শনিবার, 14 জুন 2025
Logo
  • শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫

ভাইরাস যখন যুদ্ধের হাতিয়ার

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান অসংখ্য অসাধারণ আবিষ্কারের ফসল। সেগুলি নিয়ে চলছে এই বিভাগ।

ভাইরাস যখন যুদ্ধের হাতিয়ার

শান্তনু দত্ত: সত্যজিৎ রায়ের ছোটগল্প ‘সেপ্টোপাসের খিদে’ মনে আছে? সেখানে একটা সামান্য গাছ খেয়ে ফেলত তার সামনের আস্ত মানুষটিকে! এ তো গল্পকথা। বাস্তব আরও কঠিন। আরও আগ্রাসী। সেখানে বিভিন্ন সময় মানুষ মারার হাতিয়ার হিসেবে কেবল গাছ নয়, বেছে নেওয়া হয়েছে ক্ষুদ্র ভাইরাসকেও!
এ এক অদ্ভুত লড়াই! শত্রুতার চরম প্রতিঘাত। তবে ফারাক কেবল অস্ত্রে। একটা সময় রামায়ণ-মহাভারতের পাতায় চোখ রেখে আমাদের মনকল্পে ভেসে উঠত তির-ধনুক-তরোয়াল-গদা-চক্রের যুদ্ধ। পুরাণ ছেড়ে ইতিহাস শেখাল যুদ্ধের সময় কামান-বিমান-বন্দুকের ব্যবহার। মানবসভ্যতা তো কখনও যুদ্ধ ছাড়া এগোয়নি! সংঘাতে সংঘাতে এসেছে মুক্তির পথ। ঘুরেছে ইতিহাসের চাকা। আর এই চাকা ঘোরানোর কাজে সর্বশক্তিমান মানুষ আগ্রাসী যুদ্ধপরায়ণ মনোভাব থেকে তৈরি করেছে নয়া নয়া অস্ত্র। ভাইরাসও বাদ যায়নি সেখানে। রাফাল ফাইটার জেট, ক্রুজ মিসাইল স্কাল্প, হ্যামার বোমা... সম্প্রতি ভারত-পাক সংঘর্ষের আবহে এমন নানা আধুনিক অস্ত্রের নাম শোনা গিয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞ মহলের অনুমান, ভবিষ্যতে যুদ্ধ বাধলে লড়াই হতে পারে ভাইরাস দিয়ে। শুনলে হয়তো চমকে যাবেন, সে কারণে ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনায় বহু দেশ এখন মনোযোগী হচ্ছে গবেষণাগারে ভাইরাস তৈরিতে! যুদ্ধ শুরু হলেই শত্রুদেশের বাতাসে কৌশলে মিশে জীবাণু। তাহলেই কেল্লা ফতে। আসবে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য।
ইতিহাস কী বলে?
এই ভাইরাস যুদ্ধের প্রকাশ হালআমলেই হল এমন নয়। এর আগে যেমন বিষাক্ত পোকা, বিছে, মৌমাছি থেকে সাপ— সবই যুদ্ধের অস্ত্র হয়েছে, তেমনই হাতিয়ার হিসেবে ‘ভাইরাস’ও বহু পুরনো। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দে সিথিয়ান নামক এক যাযাবর উপজাতি তিরের অগ্রভাগে বিষ লাগাত। সেই বিষ তৈরি হতো এক অদ্ভুত নিয়মে। মৃত সাপের দেহ ও মানুষের রক্তের মিশ্রণ দিয়ে। পচন ধরে সেই মিশ্রণে জীবাণু সংক্রমণ হতো। তিরের অগ্রভাগে সেই জীবাণু সংক্রমিত মিশ্রণ ব্যবহার করে শত্রুপক্ষের দিকে নিক্ষেপ করা হতো। মহামারি সৃষ্টির জন্য প্লেগ সংক্রমিত লাশ ছড়ানোর নজিরও রয়েছে। 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভাইরাস ব্যবহার করে শত্রুদেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি চর্চায় আসে। এই সময় ‘ইউনিট-৭৩১ মিশন’-এর কথা অনেকেই হয়তো জানেন। রিপোর্ট অনুযায়ী, জাপানি সেনারা বেলুনের মধ্যে প্লেগ ভাইরাস বহনকারী মাছি ছেড়ে দিয়েছিল আমেরিকায়। এর ফলে প্রায় তিন হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে জীবাণু অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা ছিল চোখে পড়ার মতো। তখন অনেক গোপন ল্যাবে ভাইরাসকে জিনগতভাবে পরিবর্তন করা হতো। সেই প্রাণঘাতী ভাইরাসকে শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে পড়ত। ফলে শত্রুপক্ষ সহজেই নাস্তানাবুদ হতো। 
ভাইরাস যুদ্ধের ভবিষ্যৎ
বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার কেবল রাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ভবিষ্যতে বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীও এই হাতিয়ারকে কাজে লাগাতে পারে বলে আশঙ্কা। করোনাকালের পর বিশ্বজুড়ে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ভাইরাস কতটা শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। ২০২২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্কবার্তা জারি করে বলেছিল, যুদ্ধ জীবাণু সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছে। কোন প্রেক্ষিতে এই আশঙ্কার কথা বলেছিল ‘হু’? রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। আসলে, ইউক্রেনে এমন অনেক পরীক্ষাগার রয়েছে যেখানে ক্ষতিকারক ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া নিয়মিত গবেষণা চলে। ইউক্রেনের এমন একটি গবেষণাগার রুশ বাহিনীর হামলার শিকার হলে সেখান থেকে প্রাণঘাতী জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রবল হয়েছিল। সে বছরই রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে জৈব অস্ত্র ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞার পক্ষে সওয়াল করেছিল ভারত। এধরনের অস্ত্র প্রয়োগের ভয়ঙ্কর ফলাফল ও গুরুত্ব বিবেচনা করার কথাও বলেছিল নয়াদিল্লি। নিউক্লিয়ার পরিবার হতে শুরু করেছি আমরা। নিউক্লিয়ার যুদ্ধও এসেছে এ যুগেই। মানুষ যত একা হচ্ছে, ততই যুদ্ধ হয়ে উঠছে ভয়াবহ ও কূট প্দধতির। মানবসভ্যতা কি তাহলে আরও একা হতে হতে ভাইরাস যুদ্ধকেই একসময় আঁকড়ে ধরবে নিজের পরাক্রম বজায় রাখতে? ভয় করে। ধ্বংসের পথেই যে আত্মধ্বংসও থাকে।