বৃহস্পতিবার, 19 জুন 2025
Logo
  • বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫

‘ইন্দিরা হোনা আসান নেহি’

পাকিস্তানকে রক্ষা করতে হেনরি কিসিঞ্জার কত দূর যেতে প্রস্তুত ছিলেন, তার এক বড় উদাহরণ বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় যে গণহত্যা শুরু হয়েছিল, এই তথ্য কিসিঞ্জারের অজানা ছিল না। 

‘ইন্দিরা হোনা আসান নেহি’

মৃণালকান্তি দাস: পাকিস্তানকে রক্ষা করতে হেনরি কিসিঞ্জার কত দূর যেতে প্রস্তুত ছিলেন, তার এক বড় উদাহরণ বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় যে গণহত্যা শুরু হয়েছিল, এই তথ্য কিসিঞ্জারের অজানা ছিল না। তখন তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সবচেয়ে কাছের লোক। উইলিয়াম রজার্স বিদেশসচিব হলেও কিসিঞ্জারই ছিলেন নিক্সনের পরামর্শদাতা। পাকিস্তানের গণহত্যার নীতির প্রতি সমর্থন জানিয়ে কিসিঞ্জার বলেছিলেন, ‘আমাকে শয়তানের পক্ষে ওকালতি (ডেভিলস অ্যাডভোকেট) করতে দিন।’ গোটা কর্মজীবনে তাই-ই করেছেন!
১৯৭১-এর ২৮ মার্চ ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড এক টেলিগ্রামে হোয়াইট হাউসকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ‘ভীতির রাজত্ব’ কায়েম হয়েছে বলে যে সতর্কবার্তা পাঠান, পরদিন সকালেই সেই তথ্য কিসিঞ্জারের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। একদিন পর দিল্লিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিটিং ‘নির্বাচিত গণহত্যা’— এই শিরোনামে এক টেলিগ্রামে অনুরোধ করেন, ‘নীতির ভিত্তিতে কর্মপন্থা নির্ধারণের এখনই সময়’। কিন্তু ঢাকা থেকে সামরিক অভিযানের খবর পেয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার বদলে খুশিই হয়েছিলেন কিসিঞ্জার।
মনে পড়ে, রিচার্ড নিক্সন ও হেনরি কিসিঞ্জারের সেই কথোপকথন? কিসিঞ্জার বলেছিলেন, মি. প্রেসিডেন্ট, আমাদের ইয়াহিয়াকে বাঁচিয়েই রাখতে হবে। সম্মতি জানিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন বলেছিলেন, ‘আসলে ওদের (ভারত) মনে যে অভিসন্ধি আছে, তা হল পাকিস্তানকে ধ্বংস করা। সেদিন চরম ভারত বিরোধিতায় নেমেছিলেন কিসিঞ্জার। নিক্সনের কাছে এক মেমোতে কিসিঞ্জার পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘এখন এমন কিছুই আমরা করব না, যা ইয়াহিয়ার পক্ষে অস্বস্তিকর। পাকিস্তানের ঐক্যের স্বার্থে আমাদের উচিত ইয়াহিয়ার সঙ্গে থাকা।’ 
আসলে আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষেই থাকবে, বাঙালিদের নয়— নিক্সন ও কিসিঞ্জার এই সিদ্ধান্ত এক বছর আগেই নিয়ে রেখেছিলেন। ১৯৭০ সালের ২৫ অক্টোবর হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ইয়াহিয়ার সঙ্গে মুখোমুখি এক বৈঠকে তাঁরা সেই সিদ্ধান্ত নেন। নিক্সন তাঁকে জানিয়েছিলেন, ‘আপনাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।’ জবাবে ইয়াহিয়া বলেছিলেন, ‘আপনাদের বন্ধুত্বের জন্য আমরা গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। কথা দিচ্ছি, এমন কিছুই করব না, যাতে আপনারা বিব্রত হন।’
মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ভিতরেই কিসিঞ্জারের ভারত বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠেছিল। পাত্তা দেননি কিসিঞ্জার। নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে তাঁর যুক্তি ছিল, এর ফলে ভারতকে সাহায্য করা হবে। সেই কথার সমালোচনা শুরু হলে কিসিঞ্জার নতুন পথ ধরেছিলেন। বলেছিলেন, এই নীতি আমার নয়, প্রেসিডেন্টের। পাকিস্তান, বিশেষত পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার জন্য নিক্সনের ‘কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে’। পাকিস্তানের প্রতি কেন এই দুর্বলতা, পাকিস্তানের সামরিক শাসকের সঙ্গে কী বিশেষ সম্পর্ক— সে কথা তখনও অনেকের অজানা। জুলাইয়ের মাঝামাঝি জানা গেল, পাকিস্তানের সামরিক শাসকের মধ্যস্থতায় চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চলছে। নিজের স্মৃতিকথায় কিসিঞ্জার যুক্তি দেখিয়েছেন, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন আমেরিকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আর সেই সম্পর্ক স্থাপনে ‘একমাত্র’ সূত্র ছিল পাকিস্তানের ইয়াহিয়া। কথাটা মিথ্যে। 
