নারীশক্তি... বাহিনীর অন্দরে, বাইরেও
ছোট্ট ছেলেটার নাম কণভ। লেহ বেসের খোলা জায়গাটায় ছুটে বেড়াচ্ছে। অনেক লোক এসেছে আজ এখানে। তাই কণভের খুব আনন্দ। তাদের ব্যাগপত্র একটা জায়গাতেই ডাঁই করে রাখা।

বর্তমান ওয়েবডেস্ক
মে ১৩, ২০২৫
শান্তনু দত্তগুপ্ত: ছোট্ট ছেলেটার নাম কণভ। লেহ বেসের খোলা জায়গাটায় ছুটে বেড়াচ্ছে। অনেক লোক এসেছে আজ এখানে। তাই কণভের খুব আনন্দ। তাদের ব্যাগপত্র একটা জায়গাতেই ডাঁই করে রাখা। শিশুটিকে দেখছে তারা। প্রত্যেকের ঠোঁটের কোণায় হাসি লেগে রয়েছে। কে বলবে, এরা লেহতে এসেছে বিশেষ একটা কাজে। তাদের দেশের মাটি দখল করে নিয়েছে পাকিস্তান। ফেরাতে হবে সেই জমি। ছুড়ে ফেলে দিতে হবে ওদের কার্গিলের ওপারে। কঠিন কাজ। কারণ স্ট্র্যাটেজিকালি অনেক এগিয়ে আছে পাকিস্তান। পাহাড়চূড়ার উপর থেকে পুরো ভিউ পাচ্ছে। আর তাই সবটাই ওদের সহজ নিশানায়। কঠিন কাজ। তাই পাঠানো হয়েছে তাদের। বাছাই করে। এতটুকু কনফিডেন্সের অভাব নেই। তারা জানে, প্রাণাধিক প্রিয় দেশের মাটি তারা পুনর্দখল করবেই। কিন্তু এই হাই অলটিটিউডে ছোট্ট শিশুটিকে দেখে তার বিস্মিত। অবাক হওয়ার কারণ? সে স্থানীয় নয়। তাদেরই এক সহকর্মীর ছেলে। ইয়াশিকা ত্যাগীর ছেলে। ভারতের প্রথম মহিলা সেনা অফিসার, যাঁকে প্রথমে উত্তর-পূর্ব, আর তারপর লেহ-লাদাখের উচ্চতায় পোস্টিং দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৬ থেকে ইয়াশিকা এই শিবিরে। হেড কোয়ার্টারে আবেদন করেছিলেন, ছেলেকে তাঁর সঙ্গে রাখার অনুমতি দেওয়া হোক। মঞ্জুর করেছিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এখন যে যুদ্ধ লেগেছে! ইয়াশিকা কি ছুটির আবেদন করেছেন? একে তো ছোট কণভ তাঁর সঙ্গে। উপরন্তু ইয়াশিকা অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু না... বিস্মিত উপরতলার অফিসাররাও। ইয়াশিকা ত্যাগী এখানেই থাকবেন। লড়বেন তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে। কিন্তু কণভ। থাকবে সেও। কারণ সেই তো তার মায়ের শক্তি, বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাসের ভিতের উপরই গড়ে ওঠে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ। গণতন্ত্রও। অস্কারজয়ী অভিনেত্রী মেরিল স্ট্রিপ রাষ্ট্রসঙ্ঘের একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘আফগানিস্তানের মেয়েরা ভোটাধিকার পেয়েছিলেন ১৯১৯ সালে। তারও ৩০ বছর পর ফ্রান্সে, আর ১৯৭১ সালে সুইজারল্যান্ডে। সাতের দশকে সব বড় বড় পেশা শাসন করেছেন মহিলারা। সিভিল সার্ভেন্ট, শিক্ষকতা, চিকিৎসা, জুরি... কোথায় নয়? তাহলে এই পৃথিবী বদলে যাচ্ছে কেন? আজ কাবুলে একটা মেয়ে বিড়ালের স্বাধীনতা একজন মহিলার থেকে বেশি।’ মেরিল স্ট্রিপের বক্তব্যে একটা কঠিন বাস্তব ছিল। আর সেটা কিন্তু শুধু আফগানিস্তান নয়, প্রযোজ্য গোটা বিশ্বের জন্য। নারীশক্তি কি সর্বত্র যথাযথ সম্মান পাচ্ছে? সহজ প্রশ্ন। আর উত্তর হল—‘না’।
