শনিবার, 17 মে 2025
Logo
  • শনিবার, ১৭ মে ২০২৫

বোকার রাজ্যে পৃথিবী স্বর্গময়

স্যার আইজ্যাক নিউটনও একদিন আপেল গাছের নীচে বসে এমন একটি প্রশ্ন ভাবছিলেন, যা ছিল সমাজের চোখে একটি বোকা চিন্তা। সমাজে জন্মাবধি ফল তো গাছ থেকে পড়ে আসতেই দেখেছে সবাই, এটাই রীতি, এটাই স্বাভাবিক। ফলে আপেলটি গাছ থেকে উপরের দিকে না গিয়ে নীচে কেন পড়ছে, এ প্রশ্ন করাটা বড় একটা বোকামি। 

বোকার রাজ্যে পৃথিবী স্বর্গময়

স্যার আইজ্যাক নিউটনও একদিন আপেল গাছের নীচে বসে এমন একটি প্রশ্ন ভাবছিলেন, যা ছিল সমাজের চোখে একটি বোকা চিন্তা। সমাজে জন্মাবধি ফল তো গাছ থেকে পড়ে আসতেই দেখেছে সবাই, এটাই রীতি, এটাই স্বাভাবিক। ফলে আপেলটি গাছ থেকে উপরের দিকে না গিয়ে নীচে কেন পড়ছে, এ প্রশ্ন করাটা বড় একটা বোকামি। 

 

ঋপণ আর্য
 ‘আমি বড় হয়ে বোকা হতে চাই’,
বলেছিল রিক। থমকে গিয়েছিলাম সেদিন, ফের জিজ্ঞেস করেছিলাম— ‘বড় হয়ে বোকা হলে তোমাকে তো সবাই ঠকিয়ে যাবে বাবা?’ সঙ্গে সঙ্গে উত্তরে সে বলেছিল, ‘আমি তো কাউকে ঠকাব না।’ সেদিন বীরভূম জেলার শীতলগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাস থ্রি’র রিক বাগদির সেই উত্তরে চমকে ছিলাম খুবই, চমকেছিল বাংলার আপামর জনতা। প্রতিযোগিতা, লক্ষ্য, উচ্চাশার এই চালাক পৃথিবীতে বোকা হয়ে টেকা যে ভীষণ কঠিন। পদে-পদে হোঁচট, পদে-পদে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, পদে-পদে অপমান! যুক্তি বলবে, বোকা হয়ে থাকা যায় না। পরিণত বয়সের একজন সাধারণ বোধসম্পন্ন কোনও মানুষ যদি বারবার বুঝতে পারেন যে, তাঁকে ঠকানো হচ্ছে অথবা প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তা হলে স্বাভাবিক প্রবণতায় তিনি সতর্ক হবেনই। অবশ্য কাঠবোকারা কখনই তাদের ভুল থেকে কোনও শিক্ষা নেয় না, উপরন্তু ভুলগুলোকেই পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। কিন্তু ভেবে দেখলে দেখবেন, বোকা আসলে আমরা সবাই! এই যে নিজের খেয়ে অন্যের দোষ চর্চা করে বেড়াই, অন্যের সাথে অকারণে বিবাদে লিপ্ত হই, এটা কি বোকামি নয়? অন্যের বুদ্ধিতে ঠকে যাওয়াটা আমাদের গায়ে বেশি লাগা সত্ত্বেও কেন দেশের আশি শতাংশ মানুষ চাইবে তার হয়ে অন্য কেউ যেন সিদ্ধান্তটা নিয়ে দেয়? যে সমাজে, যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আবহে আমরা বাস করি, তাতে আমরাও কি নিয়ত পথেঘাটে, জিতে যাওয়া রাজনেতার ক্রমাগত প্রতিশ্রুতি খেলাপে বোকা হয়ে পদে-পদে ঠকছি না? ঠকেও তো শিখিছি না, ঠেকেও বা শিখছি কই? আমার-আপনাদের মতো এ-দেশে ‘সচেতন’ বোকারাই আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠ।
ধরা যাক, কোনও একদিন শার্লক হোমস আর ওয়াটসন মুখোমুখি বসে। হচ্ছে কাল্পনিক এই কথাবার্তাটুকু—
‘—আশেপাশের আর পাঁচ জনের চেয়ে বুদ্ধিশুদ্ধি মোটেও কম নয় আমার, কিন্তু হোমস, তুমি সঙ্গে জুটলেই কেন ক্রমাগত বোকামিতে পেয়ে বসে আমায়?
