শনিবার, 19 জুলাই 2025
Logo
  • শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫

দেশ

শিবজ্ঞানে জীবসেবার আদর্শের রূপায়ণে বিবেকানন্দ দরিদ্রনারায়ণদের অন্ন বস্ত্র ঔষধাদি সাহায্য দানের জন্য সেবা দেউল গড়ে তুললেও, এ ধরণের স্থূল, শারীরিক সাহায্যকে তিনি সর্বনিম্ন স্থান দিয়েছেন। 

দেশ

শিবজ্ঞানে জীবসেবার আদর্শের রূপায়ণে বিবেকানন্দ দরিদ্রনারায়ণদের অন্ন বস্ত্র ঔষধাদি সাহায্য দানের জন্য সেবা দেউল গড়ে তুললেও, এ ধরণের স্থূল, শারীরিক সাহায্যকে তিনি সর্বনিম্ন স্থান দিয়েছেন। কারণ, তিনি উপলব্ধি করেছিলেন মানুষের অভাবজনিত দারিদ্র্য দুঃখ চিরতরে ঘোচান সম্ভব নয় এরকম স্থূল সাহায্যের দ্বারা। দেশের প্রত্যেকটি গৃহকে দাতব্য আশ্রমে পরিণত করলেও, হাসপাতালে দেশ ছেয়ে ফেললেও, যতদিন না মানুষের স্বভাব বদলাচ্ছে ততদিন দুঃখকষ্ট থাকবেই থাকবে। একমাত্র অধ্যাত্মজ্ঞানই মানুষের সকল দুঃখ চিরকালের জন্য দূর করতে পারে। তাই তিনি আধ্যাত্মিক সাহায্যকেই সর্বশ্রেষ্ট সাহায্য বলেছেন। বলেছেন, “জগতের এই দুঃখ সমস্যার একমাত্র সমাধান মানবজাতিকে শুদ্ধ ও পবিত্র করা। মানুষকে জ্ঞানালোক দাও, সকল মানুষ পবিত্র আধ্যাত্মিক বলসম্পন্ন ও শিক্ষিত হউক, কেবল তখনই জগৎ হইতে দুঃখ নিবৃত্ত হইবে, তাহার পূর্বে নয়।”
বিশ্বমানবদরদী সত্যানন্দদেবেরও লোককল্যাণ ব্রতের লক্ষ্য ছিল স্থূল সাহায্যের সাথে সাথে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ধর্মচেতনার উন্মেষ সাধন। তিনি চেয়েছিলেন জীবের অন্তর্নিহিত দেবত্বের জাগরণ, শিবসত্তার উদ্বোধন। দেশের দীনদুঃখী সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মচেতনা জাগাবার উদ্দেশ্যে তাঁর বহুমুখী প্রচেষ্টার মধ্যে একটি বিশেষ দিক ছিল সিউড়ীতে সারদা মেলা, দুবরাজপুরে অভেদানন্দ মেলা, রাসবনে রাসমেলার প্রবর্তন। মেলাতে যাতে সত্য শিব সুন্দরের প্রকাশের মূল সুরটি থাকে সেদিকে তিনি বিশেষ দৃষ্টি রেখেছিলেন। সে কারণেই বহুজন সমাবেশে সরগরম এই মেলাগুলি নিছক আনন্দ হৈ হুল্লোড় আর পণ্য বিনিময়ের কেন্দ্রে পরিণত হয়নি—এগুলি ছিল লোকশিক্ষামূলক কৃষ্টিমূলক ও দিব্য আনন্দদায়ক অভিনব মেলা। এই মেলাগুলির অনুষ্ঠান সূচীতে থাকত—হোম, পূজা, উপনিষৎ, গীতা, চণ্ডী পাঠাদি ধর্মীয় অনুষ্ঠান; কবিগান, যাত্রাভিনয়, কালী-কীর্তন, কথকতা ইত্যাদি গ্রামীণ সংস্কৃতিমূলক অনুষ্ঠান; সারদা মা, রামকৃষ্ণদেব, স্বামীজী, অভেদানন্দের জীবনালেখ্য প্রদর্শনী; সুধী সম্মেলন, সঙ্গীত সম্মেলন, হরিজন সম্মেলন ইত্যাদি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই সব অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সারদা-রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-অভেদানন্দ ভাবধারা দেশের আপামর সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন সত্যানন্দদেব। সেই সঙ্গে দীননারায়ণের অন্নবস্ত্রাদি স্থূল সাহায্যেরও বিশেষ ব্যবস্থা ছিল প্রত্যেকটি মেলাতে। রাসবনের মেলার মূল লক্ষ্যই ছিল সেখানকার আদিবাসী ও অনুন্নত সম্প্রদায়। তাদের আনন্দ দানের জন্য, তাদের ভেতর ধর্মবোধ জাগাবার জন্য, তাদের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মান উন্নয়নের জন্য তাদের মতো ক’রে কৃষ্টিমূলক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিলেন এই মেলাতে।
গ্রামের কৃষাণ, মজুর, মুনিষ, বাগ্‌দী, ধাঙড় প্রভৃতি অস্পৃশ্য ও অন্ত্যজ মানুষেরা আধ্যাত্মিক অধিকার বঞ্চিত, নৈতিকমানহীন। তাঁদের জীবন অশিক্ষার ঘন তমসায় আবৃত। সমাজে তাঁরা সর্বভাবে অবহেলিত। সেজন্য এঁদের প্রতি করুণাবতার সত্যানন্দদেবের ছিল অসীম করুণা। এঁদের শুধু অন্ন বস্ত্রাদি স্থূল সাহায্য দান ক’রে তিনি শান্তি পান নি। এঁদের নৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনের উন্নতি বিধানের জন্য তিনি ব্যাকুল হয়েছেন। তাই তিনি এঁদের পবিত্র রামকৃষ্ণ নামে দীক্ষা দান ক’রে উন্নত ধর্মজীবনের অধিকারী ক’রে এগিয়ে দিয়েছেন আধ্যাত্মিকতার পথে। 
স্বামী হীরানন্দের ‘আলোর দেবতা সত্যানন্দ’ থেকে

রাশিফল