হঠাৎ পাওয়া যোগাযোগের মাধ্যমে কর্ম জটিলতার অবসান ও মানসিক চিন্তামুক্তি। আয় ব্যয়ের ক্ষেত্র ঠিক থাকবে ... বিশদ
এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ/তবু রঙ্গে ভরা।’ এমন যে দেশ, সেই দেশে যাঁর জন্ম, সেই বিচিত্রবাবুর জীবন নানান রঙ্গে ভরা হবে, এ যে একেবারে সেই বিধির করে দেওয়া অমোঘ বিধানের মতোই সত্য।
আসলে বিচিত্র নামটার মতোই বড় বিচিত্র উনি। পাড়ার লোকেদের সঙ্গে তেমন মেশেন-টেশেন না। পাড়ায় থাকেনও না বিশেষ। হিল্লি-দিল্লি করে বেড়ান। ন’মাসে-ছ’মাসে একবার করে দর্শন দেন। পাড়ার বিশেষ কারওর সঙ্গে না মিশলেও আমার সঙ্গে বিচিত্রবাবুর একটা গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে! হয়তো মনের মিল থেকেই আমাদের এই দুই নবীন-প্রবীণের মধ্যে সেই সম্পর্ক। বিচিত্রবাবু বলেন, ‘সখ্য’।
এহেন বিচিত্রবাবুই কি না এবার নামতে চলেছেন ফিল্মে! সিনেমা করবেন! উনি উত্তমকুমার হবেন, উনি অমিতাভ বচ্চন হবেন। কখনও ঘুসি মেরে ভিলেনের নাক ফাটাবেন, চড় মেরে দাঁত ফেলে দেবেন। কখনও বা মোটরবাইক চড়ে গান গাইবেন চোখ বন্ধ করে। যাইহোক এইবার সিনেমায় নামছেন বিচিত্রবাবু!
....
পেঁয়াজের খোসাটা তাহলে প্রথম থেকেই ছাড়ানো যাক। ব্যাপারটা হল, মাসখানেক আগে টালিগঞ্জের ফিল্ম কোম্পানির একটি দল আড্ডা গেড়েছে আমাদের এলাকায়। বলা ভালো দখল নিয়েছে। ‘নিজের চিতা জ্বালল পিতা’ নামের একটি সিনেমার কিছু দৃশ্যের শ্যুটিংয়ের জন্যই ওই ফিল্ম কোম্পানির এখানে আগমন। নিজের চিতা যে কীভাবে পিতা শেষ পর্যন্ত জ্বালাবেন, তা অবশ্য আমার জানা নেই! তবে এক মাস যাবৎ ওই লাইট, ক্যামেরা, প্রোডাকশনের লোকজনের দাপাদাপিতে আমাদের এই পাড়াটা হয়ে উঠেছে যেন একটা মিনি স্টুডিও পাড়া। যার কারণে, এলাকার ছেলে-ছোকরা থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা পর্যন্ত সকলে যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে দীর্ঘ একঘেয়ে জীবনযাত্রার হাত থেকে। কী ছিল জীবনে! বিনোদন বলতে ওই যা একটু পরনিন্দা, কিছুটা রসিয়ে রসিয়ে পরচর্চা। তা-ও যে বড় একঘেয়েপনা হয়ে গিয়েছিল জাবর কাটতে কাটতে। আর ঠিক তখনই ঢাক ঢোল পিটিয়ে সবাইকে জাগিয়ে দিল এই ফিল্ম কোম্পানির লোকগুলো এসে। শ্যুটিং দেখতে যাওয়ার তাড়া পড়েছে ঘরে ঘরে। পিতা যদি আমাদের এখানে এসে নিজের চিতা না জ্বালত তবে কি এত কিছু হতো? আর বিচিত্রবাবুও যদি ঠিক এই সময়েই ফিরে না আসতেন তাহলে ওঁর আর সিনেমায় নামাটাও হতো না। কিন্তু ওই যে বলেছিলাম বিধির অমোঘ বিধান, এক অদৃশ্য রজ্জুতে বাঁধা। অবশ্য অভিনয়ের ব্যাপারে বিচিত্রবাবুর তেমন কোনও ইচ্ছেই ছিল না বলতে হয়। ওই ধরে বেঁধে হরিনাম করানোর মতো ব্যাপার আর কী।
