুল থেকে ফেরার পথে আমরা আবার আমবাগানে গেলাম। দেখলাম, পাঁড়েজি আমাদের অপেক্ষাতেই একটা ঝুড়ি করে গোটা দশেক পাকা পাকা গোলাপখাস আম নিয়ে বসে আছে।
তাপস আর শেখর চারটে করে আম নিয়েই দৌড় লাগাল। আমি কিন্তু ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি আসছি না দেখে ওরা আমার খোঁজ করতে এল। তাপস বলল, কী রে! এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আম নেওয়া তো হয়ে গিয়েছে। এবার চল। আমি বললাম, তোরা যা। আমি একটু পরে যাচ্ছি।
আসলে পাঁড়েজিকে আমার খুব ভালো লেগে গিয়েছিল। ওই পালোয়ানের মতো চেহারার মানুষটা, যাকে দেখে সবাই ভয় পায়, সে এই এত্ত বড় বাগানটায় একা একা থাকে। কথা বলার কেউ নেই। অসুখ-বিসুখ হলে দেখার কেউ নেই। সারাদিন শুধু গাছ পাহারা দেওয়া। দিন ফুরলে, সূর্য ডুবলে কী করে পাঁড়েজি? কীভাবে কাটায় বন্ধুবান্ধবহীন সন্ধেগুলো?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, এত বড় বাগানে একা একা থাকতে তোমার ভয় করে না?
পাঁড়েজি হো-হো করে হেসে বলল, আমার আবার কীসের ভয়! আমাকেই তো সবাই ভয় পায়।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, তুমি সন্ধেবেলায় কী কর?
হনুমান চালিশা পড়ি। তারপর নিজের জন্য রোটি পাকাই।
গল্প করতে করতে পাঁড়েজির সঙ্গে আমার খুব ভাব হয়ে গেল। আমি সুযোগ পেলেই চৌধুরীদের আমবাগানে চলে যেতাম, পাঁড়েজির সঙ্গে গল্প করতে। যেদিন মা ভালো ভালো টিফিন দিত, সেদিন আর স্কুলে টিফিন-বক্স খুলতাম না। পুরো টিফিনটাই রেখে দিতাম পাঁড়েজির জন্য। পাঁড়েজিও আমাকে গাছপাকা আম খাওয়াত। সে আমের কী স্বাদ! যেন অমৃত!
এই করতে করতে একসময় গরমকাল শেষ হয়ে গেল। ফুরিয়ে গেল আমের মরশুম।
ঋক একটু হতাশ হয়ে দাদুকে জিজ্ঞেস করল, ‘গরম শেষ হতেই তোমাদের বন্ধুত্বও শেষ হয়ে গেল?’
অমরেশবাবু অল্প হেসে বললেন, ‘তাই কখনও হয়! আমের মরশুম ফুরলেও গল্পের মরশুম তো আর ফুরিয়ে যায়নি!’
রাশিফল
-
আজকের রাশিফল
- post_by Admin
- জুন 25, 2025
অমৃত কথা
-
সেবা
- post_by বর্তমান
- জুন 25, 2025
এখনকার দর
-
নিফটি ব্যাঙ্ক
- post_by Admin
- জুন 24, 2025
-
নিফটি ৫০
- post_by Admin
- জুন 24, 2025
-
রুপোর দাম
- post_by Admin
- জুন 25, 2025
-
সোনার দাম
- post_by Admin
- জুন 25, 2025
-
ইউরো
- post_by Admin
- জুন 25, 2025
-
পাউন্ড
- post_by Admin
- জুন 25, 2025
-
ডলার
- post_by Admin
- জুন 25, 2025