—যেভাবে আমিও দাদা মাইক্রফটের কাছে জট খুলতে বসে আবিষ্কার করি, কতই না বোকামি আমার! যেভাবে তাড়াহুড়োর মন নিয়ে মানুষ সহজে ভুল করে ফেলে,  অপরাধী ফেলে যায় সূত্র, যেভাবে নেতা আমলাদের ক্ষমতার সামনে বোকাসোকা উপস্থিতি পেয়ে বসে আমাদের, কেন-না আমরা দেখে ফেলেছি প্রতিবাদ মিছিলকে এই শহরে হাইজ্যাক হতে! বোকামি আমাদের বেঁচে থাকার শত-ছিদ্র দোকানপাট, আমাদের বিক্রি করে, আমাদের বিপন্ন করে, তবু জানে মারে না! এমনকী ক্ষমতাবানের বোকামিও তাকে বড়জোর জোকার বানিয়ে ছাড়ে এই ভাইরাল বাজারে...’ 
রিক বাগদিও জানে, সমাজের তথাকথিত উপরতলার মানুষ, তুলনায় যাঁরা পিছিয়ে তাঁদের ছলেবলে কৌশলে ঠকায়। সে একথা জেনেছে বাবার মুখ থেকে। তার দিনমজুর বাবা নানান জায়গায় কাজ করে। অনেকে টাকা দেয় না, অনেকেই বোকা পেয়ে নাকি তাঁকে ঠকায়। কিন্তু বাবা কাউকে ঠকিয়েছে, এমনটা কখনও শোনেনি। বাবা তাকে বলেছে, প্রকৃত মানুষ কখনও কাউকে ঠকায় না। বাবার মতো সেও তাই কাউকে ঠকাতে চায় না। বাবার মতো সেও একজন সৎ নাগরিক হতে চায়। এ যেন রুশ সাহিত্যিক ফিওদর দস্তয়েভস্কির  ‘ইডিয়ট’ উপন্যাসের সহজ-সরল এবং নিষ্পাপ সেই প্রিন্স মিশকিন চরিত্রটি। সমাজ যাকে ‘বোকা’ মনে করত। জগতের ধূর্ততা না বুঝে ক্রমাগত দুঃখ পেয়ে গেলেও সরলতা, মানবিকতা এবং ভালোবাসার ক্ষমতা তাঁকে সবার থেকে আলাদা করে তুলেছিল। এই ‘বোকামি’ই তাঁকে একটি গভীর এবং নৈতিক চরিত্রে পরিণত করেছিল। মিশকিনের সাথে মিশে আমিও সেদিন টের পেয়েছিলাম, বোকামি এবং মানবিকতা আসলে একে অপরের অন্যতম পরিপূরক।
মানুষ সবচেয়ে বড় বোকা তখন হয়, যখন আপনজন ছেড়ে চলে যায়। রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের রতন, যার সরল ভালোবাসা জ্ঞানীদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। আসলে সমাজে জ্ঞানী নিজেকে যতটাই বড় ভাবুক না কেন, বোকা নিজেকে সর্বদা ছোট করে— তার এই ছোট করাতে লুকিয়ে আছে নিরহঙ্কার। এক বোকা জিজ্ঞেস করল, ‘সূর্য কেন ওঠে?’ কেউ বলল, ‘পৃথিবী ঘোরে বলে।’ বোকা বলল, ‘তাহলে আমি কেন ঘুরি না?’ উত্তর না পেয়ে সে হাসল। এই হাসিতেই জীবনের গাম্ভীর্য ভেঙে যায়। মনে পড়ে, আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। বুদ্ধিমন্ত স্যার ক্লাসে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘গাছপালা কোন উপকারে আসে আমাদের?’ অনেকের সঙ্গে ক্লাসের তুলিও হাত তুলেছিল সেদিন। স্যার তাকে বলতে বললে, উত্তরে সে বলেছিল— ‘ছার, গাছপালা থাকলি গতরে বাতাস নাগে!’ শুনে সেদিন গম্ভীর বুদ্ধিমন্ত স্যারও হেসে উঠেছিলেন, প্রশ্রয় পেয়ে আমাদের সঙ্গে তুলিরও সে কী হাসি! এই যে সমবেত হাসিতে জীবনের গাম্ভীর্য ভেঙে গিয়েছিল। বোকামি আসলে জীবনের অতি-গাম্ভীর্যের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ। জ্ঞানী সত্য খোঁজে, বোকা সত্যের খোঁজ না করে সরাসরি গ্রহণ করে। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক ডায়োজেনিস বোকামির মতো আচরণ করতেন— একবার দেখা গেল, তিনি এক মূর্তির সামনে দাড়িয়ে সেটির কাছ থেকে ভিক্ষা চাইছেন। লোকে এই বোকামির কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অনুশীলন করছি!’ ডায়োজিনিস দিনে লন্ঠন জ্বেলে সৎ মানুষ খুঁজতেন, সমাজের জ্ঞানের অহঙ্কারকে ব্যঙ্গ করে। আসলে সমাজে জ্ঞানী সুখ খোঁজে পরিকল্পনায়, বোকা খোঁজে মুহূর্তে—হঠাৎ পাওয়া ফুলের গন্ধে। জ্ঞানী সত্যকে বিশ্লেষণ করে, যুক্তি দিয়ে মেপে নেয়—বোকা সত্যকে শুধু দেখে, অনুভব করে। যেমন, এক বোকা গাঁয়ের লোকের মিথ্যা শুনে হাসল, কিন্তু মিথ্যাটা ধরার চেষ্টা করল না—তার কাছে হাসিটাই সত্য হয়ে গেল। বোকামি শেখায়, প্রশ্নের উত্তর না পেলেও জীবন থামে না। এটা আমাদের মুক্ত করে—জানার চাপ থেকে, জেতার দৌড় থেকে। বোকারা এমন প্রশ্ন করে যা জ্ঞানীরাও ভাবে না। যেমন, বোকা বিনয় জিজ্ঞেস করল, ‘মেঘ কেন সাদা, কালো না?’ কেউ জবাব দিতে পারল না, তবু সবাই ভাবতে শুরু করল। স্যার আইজ্যাক নিউটনও একদিন আপেল গাছের নীচে বসে এমন একটি প্রশ্ন ভাবছিলেন, যা ছিল সমাজের চোখে একটি বোকা চিন্তা। সমাজে জন্মাবধি ফল তো গাছ থেকে পড়ে আসতেই দেখেছে সবাই, এটাই রীতি, এটাই স্বাভাবিক। ফলে আপেলটি গাছ থেকে উপরের দিকে না গিয়ে নীচে কেন পড়ছে, এ প্রশ্ন করাটা বড় একটা বোকামি। বোকা মানুষরা প্রায়ই এমন কাজ করে, যা সমাজের দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক। কিন্তু এই অস্বাভাবিকতাই অনেক সময় নতুন দিকের জন্ম দেয়। আইনস্টাইনকে তাঁর তত্ত্বের জন্য প্রথমদিকে বোকা বলে মনে করা হয়েছিল। গ্যালিলিওর মতো বিজ্ঞানী বা ভ্যান গগের মতো শিল্পীও প্রথমে বোকা বলে বিবেচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের ‘বোকামি’-ই পৃথিবীর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছিল। প্লেটোর গুহার রূপক যদি জ্ঞানের সন্ধান হয়, তবে বোকামি সেই গুহায় বসে ছায়া নিয়ে হাসার ক্ষমতা। সে জিজ্ঞেস করে না, ‘সত্য কী?’, বরং বলে ‘কী হবে জেনে?’ ভারতীয় দর্শনে নাস্তিক চার্বাকের সরল ভোগবাদ বোকামির মতো—জটিল মোক্ষের পথে না গিয়ে এখানে-এখনকার আনন্দে বিশ্বাস করে। বোকামি শেখায়, জীবনের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর জানার দরকার নেই; কখনও কখনও না জানাই সত্যিকারের জানা। এরিখ ফ্রম তাঁর দার্শনিক রচনায় বলেছেন, বোকামি অনেক সময় প্রকৃত জীবনযাপনের প্রতীক। সমাজের বুদ্ধিমান মানুষরা প্রায়ই যান্ত্রিক হয়ে যায়, কিন্তু তথাকথিত বোকা মানুষরা তাদের সরলতায় জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য উপলব্ধি করে। তিনি লিখেছেন, ‘শুদ্ধ সরলতা আমাদের আবার শিশু হতে শেখায়, যেখানে মুক্তি এবং আনন্দ রয়েছে।’
বোকা মানুষেরা আদতে জগতকে শিশুদের মতো দেখেন। তাদের মধ্যে কোনও হিংসা, প্রতিযোগিতা বা অহঙ্কার থাকে না। এই প্রসঙ্গে একটা শোনা গল্পের কথা মনে পড়ছে, একটা মানুষ যে কখনও অবাক হতো না! অতি বিষম ঘটনাতেও গ্রামের কেউ কখনও অবাক হতে দেখেনি তাকে। ঘরের পাশে খেজুর গাছটায় উঠে এক সন্ন্যাসী গাজনের সময় মাথা উল্টে নামছেন, তা দেখেও অবাক হননি তিনি। এমনকী নিজের স্ত্রী যখন ছোট্ট বাচ্চাটিকে রেখে অন্যের সঙ্গে না জানিয়ে ঘর ছাড়ল, তখনও অবাক হননি! সেই তিনি অবাক যখন হলেন, হতেই থাকলেন। কীসে অবাক হলেন? তার সেই ছোট্ট শিশুটির  কাণ্ডকারখানায়। অর্বাচীন কাণ্ডকারখানায়।
মানুষের বেলায় অর্বাচীনতা ঘুচতেই জীবনের প্রায় তিনভাগ কেটে যায়। পশুর জীবনে খাদ্য সংগ্রহ আর জীবন ধারণের কাজে কতকগুলি নির্দিষ্ট পন্থা অবলম্বন করলেই চলে, তাই তাদের পরিপক্কতা অনেকখানি জন্মগত। কতগুলো চড়াই পাখিকে জন্মের পরেই যদি খাঁচায় বন্দি করে রাখা হয়। আর পরিণত বয়সে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে বিনা ট্রেনিংয়েই উড়তে পারবে। কিন্তু মানুষের আচরণ বিকাশের ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রাণীদের মতো প্রবৃত্তি খুব প্রভাবশালী নয়। মানবজীবনের পরিপক্কতা জন্মের পূর্বে হয় যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশি হয় জন্মের পরে, অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। মানব শিশুর গুরুমস্তিষ্কের বহিরাংশ, সেরিব্রাল কর্টেক্স, অনেক দিন অপরিণত থাকে। সেই জন্যই হয়তো সকল প্রাণীর চেয়ে একমাত্র  মানুষের শৈশবকাল দীর্ঘ সময়ব্যাপী! অর্থাৎ বোকামি সহজে মানুষের পিছু ছাড়ে না! তাই মনোবিদ রুশো এই দীর্ঘ শৈশবের প্রতি আরও সতর্ক ও যত্নবান হতে বলেছিলেন অভিভাবকদের। তাঁর মতে, একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের সাপেক্ষে শিশু জীবনে ১ থেকে ১৪ বছরের মধ্য ৫০ শতাংশ ব্রেন তৈরি হয়ে যায় আর বাকি ৫০ শতাংশ হয় পূর্বের অর্জিত জ্ঞান ও বাকি জীবনের অর্জিত জ্ঞানের ভিত্তিতে। এই জন্যই হয়তো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘বর্ণপরিচয়’ আদর্শলিপি রচনার মাধ্যমে বোঝাতেও চেয়েছিলেন, মূল্যবোধ, জীবনবোধ শিশুবয়স থেকেই শিখতে হবে আমাদের। তিনি মনে করতেন, ‘আমি ঠকাব না কিন্তু ঠকালে প্রতিবাদ করব।’ পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ রয়েছেন, যাঁঁরা কাউকে না ঠকিয়ে সুন্দর জীবনযাপন করেন। তাঁরা কিন্তু বোকা নন। 