ক্যাপ্টেন ইয়াশিকা ত্যাগীর নাম আজ আমরা জানি। কিন্তু তাঁর স্ট্রাগল? সেটা ক’জনের জানা আছে? কিংবা গুঞ্জন সাক্সেনার? তাঁদের স্ট্রাগল কিন্তু শুধু বেড়ে ওঠায় ছিল না! দেশের সশস্ত্র বাহিনীতে নিজেদের প্রতিষ্ঠার মঞ্চ খুঁজে নেওয়ার লড়াইতেও ছিল। আজ কর্নেল সোফিয়া কুরেশি এবং উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং যখন সাংবাদিক সম্মেলনে এসেছেন, আমরা নড়েচড়ে বসেছি। কেউ শাবাসি দিচ্ছি। আবার কেউ তেরচা চোখে তাকিয়ে ধর্মের রাজনীতি খুঁজছি। আমরা ভুলে যাচ্ছি, ভারতের মেয়েদের এভাবে অসম্মান করার অধিকার আমাদের কারও নেই। আমরা দেখতে পাচ্ছি না যে, নারীশক্তি এই সমাজে তাদের পা রাখার জমি শক্ত করে ফেলেছে। ভাবছি না, এই সাফল্যের জন্য আলাদা করে কয়েকশো ক্ল্যাপ, একরাশ স্যালুট তাঁদের প্রাপ্য। কারণ, এই সাফল্য তাঁদের কেউ প্লেটে সাজিয়ে তুলে দেয়নি। অর্জন করেছেন কর্নেল সোফিয়া, ক্যাপ্টেন ইয়াশিকা, উইং কমান্ডার ব্যোমিকারা। যে দেশ যুগ যুগ ধরে মা কালীর শক্তির সাধনা করে এসেছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মা দুর্গাকে সামনে রেখে এগিয়েছে, সেখানেই সশস্ত্র বাহিনীতে মহিলাদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত হল ১৯৯৩ সালে! তারপরও ৩২ বছর কেটে গিয়েছে। এখনও অভিযানের নাম ‘অপারেশন সিন্দুর’ হলে সমালোচনার আবর্জনা জমা হয় তাতে। কেন? কারণ, সিঁদুর হিন্দুত্বের পরিচায়ক। কারণ, আমরা এই নামকে প্রতিবাদের একটা হাতিয়ার হিসেবে দেখতে পারি না! আমরা এখানে ধর্ম খুঁজি। বিভাজনের অশ্বডিম্বে তা দিই।
আমরা ক’জন ভেবেছি যে, এয়ার লেফটেন্যান্ট গুঞ্জন সাক্সেনা যখন তাঁর ‘চিতা’ চপারের চালকের আসনে বসে উড়তে শুরু করেছিলেন, তিনি তখন শুধুই পাইলট। কমব্যাট পাইলট। তাঁর ডিউটি, কার্গিল যুদ্ধের জখম অফিসার-জওয়ানদের উদ্ধার করে নিয়ে আসা। স্কোয়াড্রন লিডার মোহনা সিংয়ের হাতে বাজপাখির রূপ ধারণ করছে ‘হক এমকে ১৩২’। প্রথম মহিলা হিসেবে মিগ ২১ বাইসনের চালকের আসনে বসেছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার অবনী চতুর্বেদী। ক’জন জানি আমরা তাঁর নাম? ঐশ্বর্য রাইয়ের মিস ওয়ার্ল্ড হওয়া বা আলিয়া ভাটের মেট গালায় হাঁটার থেকে অনেক বেশি কৃতিত্বের। অথচ, এ নিয়ে ছিটেফোঁটা আলোচনাও শোনা যায় না। কতই বা বয়স তাঁর? মাত্র ২২ বছর! এই বয়সেই শুধু একটা যুদ্ধবিমান নয়, দেশের সুরক্ষার ভার তাঁর কাঁধে। অথচ তাঁকে সিংহভাগ ভারতই চেনে না! জানি কি আমরা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ভাবনা কান্তের কথা? প্রথম মহিলা হিসেবে মিগ ২১ বাইসন উড়িয়েছিলেন তিনি। কর্নেল পনং ডোমিংকে চেনেন? ১৯ হাজার ফুট উচ্চতা... লাদাখ। চারদিকে বরফ, ক্ষণে ক্ষণে ধস নামছে, ঝোড়ো তুষার হাওয়া তিরের মতো বিঁধছে মুখের খোলা জায়গাটুকুতে। আর কর্নেল ডোমিং নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাস্তা তৈরিতে। বিশ্বের উচ্চতম সড়ক। তারই দায়িত্ব পড়েছে বর্ডার রোড অর্গানাইজনের মহিলা অফিসারের কাঁধে। ওই উচ্চতায় সড়ক তৈরির রেকর্ডের কথা আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু জানি কি কর্নেল ডোমিংয়ের কথা? মনে পড়ছে সেই ছবিটার কথা... একটা লোহার পোস্ট। তাতে লেখা, ‘ওয়েলকাম টু কুমার পোস্ট’। সিয়াচেন হিমবাহের উপর। উচ্চতা, ১৫ হাজার ৬৩২ ফুট। আর সেই পোস্টের সামনে সাদা স্নো-স্যুট পরে দাঁড়িয়ে আছেন ক্যাপ্টেন শিবা চৌহান। এই উচ্চতায় পোস্টিং পাওয়া প্রথম মহিলা অফিসার।
