শনিবার, 17 মে 2025
Logo
  • শনিবার, ১৭ মে ২০২৫

কৃচ্ছ্রসাধনা

একদা ফ্রান্সিস্কান সম্প্রদায়ের কতিপয় নেতৃস্থানীয় পুরুষ—সেন্ট ফ্রান্সিস তাঁদের অন্যতম— কোন ব্যক্তি-বিশেষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাত্রা করেছিলেন।

কৃচ্ছ্রসাধনা

একদা ফ্রান্সিস্কান সম্প্রদায়ের কতিপয় নেতৃস্থানীয় পুরুষ—সেন্ট ফ্রান্সিস তাঁদের অন্যতম— কোন ব্যক্তি-বিশেষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাত্রা করেছিলেন। সেন্ট ফ্রান্সিসের সঙ্গে একজন সহযাত্রী পথ চলছিলেন। কথা হচ্ছিল এই নিয়ে যে, যাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তাঁরা যাচ্ছেন, তিনি তাঁদের অত্যর্থনা করবেন কি না, তাঁদের সঙ্গে বাক্যালাপ করবেন কি না। সহযাত্রীটি বললেন, খুব সম্ভব তিনি আমাদের অভ্যর্থনা করবেন না— প্রত্যাখ্যান করবেন। তদুত্তরে সেন্ট ফ্রান্সিস বলেছিলেন, “তাঁর প্রত্যাখ্যানই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট নয়, বন্ধু! যদি দ্বারে আমাদের করাঘাত শুনে তিনি বেরিয়ে আসেন এবং আমাদের দূর করে তাড়িয়ে দেন, তবে সেটাও আমাদের পক্ষে যথেষ্ট হবে না; অথবা তিনি যদি আমাদের হাত-পা বেঁধে নির্মমভাবে বেত্রাঘাত করেন, তাহলে সেটিও পর্যাপ্ত হলো বলে আমি মনে করব না; তবে যদি আমাদের হাত-পা সব দৃঢ়ভাবে বেঁধে, বেত্রাঘাতে প্রতি লোমকূপ থেকে রক্তমোক্ষণ করিয়ে তিনি আমাদের ঘরের বাইরে বরফের মধ্যে ফেলে রাখেন, তবে সেটাই আমাদের উদ্দেশ্যলাভের পক্ষে পর্যাপ্ত হতে পারে।” এমনি কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনার একটি মনোভাব সে-যুগে বিদ্যমান ছিল।
বস্তুতঃ জৈনরাই ছিল কৃচ্ছ্রসাধনার পথিকৃৎ। তবে সেই সঙ্গে তারা কিছু কিছু মহৎকার্যও সম্পন্ন করেছিল। তাদের কথা ছিল— কাউকে আঘাত করো না, দুঃখ দিও না, যথাশক্তি অপরের উপকার সাধন কর। এই কর্ম, এই নীতি ও সদাচার— এ ছাড়া আর যা কিছু সবই ব্রাহ্মণদের হাতে গড়া বাজে জিনিস; সেগুলি বর্জন কর। এই মতবাদের ভিত্তিতেই তারা কর্মে প্রবৃত্ত হয়েছিল এবং এটিকেই নানাভাবে পূর্বাপর তারা বিস্তৃত করেছিল। সে এক বিচিত্র আদর্শ। শুধু অ-বৈরী ও পরোপকারের ভিত্তিতে সকল নৈতিক আদর্শকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া— একটি অভিনব আদর্শ বইকি!
বুদ্ধদেবের অন্ততঃ পাঁচশত বৎসর পূর্বেকার এই সম্প্রদায়। আবার বুদ্ধদেবও খ্রীস্টের জন্মের সাড়ে-পাঁচশত বৎসর পূর্বে বর্তমান ছিলেন। এরা সমগ্র প্রাণিজগৎকে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করেছিল। তাদের মধ্যে সর্ব নিম্নস্তরের যে জীব, তার মাত্র একটি ইন্দ্রিয় বর্তমান, সেটি স্পর্শেন্দ্রিয়। তার উপরের স্তরে রয়েছে স্পর্শ ও আস্বাদন-ইন্দ্রিয়। তারও উপরে— স্পর্শ-স্বাদ এবং শ্রবণেন্দ্রিয়। চতুর্থ স্তরে আবার— পূর্বের তিনটির সঙ্গে দর্শনেন্দ্রিয় যুক্ত হয়। আর সর্বশেষ স্তরে পঞ্চন্দ্রিয়ের সবই বর্তমান থাকে।
এক বা দুই ইন্দ্রিয়বিশিষ্ট যে-সব প্রাণী— তারা চর্মচক্ষে দৃশ্যমান নয়। তারা জলমধ্যে অবস্থান করে। এদের— এই অতি-নিম্নপর্যায়ের প্রাণীদের হত্যা করা অতি ভয়াবহ কার্য। এ-যুগে প্রাণিজগতের এ-সকল তত্ত্ব অতি অল্পদিন আগে মাত্র জানা গেছে। তৎপূর্বে এ-সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা ছিল না। জৈনদের মত এই ছিল যে, সর্ব নিম্নস্তরে প্রাণীদের এক স্পর্শানুভূতি ভিন্ন আর কিছু নেই। তার উপরের স্তরের প্রাণীরাও অদৃশ্য। জৈনরা জানত যে, এ-সব প্রাণী শুধু জলেই বাস করে এবং জল ফুটালে এরা মারা যায়। কাজেই জৈনসন্ন্যাসীরা তৃষ্ণায় মরে গেলেও নিজেরা জল ফুটিয়ে পান করতেন না। 
স্বামী বিবেকানন্দের ‘ভগবান বুদ্ধ ও তাঁর বাণী’ থেকে