আমি আর বিচিত্রবাবু মোক্ষম এক দিনে গিয়েছি শ্যুটিং দেখতে। এর আগে কোনওদিন শ্যুটিং দেখিনি। জগতের আশ্চর্য বিষয়গুলোর মধ্যে শ্যুটিং দেখাটাও আমার কাছে তাই একটা বিস্ময়কর বিষয়! আমি, বিচিত্রবাবু সহ প্রায় শ’খানেক জনতা গোল করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শ্যুটিং দেখছি। মস্ত বড় রঙিন ছাতার নীচে ঢাউস ঢাউস ক্যামেরা ফিট করা, ঝকঝকে লাইট টাঙানো হয়েছে চারধার থেকে। রেললাইনের মতো কৃত্রিম ট্র্যাক পাতা হয়েছে দেখলাম একটা। আর সেই সব যন্ত্রপাতির মাঝে দাঁড়িয়ে অবলীলায় ডায়লগ আওড়ে যাচ্ছেন এই ছবির লিডিং মোস্ট ক্যারেক্টর— জিৎকুমার। বহু পুরনো শিল্পী জিৎকুমার। এই ছবিতে নাম ভূমিকায় অর্থাৎ পিতার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন জিৎকুমার। একটু বয়স বেড়েছে বটে কিন্তু এখনও জিৎকুমারের যেমন সুন্দর চেহারা তেমনই সুন্দর অভিনয় দক্ষতা। ওঁর সেই দক্ষ অভিনয় সামনে থেকে লাইভ দেখে পাড়ার নেতু ঠাকুমার সে কী কান্না! কিছুতেই থামে না। কত বোঝানো হল উনি অভিনয় করছেন, সত্যি সত্যি মরছেন না। তবুও থামানো যায় না। শেষে স্বয়ং জিৎকুমারের হাতেই একটা রসগোল্লা খেয়ে কান্না থামান নেতু ঠাকুমা। নেতু ঠাকুমা অবশ্য বাড়ি ফিরতে ফিরতে নাতনি রাইমাকে গা ঠেলা দিয়ে ফিসফিস করে গোপন কথা বলছিলেন যখন, তখন আমিও ওঁদের পিছনে পিছনেই ফিরছিলাম।
—কেমন অ্যক্টোখানা করলাম বল দিকি। তোদের জিৎকুমার নিজে এসে কি না হাতে করে রসগোল্লা খাইয়ে গেল।
—বল কী ঠাকমা!
—ছোটবেলায় আমারও কী কম ইচ্ছে ছিল অ্যক্টো করার... তোর ঠাকুরদার সঙ্গে বিয়ে হয়েই গেল আমার জেবনটা... না হলে তোর এই ঠাকুমাকে পেতিস কোথায় এখন।
আসল ঘটনাটা ঘটল পরদিন। আমি বিচিত্রবাবুর বাড়ির বারান্দায় বসে চা খাচ্ছি। কোথা থেকে দুটো উটকো লোক হাজির হল বাড়ির দরজায়।
—এটাই কি বিচিত্রবাবুর বাড়ি?
—হ্যাঁ। আমিই বিচিত্র গুপ্ত। কী দরকার?
—বড় বিপদে পড়ে এসেছি আমরা।
আমি আর বিচিত্রবাবু মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম একবার।
—আমরা আসছি প্রোডাকশন থেকে।
—প্রোডাকশন?
আমরা বুঝতে পারছি না কী বলতে চাইছেন ওঁরা। ওই শব্দগুলো আমাদের মতো ছাপোষাদের কাছে বড় কঠিন।
—ওই যে সিনেমার শ্যুটিং শুরু হয়েছে। সেখান থেকে। আমি ‘নিজের চিতা জ্বালল পিতা’ ছবির ডিরেক্টর।
দু’জনের মধ্যে চাপ দাড়িওয়ালা লোকটাই পুনরায় বললেন, ‘মহাবিপদে পড়ে আমরা এসেছি আপনার কাছে।’
—বিপদ?
—আমার কাছে!