অপারেশন সিন্দুর শুধু পাকিস্তান নয়, এই প্রত্যেক বীরাঙ্গনার জন্য। তাঁদের লড়াইয়ের জন্য। যাঁরা সশস্ত্র বাহিনীর সজ্জা এবং যাঁরা প্রতিদিন প্রতিনিয়ত সমাজের প্রত্যেক স্তরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, এমন প্রত্যেক নারীর জন্য। ১৯৯৩ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মহিলাদের অন্তর্ভুক্তি অনুমোদন পাওয়া মাত্র আবেদন করেছিলেন ইয়াশিকা ত্যাগী। বাবাকে চোখের সামনে দেখেছেন। দেশের জন্য লড়তে। দেশের জন্য প্রাণ দিতে। সেটাই গেঁথে গিয়েছিল মনে। বাবার কফিনবন্দি দেহটা যখন বাড়িতে এল, ইয়াশিকার বয়স তখন সাত। সেদিনই স্বপ্ন আর জেদ মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল... ইউনিফর্মটা তাঁর চাই। পরীক্ষায় সিলেক্ট হওয়ার পর মা কেঁদে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘পাপা কা ইউনিফর্ম ঘর আ গয়া।’ ছেলে নয়, মেয়ে নয়... সন্তান। সেনা। ফাইটার। এটাই পরিচয় তাঁদের। সেই আত্মবিশ্বাসেই কর্নেল সোফিয়া কুরেশিরা দুনিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে হুঙ্কার দিতে পারেন, ‘আমরা বদলা নিয়েছি।’ ১০ মাসের সন্তানকে বাড়িতে রেখে সীমান্তে ডিউটিতে যান বিএসএফ জওয়ান বর্ষা পাতিল। ৫০ বছর আগে যার শুরুটা করে দিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু আর এক মহিলা। ইন্দিরা গান্ধী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘আমার দেশে কী হবে, সেটা অন্য কোনও দেশ ঠিক করে দেবে না। আমরাই সেই সিদ্ধান্ত নেব।’
আত্মবিশ্বাস এটাই। যার উপর ভর করে ভারতের নারীসমাজ প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলেছে। অধিকারের জন্য। সম্মানের জন্য। দেশের জন্য। তা সে রানি লক্ষ্মীবাঈ হোক, কিংবা তাঁর সঙ্গে লড়াইয়ে অংশ নেওয়া এক মহিলা... যাঁর উত্তরসূরির নাম কর্নেল সোফিয়া কুরেশি। ঘরে-বাইরের যুদ্ধে প্রত্যেকদিন তাঁরা হারছেন। উঠে দাঁড়াচ্ছেন। জিতছেন। কখনও গৃহিণী হিসেবে, কখনও মেয়ে, কখনও আবার মা। তাই বছরের প্রতিটা দিন তাঁদের জন্য নারীদিবস। মাতৃদিবসও। বিলেটেড হ্যাপি মাদার্স ডে... ভারতীয় নারী।
রাশিফল
-
আজকের রাশিফল
- post_by Admin
- জুন 14, 2025
অমৃত কথা
-
ধ্যান
- post_by বর্তমান
- জুন 14, 2025
এখনকার দর
-
রুপোর দাম
- post_by Admin
- জুন 14, 2025
-
সোনার দাম
- post_by Admin
- জুন 14, 2025
-
ইউরো
- post_by Admin
- জুন 14, 2025
-
ডলার
- post_by Admin
- জুন 14, 2025
-
পাউন্ড
- post_by Admin
- জুন 14, 2025
-
নিফটি ব্যাঙ্ক
- post_by Admin
- জুন 13, 2025
-
নিফটি ৫০
- post_by Admin
- জুন 13, 2025