উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে মধ্যম ফল আশা করা যায়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে নতুনত্ব আছে। কর্মরতদের ... বিশদ
বছর দুয়েক আগের কথা। লে শহর থেকে এক সকালে গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম লাদাখের জনপ্রিয় পর্যটনস্থল প্যাংগং হ্রদের পথে। এ আমার চেনা পথ। কতবার এই পথে এসেছি। তবুও যেন আশ মেটে না। এই পথের পাগলকরা সৌন্দর্যের টানে বারবার আসতে চায় মন। সিন্ধু নদকে পাশ কাটিয়ে শকতি গ্রাম, চাংলা গিরিবর্ত, দুরবুক পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম ১৪ হাজার ফুট উচ্চতায় সেই নয়নাভিরাম হ্রদের তীরে। প্রথম রাতটা কাটালাম হ্রদের তীরে স্পাংমিক গ্রামের এক বিলাসবহুল তাঁবু আবাসে। পরদিন অচেনা দুর্গমপথে যাত্রা। স্পাংমিক গ্রাম পেরিয়ে শুরু হওয়া সেই পথে পর্যটকদের সংখ্যা হাতে গোনা। এটা লাদাখের সব থেকে সৌন্দর্যময় পথযাত্রা।
পরদিন সকালে উঠে ভোরের প্যাংগংয়ের দৃশ্যটি দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া অথচ রোদ ঝলমলে দিন। আকাশের রং ঘন নীল। নীলের বুকে পালকের মতো উড়ে চলেছে সাদা মেঘের দল। ব্রেকফাস্ট সেরে আবার এগিয়ে চলা নতুন গন্তব্যের উদ্দেশে। হ্রদের তীর ধরে গাড়ি এগিয়ে চলেছে। এদিকে প্যাংগং হ্রদের অন্যরূপ। আরও সুন্দর দেখতে লাগছে তাকে। নিস্তব্ধ চরাচর। প্রায় ৯ কিলোমিটার যাওয়ার পরে প্রথম যাত্রাবিরতি মান গ্রামে। অদূরেই হ্রদ। গোটা কয়েক ঘরবাড়ি নিয়ে একটুকরো বসতি। এদিকের গ্রামগুলির অধিকাংশই চাংপা আদিবাসীদের ডেরা। চারপাশে রুক্ষ পাহাড়ের ঘেরাটোপ। গ্রামের মানুষের চাহিদা মেটাতে সামান্য চাষাবাদও হচ্ছে। এখান থেকে রওনা দিয়ে এরপর পৌঁছলাম মেরক গ্রামে। হ্রদছোঁয়া এই গ্রামও আড়ে বহরে আগেরটার মতোই। ভাবলেই অবাক লাগে যে, এত দুর্গম প্রান্তরে মানুষ বসবাস করে কী করে। যত এগচ্ছি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আরও মায়াবী হয়ে উঠছে। পথের বাঁদিকে সমান্তরালে বয়ে চলেছে প্যাংগং হ্রদের নীলাভ জলরাশি। হ্রদের অদূরেই আকসাই চীন সীমান্ত। সাম্প্রতিক সীমান্ত উত্তেজনায় এই অঞ্চল আজ খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে। সীমান্ত অঞ্চল বলে পথে সেনাবাহিনীর কড়াকড়ি যথেষ্ট। কয়েকবার সঙ্গে আনা পারমিট চেকপোস্টে দেখাতে হল। পাহাড়ের মাথায় ছড়িয়ে রয়েছে সেনাদের ছাউনি। এদিকে সেভাবে পথ বলতে কিছু নেই। গাড়ির চাকার দাগ ধরে সাবধানে এগিয়ে চলেছি। থাকুম-এর পরে প্যাংগং পাহাড়ের বাঁক ঘুরে চলে গিয়েছে ইন্দো-চীন সীমান্ত পেরিয়ে চীন দেশে। হ্রদকে আর দেখা যাচ্ছে না। পথ আরও দুর্গম। অবশেষে এলাম চুশুল। এটাই সেই সীমান্ত গ্রাম যেখানে ১৯৬২ সালে চীন-ভারতের অন্যতম যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। গ্রাম লাগোয়া বিস্তৃত উপত্যকা। সবুজ মাঠে দলবেঁধে চরছে পশমিনা ছাগল। এখানে দেখলাম বুদ্ধ মন্দির, ওয়ার মেমোরিয়াল। দূরে দেখা গেল দুই দেশের সেনাদের ফ্ল্যাগ মিটিং পয়েন্ট। যাত্রাপথে মাঝে মধ্যেই পেরতে হচ্ছে পাহাড়ি ঝোরা। পেরিয়ে গেলাম অতি দুর্গম সাগা গিরিবর্ত। লোমা পৌঁছে দেখা পেলাম সিন্ধু নদের। পথের শেষ পর্বে প্রকৃতি সুন্দর থেকে সুন্দরতর হয়ে উঠেছে। দু’পাশে দিগন্তবিস্তৃত রুক্ষ উপত্যকা। লোমা থেকে চলেছি হানলে গ্রামের পথে। এই অংশের রাস্তার অবস্থা ভালো। এই পথ দিয়ে একসময় ভারত আর তিব্বতের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য চলত। রংগো গ্রাম পেরিয়ে বিকেলবেলা পৌঁছলাম হানলে গ্রামে। স্পাংমিক থেকে এখানে আসতে ১৭৬ কিলোমিটার পথ পেরতে হল। যে পথের সিংহভাগই দুর্গম।
প্রথম দর্শনেই হানলে গ্রাম মন জয় করে নিল। এ যেন প্রকৃতির বিস্ময়লোক। চওড়া উপত্যকার এক কোণে গ্রামের অবস্থান। উপত্যকার বুক চিরে বইছে হানলে চু নদী। এই অঞ্চল চাংথাং ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারির অধীনে। এখানে দু’রাত থেকে ঘুরে নেব উপত্যকার নানা অংশ। নদী ব্রিজ পেরিয়ে এলাম গ্রামের অন্দরে। এখানে হোম স্টে-তে রাত্রিবাস। নিরালা গ্রাম্যজীবন। গ্রামের প্রবেশপথের লাগোয়া টিলার ওপর রয়েছে ১৭ শতকের বিশালাকার এক বৌদ্ধ গুম্ফা। এর অনেকটাই আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। রয়েছে নানা মাপের চোর্তেন। উপর থেকে উপত্যকার দৃশ্য দেখে মন ভরে যায়। গ্রামের অন্যপ্রান্তে আরেকটি টিলার মাথায় বসানো রয়েছে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন টেলিস্কোপ। হানলে গ্রামের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত সারাদিন ধরে চষে বেড়ালাম। নদীর ধারে দেখতে পেলাম কত রকমের পাখি। উপত্যকার বুকে আপনমনে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিয়াং গাধা, ইয়াক। রুক্ষ প্রকৃতিও যে কত সুন্দর হতে পারে অচেনা সীমান্ত গ্রাম হানলে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। হানলে বেড়িয়ে অন্য পথ ধরে ফিরে চললাম লে শহরে।
ছবি: সুবীর কাঞ্জিলাল