—আর বলবেন না...।
তারপর ওই ডিরেক্টর দুঃখ করে যা বললেন, তার সারমর্ম হল, ওঁর ছবির লিডিং মোস্ট ক্যারেক্টর জিৎকুমার গতকাল শ্যুটিং করে বাড়ি ফেরার সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। বয়সজনিত কারণেই মূলত সমস্যা। ভর্তি করা হয়েছে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে। ডাক্তার বলে দিয়েছেন এখন কোনওভাবেই শ্যুটিং করা যাবে না। ছবির নিরানব্বই ভাগ শ্যুটিং হয়ে গিয়েছে। বাকি শুধু একটা সিন। তবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। জিৎকুমার কবে শ্যুটিং শুরু করবেন তা কেউ জানে না। কিন্তু এভাবে তীরে এসে তরী ডুবলে গোটা প্রোডাকশনের কোটি টাকা লস হয়ে যাবে। তাই ওঁরা এসেছেন বিচিত্রবাবুর কাছে।
‘আমি কীভাবে আপনাদের সাহায্য করব তা তো বুঝলাম না!’ বিচিত্রবাবুর মতো আমিও খুব হতবাক হয়েছি। কোটি টাকার সমস্যা যেখানে, সেখানে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ কী মীমাংসা করতে পারে!
‘আপনাকে ওই শেষ সিনটা করে দিতে হবে স্যার,’ আর কোনও ভণিতা না করে ডিরেক্টর মশাই বললেন।
—মানে?
—আপনাকে জিৎকুমারের হয়ে অভিনয় করতে হবে।
‘অভিনয়!’ আমরা দু’জনই একসঙ্গে বিষম খেলাম।
—হ্যাঁ স্যার, আমাদের বাঁচান।
‘খুব অল্প সিন। আর আপনাকে কিছু করতে হবে না তেমন। হয়ে যাবে।,’ পাশের ভদ্রলোকটি ফুট কাটলেন।
‘কিন্তু জিৎকুমারের জায়গায় বিচিত্রবাবুকে নিলে কী করে হবে?’ আমি বললাম।
—হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি কি জিৎকুমার? কী যে বলেন আপনারা!
—আরে আজ মর্নিং ওয়াক করতে গেছিলেন যখন, তখন আমাদের টিমের মেকআপ আর্টিস্ট আপনাকে দেখে ছুটে আসে আমার কাছে। আমার তখন মাথায় হাত পড়েছে জিৎকুমারের খবরটা পেয়ে। সারা রাত ঘুম হয়নি। মেকআপ আর্টিস্ট ছেলেটি বলল সে নকল জিৎকুমার জোগাড় করে ফেলেছে। আর সে এখানকার বাসিন্দা। ব্যস তারপর খুঁজে খুঁজে এখানে।
কোথায় জিৎকুমার কোথায় বিচিত্রবাবু! মনে মনে ভাবলাম আমি। ‘বলছি বিচিত্রবাবুর তো বয়স হয়েছে।’
—নো প্রবলেম। মেকআপে কমিয়ে দেওয়া হবে।
—চুল কিছুটা পড়ে গেছে যে সামনের দিকে?
—নো প্রবলেম। নকল চুল লাগিয়ে দেব।
—বিচিত্রবাবু কি জিৎকুমারের হাইটের হবে?
—নো প্রবলেম। ক্যামেরাতে মানিয়ে নেওয়া হবে।
—তাহলে আর কী। এখন বিচিত্রবাবু রাজি থাকলেই...।
আমি কথা থামালে বিচিত্রবাবু বললেন, ‘কিন্তু আমি যে অভিনয় করতে পারি না।’
—দরকার নেই, শুধু শুয়ে থাকবেন চুপ করে। বাকিটা আমরা বুঝে নেব। দয়া করে রাজি হয়ে যান স্যার। আর মাত্র একদিনের শ্যুট বাকি।
বিচিত্রবাবু গম্ভীর হয়ে সাহায্যপ্রার্থীর দুঃখ নিবারণ করলেন, ‘আচ্ছা বেশ।’
বিচিত্রবাবু অবশেষে সিনেমায় নামলেন।
সত্যি আশ্চর্য মেকআপ দিয়েছে বটে ফিল্ম কোম্পানির লোকেরা। বিচিত্রবাবুকে দেখে বোঝার উপায় নেই উনি নকল জিৎকুমার নাকি আসল! আমি উপস্থিত বিচিত্রবাবুর ছায়াসঙ্গী হিসেবে। সেই একইরকম ভাবে বড় রঙিন ছাতার নীচে বড় বড় ক্যামেরা, চারধারে জোরালো লাইট। শুধু আসল জিৎকুমারের জায়গায় অভিনয় করেছেন বিচিত্রবাবু।