সেই সময় স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্তা ছিলেন ক্রিস্টোফার ভ্যান হল্যান। পরে এক দীর্ঘ প্রবন্ধে তিনি প্রমাণ করেছেন, শুধু ইয়াহিয়া নয়, রোমানিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান চশেস্কু, ইরানের শাহ ও পোল্যান্ডের মাধ্যমে সেই যোগাযোগের সুযোগ ছিল। বস্তুত ইয়াহিয়ার আগে চশেস্কুর মাধ্যমেই চীনা নেতাদের সম্মতিসূচক চিঠি এসে পৌঁছেছিল আমেরিকার হাতে। ভ্যান হল্যান লিখেছেন, কিসিঞ্জার পিকিং ঘুরে এসেছেন এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে— এই ঘোষণার পর স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্তারা ভেবেছিলেন, হয়তো পাকিস্তানের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এবার হয়তো আমেরিকা পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যার ব্যাপারে নীতি বদলাবে। কিসিঞ্জার তাতেও আপত্তি করেন। এবার তাঁর যুক্তি, ভারত শুধু পূর্ব পাকিস্তানের বিভক্তি নয়, পাকিস্তান আক্রমণ করে দেশটি দখল করতে চায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এতে ইন্ধন জোগাচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ভ্যান হল্যান জানাচ্ছেন, সিআইএ এবং অন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলির কেউই এই তথ্য দেয়নি। ভারত পূর্ব পাকিস্তান দখলে উদ্যত, এমন কথাও কোনও পক্ষ থেকেই বলা হয়নি। সবটাই কিসিঞ্জারের মনগড়া। অথচ, দিনের পর দিন এমন মনগড়া তথ্য প্রচার করে ভারতের বিরোধিতা করে গিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বারবার ‘বিচ’ এবং ভারতীয়দের ‘বাস্টার্ড’ ও ‘সান অব বিচ’ বলতেও ছাড়েননি। 
মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও ইন্দিরা গান্ধীর দূরত্ব কারও কাছেই গোপন ছিল না। নিক্সন যখন ১৯৬৭ সালে দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন, মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে মিসেস গান্ধী এতটাই বিরক্ত হয়েছিলেন যে, নিক্সনের সঙ্গে থাকা ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের এক অফিসারকে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আর কতক্ষণ এই লোকটাকে সহ্য করতে হবে?’ দু’জনের মধ্যে সম্পর্কের শীতলতা অব্যাহত ছিল ১৯৭১ সালেও। পূর্ব পাকিস্তানের নৃশংসতার প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে ইন্দিরা গান্ধী আমেরিকা সফরে যান। বৈঠকের আগে ইন্দিরা গান্ধীকে নিক্সন ৪৫ মিনিট দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসের প্রাক্তন অফিসার মহারাজ কৃষ্ণ রসগোত্রা বিবিসিকে বলেছিলেন, নিক্সনের উদ্দেশ্য ছিল মিসেস গান্ধীকে অপমান করা। তবুও সেদিন হোয়াইট হাউসে দাঁড়িয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে ইন্দিরা গান্ধী বলে এসেছিলেন, ‘নৃশংসতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের মেরুদণ্ড সোজা রয়েছে, যথেষ্ট ইচ্ছেশক্তি এবং সম্পদ রয়েছে। সেই সময় পেরিয়ে গিয়েছে যখন শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গ হওয়ার কারণে ৩-৪ হাজার মাইল দূর থেকে কেউ ভারতীয়দের নির্দেশ দিত, তাদের ইচ্ছে চাপিয়ে দিত।’ চাণক্যর বুদ্ধি থাকলেও নানা ঘটনায় বোঝা যেত, ইন্দিরা ‘রোবট’ নন। ক্ষুরধার বুদ্ধির পাশাপাশি ছিল তীব্র আবেগ। আচরণে ছিল স্বতঃস্ফূর্ততা। তাই কিসিঞ্জার বলেছিলেন, ‘ইন্দিরা হলেন কোল্ড-ব্লাডেড প্র্যাকটিশনার অব রিয়্যাল পলিটিক।’
বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণের মুখে দীর্ঘ সময় পাকিস্তানি সেনারা টিকে থাকতে পারবে না, এ কথা কিসিঞ্জার ও নিক্সনের অজ্ঞাত ছিল না। শেষ চেষ্টা হিসেবে তাঁরা বঙ্গোপসাগরে ভারত-বাংলাদেশ নৌসীমানায় পারমাণবিক অস্ত্র সজ্জিত সপ্তম নৌবহর পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু কোনও সিদ্ধান্তই কাজে আসেনি। অ্যাডমিরাল এসএম নন্দা তাঁর আত্মজীবনী ‘দ্য ম্যান হু বম্বড করাচি’-তে লিখেছেন, ‘ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহতেই একটি সোভিয়েত ডেস্ট্রয়ার ও মাইনসুইপার মালাক্কা উপসাগর থেকে এই অঞ্চলে পৌঁছে গিয়েছিল। আমেরিকার নৌবহরটি ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ওখান থেকে সরে না যাওয়া পর্যন্ত সেটিকে অনুসরণ করেছিল সোভিয়েত নৌবহর।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইয়াহিয়া-কিসিঞ্জার-নিক্সন ঠেকাতে পারেননি। এরপরও কিসিঞ্জার তাঁর ‘হোয়াইট হাউস ইয়ার্স’ গ্রন্থে সাফাই গেয়েছেন, বাংলাদেশের গণহত্যায় তিনি বাধা দেননি, কিন্তু ‘সবই করতে হয়েছিল পাকিস্তানকে বাঁচানো জন্য’। তাঁর জন্যই (পশ্চিম) পাকিস্তানকে বাঁচানো গিয়েছে।
পাকিস্তানের প্রতি এই মার্কিন প্রীতিতে ধুলো জমলেও তা আজও অটুট। নয়তো ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের মধ্যে হঠাৎ মধ্যস্থতায় কেন নামলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প? ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের লড়াই’— এই তথ্য জানার পরও কেন আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার বা আইএমএফ পাকিস্তানের জন্য ১০০ কোটি ডলারের লোন মঞ্জুর করল? ভারতবাসী জানতে চায়, পরমাণু অস্ত্র নিয়ে দিনের পর দিন ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে রাখলেও, পাকিস্তান কথায় কথায় পরমাণু অস্ত্রের ভয় দেখায় কীভাবে? পাকিস্তানের পরমাণু ভাণ্ডার নিয়ে মার্কিন প্রশাসন এত নীরব কেন? একইসঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, বাইরের কোনও দেশের শীর্ষনেতার মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হল কেন। নয়াদিল্লির আগেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কেন এই ‘বিরতি’ ঘোষণার সুযোগ পেলেন। কেন কাশ্মীর ইস্যুতে হস্তক্ষেপ চাইছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প? বিরোধীদের সঙ্গত প্রশ্ন, এতে বিশ্বের সামনে ভারতের দুর্বলতাই কি প্রকাশিত হল না? কাশ্মীর-সমস্যা আসলে একটি দ্বিপাক্ষিক সমস্যা, সুতরাং তাতে বাইরের কোনও শক্তির হস্তক্ষেপের জায়গা নেই— এই মর্মে ভারতের দীর্ঘকালীন অবস্থানকে কেন ধাক্কা দিতে চাইছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট? ১৯৪৭ সাল থেকেই কাশ্মীর-প্রশ্নের আন্তর্জাতিকীকরণ নিয়ে দিল্লি ও ইসলামাবাদের যে দ্বন্দ্ব— তার পরিপ্রেক্ষিতে কি ভারতের সম্মান ক্ষুণ্ণ হল না? দেশবাসী জানতে চায়, যুদ্ধের অভিঘাত নেওয়ার ক্ষমতা যদি না থাকে, তবে দেশবাসীকে তাতানোর পিছনে রাজনীতিটা কী? কেন এই সুযোগে বিশ্বজনমতকে ভারতের পক্ষে আনা গেল না? আমেরিকা চাইলে সবাইকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বলে যে ভাষ্য তৈরি হল, তা ভারতের জন্য কতটা গৌরবের? কেন ভারত ইন্দিরা গান্ধীর মতো সাহস দেখাতে পারল না?
প্রশ্ন উঠবেই, কয়েক দিনের সংঘর্ষে কী পেলেন নরেন্দ্র মোদি, দেশবাসীকে কী দিলেন। ভারতের রাজনীতি ইন্দিরা যুগ থেকে আজ মোদি যুগে এসে পৌঁছেছে। অনেক পরিবর্তন এসেছে সমাজে, রাজনীতিতেও। একটা ব্যাপার এর মধ্যে স্পষ্ট— আজকের নেতৃত্বে যতটা না স্বতঃস্ফূর্ততা তার চেয়ে অনেক বেশি কৌশল। আবেগহীন মিডিয়া-কালচার গড়ে তোলা। যেখানে নেতার ‘মিথ’-কে নানা কর্পোরেট কৌশলে নির্মাণ করা হয়। কিন্তু আসল সময় দৃঢ়তা দেখাতে না পারলে, দেশীয় রাজনীতিতে নিজের ‘মিথ’ বানিয়ে কী লাভ? হয়তো তাই, সোশ্যাল মিডিয়ার কথাগুলি যেন বড় বেশি আছড়ে পড়ছে: ‘ইন্দিরা হোনা আসান নেহি’...
লালকৃষ্ণ আদবানি বলেছিলেন, ‘এত বছর পরও মনে হয়, ইন্দিরা গান্ধীর রাজনীতিতে আছে অনেক অনেক স্তর। কখনও তিনি প্রকাশিত, কখনও মেঘের আড়ালে।’