রিক বাগদিও ঠিক বোকা নয়, আবার চতুর নয়। সেই যে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার বলেছিলেন, ‘বোকা বুদ্ধির চেয়ে বুদ্ধিমান বোকা ভালো।’ রিক হল সেই বুদ্ধিমান বোকা বাচ্চাটি। এখন চতুর্থ শ্রেণিতে আমার অঙ্কের ক্লাসে যে খুবই তৎপর, অনেক সময় মুখেমুখেই অঙ্কে কষে আগেভাগে উত্তর বলে দেয়। আগে বছর ছয়-সাত ধরে পড়াতাম প্রিয় এক ছাত্র উদয়কে, খুবই কৃতী ছাত্র। সে বুদ্ধিদীপ্ত হলেও ঘটনাক্রমে তার নানান বোকামি প্রত্যক্ষ করেছি, তা নিয়ে তার বাবা মাকে আফসোসও করতে দেখেছি! এই বোকামি সে করেছিল তার সরল মনের গুণে, অনভিজ্ঞতার গুণে, সে চতুর নয় বলেই। বুদ্ধিমান বোকা। বোকামি এবং জ্ঞান একে অপরের বিপরীত মনে হলেও, আসলে তারা একসূত্রে গাঁথা। দার্শনিকরা বোকামিকে একটি প্রজ্ঞার রূপ হিসেবে দেখেছেন। প্লেটো এবং সক্রেটিসের মতে, বোকামি বা ‘নিজেকে জানার সীমাবদ্ধতা স্বীকার করা’ হল প্রকৃত জ্ঞানের প্রথম ধাপ। সক্রেটিসের সেই যে বিখ্যাত উক্তি—‘আমি জানি যে আমি কিছুই জানি না।’ এই বিনম্রতা বোকামির একটি রূপ, যা আমাদের জ্ঞানের গভীরে নিয়ে যায় এবং নিজের সীমাবদ্ধতাটুকু মেনে নেওয়ার শিক্ষা দেয়। তাই হয়তো জেন দর্শন এবং হাইকু কবিতায় সরলতা এবং বোকামির দার্শনিক সৌন্দর্য বারবার উঠে আসে। বোকামিকে এখানে জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহের অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। বোকামি অনেক সময় আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত। জীবনের সব প্রশ্নের উত্তর জানা তো সম্ভব না, আর জানার চেষ্টা কর‍তে গিয়েই হয়তো আমরা আসল আনন্দটুকুই হারিয়ে ফেলি। বোকামি তাই এক ধরনের মুক্তি—না জানার, না বোঝার, শুধু হওয়ার। লাও তজু, জেন গুরু, এবং বিভিন্ন আধ্যাত্মিক নেতারা প্রচার করেছেন, ‘নিজেকে শূন্য করা’ বা ‘নিজের কিছু জানার দাবি না রাখা’ হল আত্মার মুক্তির পথ।
খলিল জিব্রানের কবিতায় বোকামির সরলতা হল ঈশ্বরের নিকটবর্তী হওয়ার একটি পথ। তিনি লেখেন, ‘বোকা সেই, যে জীবনের ছোট আনন্দে সুখ খুঁজে পায়, কারণ সে বোঝে না যে, এটাই জীবন।’ তাই বলি, আসুন আমাদের গুরুতর পরিকল্পনার সাথে একটু বোকামি মেশাই। সামান্য বোকামি করি চলুন। ইচ্ছে করেই করি না হয়, সঠিক মুহূর্তে মূর্খ হওয়াও সুন্দর।