বিচিত্রবাবু অভিনয় করছেন বললাম বটে, কিন্তু উনি ঠিক অভিনয় করছেন না। অভিনয় মানে শুয়ে আছেন। শুয়ে আছেন মানে চৌদোলায় মড়ার ভূমিকায় শুয়ে আছেন। একেবারে শেষ দৃশ্য। মারা গিয়েছেন সিনেমার লিডিং মোস্ট ক্যারেক্টর, সিনেমার বিবেক। তাকে চুল্লিতে দেওয়া হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। গোটা পরিবার শ্মশানে উপস্থিত হয়ে কাঁদছে। যা টুকটাক ডায়লগ আছে সব পরিবারের বাকি সদস্যদের। বিচিত্রবাবুর কাজ শুধু শুয়ে থাকা। গোটা বডি সাদা কাপড়ে আচ্ছাদিত। শুধু মুখটা অল্প দেখা যাচ্ছে।
আমি গঙ্গার ধারে একটু হেঁটে এসে আবার বসলাম একটা গাছের নীচে। শেষ দৃশ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই অরিজিনাল শ্মশান ঘাটেই শ্যুটিং হচ্ছে। হঠাৎ ‘কাট কাট’ বলে চিৎকার করে উঠলেন ডিরেক্টর।
—ওহ, আপনি এত নড়ছেন কেন? এতবার বলছি খুব ভাইটাল সিন।
সাদা কাপড়ে আচ্ছাদিত বিচিত্রবাবু উঠে বসলেন, ‘কী করব মশা কামড়ায় যে... আর কতক্ষণ ডিরেক্টর মশাই?’
—আপনি শান্ত হয়ে শুয়ে থাকলে তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। নিন শুয়ে পড়ুন। সাইলেন্ট...।
বিচিত্রবাবু আবার শুয়ে পড়লেন মড়ার ভূমিকায়। শ্যুটিং শুরু হল। কিন্তু কিছু সময় যেতে না যেতেই আবার ‘কাট কাট’ বলে চিৎকার করে উঠলেন ডিরেক্টর।
—ওহো, মহা মুশকিলে পড়া গেল তো আপনাকে নিয়ে। শ্যুটের মাঝে উঠে বসলেন কেন?
—গলা শুকিয়ে গেছে। অনেকক্ষণ অভিনয় করছি তো। জল খাব।
—অ্যাই কেউ জল দে।
মাথা থেকে হ্যাট খুলে চুলকাতে শুরু করলেন প্রথমে, তারপর ‘আমিই আনছি জল’ বলে জল আনতে গেলেন ডিরেক্টর। কয়েক মিনিট পর ফিরে এলেন জলের গ্লাস নিয়ে।
—নিন, জলটা খেয়ে নিয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ুন।
আবার নতুন উদ্যমে শ্যুটিংয়ের কাজ শুরু হল। অন্যান্য শ্মশান যাত্রী, নিজেদের মড়া ফেলে শ্যুটিং দেখতে ভিড় করেছে। মড়া পোড়াতে এসে যেন রথ দেখা আর কলা বেচা একসঙ্গে হয়ে গিয়েছে তাদের। আমি লক্ষ করলাম এবার আর বিচিত্রবাবু নড়লেন না, উঠলেনও না। আশপাশে ছড়িয়ে থাকা বাকি বডিগুলোর মতো উনিও পড়ে আছেন চৌদোলা আঁকড়ে।
শ্যুটিং চলতে চলতে আমি আরও এক পাক ঘুরে এলাম গঙ্গার ধারে। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে জল পর্যন্ত। সেখানে অনেক মানুষ গঙ্গার জলে স্নান করে পবিত্র হচ্ছেন। আমি বসেছিলাম সিঁড়ির উপর। আমার নিস্তব্ধতা ভাঙলেন ডিরেক্টরটি, ‘ওহ, অবশেষে কম্পিলিট। হা হা। বাঁচালেন মশাই আপনারা।’ লোকটা বসলেন আমার পাশে।
—বিচিত্রবাবু কোথায়?
—খাটিয়ায় পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছেন। হা হা হা।
নিজের মনে হেসে হেসে বললেন, ‘ওঁর জলে একটু ঘুমের ওষুধ দিয়ে দিয়েছি। এখনও কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকবেন।’ হা হা হা...
—বলেন কী!
—আরে যা উৎপাত শুরু করেছিল আপনার বিচিত্রবাবু। বাধ্য হয়ে...।
আমি উঠে দাঁড়ালাম, ‘তাই বলে ঘুমের ওষুধ...! যদি কিছু হয়?’
—আরে চিন্তা নেই। একটু পরেই ঘুম ভেঙে উঠে বসবেন। আর ফিল্ম লাইনে এমন একটু হয়। ফিল্ম অত সোজা বিষয় নয়।
কিন্তু এরপর ঘটে গেল অন্য একটা কাণ্ড। মূল শ্মশানে গিয়ে দেখি সিনেমার বাকি সবাই যে যার মতো থাকলেও বিচিত্রবাবু নেই! নেই মানে একেবারে চৌদোলা সমেত নেই! খোঁজ পড়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। প্রোডাকশনের লোকজন চারদিকে খোঁজা শুরু করেছেন এরপর। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না চৌদোলা সমেত বিচিত্রবাবুকে। শেষে অন্য একটা শ্মশান যাত্রী দলের একজনের কাছে জানা গেল চার-পাঁচজন মাতাল গোছের লোক তুলে নিয়ে গিয়েছে বিচিত্রবাবুকে চৌদোলায় শুয়ে
থাকা অবস্থায়।
—নিয়ে গেছে মানে!
—হ্যাঁ নিয়ে গেল তো। ওই চুল্লির দিকেই নিয়ে গেল যেন।
‘আরে এতক্ষণ শুটিং হচ্ছিল। দেখে বুঝতে পারেননি উনি মৃত নন। জীবিত মানুষ।’ চিৎকার করে উঠলাম আমি।
—আমরা কী করে জানব। আর জীবিত মানুষ হলে কেউ স্বেচ্ছায় ওই ভাবে দুলতে দুলতে চুল্লিতে গিয়ে উঠবে? ভাবলাম আপনারা মড়া ভাড়া নিয়েছেন হয়তো। শ্যুটিং মিটে গেছে, যাদের জিনিস তারা নিয়ে গেছে।
‘ওহ নো...!’ ডিরেক্টর মাথা চুলকাতে লাগলেন।
‘তবে যাই বলুন। কী ভালো অভিনয় করেছে লোকটা। মরা মানুষকে ফেল করিয়ে দিয়েছে একেবারে। জাত অভিনেতা,’ গামছা গলায় পূর্বের লোকটা গদগদ হয়ে বললেন।
আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে আমরা ছুটলাম চুল্লির দিকে। দৌড়ে দৌড়ে হুড়োহুড়ি করে গিয়ে উপস্থিত হলাম চুল্লি ঘরের ভিতরে। যেমন
ভাবা হয়েছিল ঠিক সেই দৃশ্য। পাঁচজন মাতাল সাদা কাপড়ে আচ্ছাদিত একটি দেহকে শুইয়ে দিচ্ছে অন্তিম
মুহূর্তের জন্য।
আমরা রণসজ্জায় সজ্জিত সৈনিকের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ি তাদের আটকাতে।
—কী হল? কী হল?
—বিচিত্রবাবু...।
—কে বিচিত্রবাবু? উনি আমার মা।
একজন মাতাল গোছের লোক কেঁদে উঠল। তারপর দেহ থেকে কাপড় সরিয়ে দেওয়া হল। না বিচিত্রবাবু নন। তাহলে?
আবার শুরু হল খোঁজ। খুঁজতে খুঁজতে গঙ্গার ধারে শ্মশানের পিছনের দিকে পাওয়া গেল অবশেষে। অন্য একটি মাতালের দল নিয়ে এসেছে এদিকে। কাঠের চিতা সাজিয়ে শোয়ানো হয়েছে বিচিত্রবাবুকে! শুয়ে আছেন নিজের চিতা জ্বলে ওঠার চরম
মূহূর্তের জন্য! মাতালগুলো সেই
চিতা ঘিরে ঘিরে উদ্দাম নৃত্য শুরু করেছে, ‘বল্লো হরি, হরি বোল...
বল্লো হরি, হরি বোল...’ সে এক বিচিত্র দৃশ্য! কিন্তু কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই বিচিত্রবাবুর। যেন জীবন নাটকের শেষ অভিনয় ওঁর!
....
‘নিজের চিতা জ্বালল পিতা’ সিনেমাটা নাকি খুব শীঘ্রই মুক্তি পাবে। যেখানে বিচিত্রবাবু মড়ার ভূমিকায় অভিনয় করে নিজেই মরতে বসেছিলেন। সেই ঘটনাটার কথা মনে পড়লে বিচিত্রবাবু আর আমি এখনও পুলকিত হয়ে উঠি। আর ভাবি কী ভয়ানক পরিণতিটাই হতে যাচ্ছিল সিনেমায় নামতে গিয়ে।