বিদ্যার্থীদের ক্ষেত্রে আজকের দিনটা শুভ। কর্মক্ষেত্রে আজ শুভ। শরীর-স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। লটারি, শেয়ার ... বিশদ
আজ ঘুম ভেঙে দিব্যেন্দু দেখল, সকালটা অন্যরকম।
এখন সকাল নয়, বেলা দশটার কাছাকাছি ছায়াঘন ঘোলাটে দুপুর। মনে হচ্ছে, জানলার রেলিং পেরিয়ে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে আঁকিবুঁকি কাটতে কাটতে। রোজ এই দুপুরে ঘুম ভাঙে, তাই ভোর কাকে বলে কিছুই জানে না দিব্যেন্দু। আকাশে ভোর হয়। সকলে বলাবলি করে, ওটা তার কাছে পাতা কুড়নোর শূন্যতা, ঝরাপাতার।
নতুন মা খাওয়ার পরে গ্লাসে জড়িবুটির কী সব গুঁড়ো মেশায়। সারারাত আচ্ছন্ন ঘুম। ঘোরলাগা বিবশতা। ডাকলেও সাড়া দিতে পারে না। বোধ থাকে। শুধু শরীর কোনও কাজ করে না। সে মানসিক রোগী, তাকে ঘুম পাড়াবার জন্য পির-ফকিরের জড়িবুটি। ওগুলো খুব কড়া, সবসময় অবসাদে রাখে।
সে পাগল নয়, জীবনের বয়স যেখানে পৌঁছেছে, সেটা বছর কুড়ি। রোগাটে ফর্সা চেহারা, এই বয়সেই ঝুরঝুরে জীর্ণতা লেগেছে। ভাঙাচোরা অবয়ব। হারিয়ে গিয়েছে বয়সের আসল বেলা। রোজ রাতে কড়া জড়িবুটির খোরাকে। দু’মুঠো দু’বেলা খেয়ে শুধু বেঁচে থাকা।
ঘরের দরজায় শিকল তোলা থাকে বাইরে থেকে। সে ঘরবন্দি। কাজের মেয়েটা মাঝে মাঝে চা-জলখাবার দেয়। ছুটকো-ছাটকা কথা বলে তখন। নতুন মা আসে না। বাজারে বাবার চালের বড় আড়ত। আড়তদার সবসময় ব্যস্ত, বড় ব্যবসা, লোকজন, খুচরো, পাইকারি দর... তাই আড়তদারের ফুরসত নেই ছেলের কাছে আসার। মাসে দু-তিন দিন দেখা হয়।
দিব্যেন্দু যখন বছর পাঁচেকের, মা চলে গেল ক্যান্সারের অসুখে। বাবার আবার বিয়ে। নতুন বউ, নতুন মা। দুটো ভাইবোন হওয়ার পরে বদলে গেল মা। সবসময় ঝগড়াঝাঁটি, অশান্তি। দূর-দূর গালাগাল। খেতে না দেওয়া, বাবাকে বলে অকারণে মারধর খাওয়ানো।
দশ ক্লাসে পড়ত তখন। স্কুল ছাড়ানো হল। স্কুল পালিয়ে মাঠেঘাটে ঘুরত দিব্যেন্দু ঝোপঝাড় গাছপালার সঙ্গে। জীবনের ছাঁচ হাতবদল, জুড়ে দেওয়ার কেউ ছিল না। মা বেঁচে থাকলে এমনটা হতো না। স্কুল ছাড়ানোর পরে পুরোপুরি ঘরবন্দি। রাঁচির পাগলা গারদে রাখার কথা ছিল। কাজের মেয়ের কাছে শোনা, পাগলা গারদে একবার ঢুকলে মা আর ছাড়িয়ে আনত না। বাবার আর নিয়ে যাওয়ার সময় হয়নি। ওইটুকুই ছিল নিজের মায়ের আশীর্বাদ।
সময়ে-অসময়ে কত ভেবেছে দিব্যেন্দু। জেলখানা এর থেকে ভালো। কত লোকজন থাকে সেখানে। তার ঘরে কেউ নেই, শুধু একা, কেউ আসে না। কাজের মেয়ে সুধা আসে। ঘর ঝাঁট দেয়। দু’বেলা খাওয়ার থালা আনে। ওর পনেরো-ষোলো।
তেমন হাসি, তেমন কথা, তেমন দেহভঙ্গি। সে এলে ভালো লাগে দিব্যেন্দুর। মনে হয়, বেঁচে আছে এই রোগাটে শরীর নিয়ে। বেলা দশটায় ঘুম ভাঙে। এক কাপ চা, দুটো আটার হাতরুটি সঙ্গে আবার জড়িবুটি, নেশার মতো। দুপুরে ডাল ভাত, কোনওদিন মাছের টুকরো। মায়ের ব্যবস্থায় ভাইবোনদের জন্যে বড় মাছের ঝোল, মাংস দু’বেলা। তিন বছর হয়ে গেল, মাংস ভুলে গিয়েছে দিব্যেন্দু। শীতে খেজুর গুড়, পাটালি, মোয়া, আখের গুড় আসে ভাইবোনদের জন্যে। তার ঘরে একটুকরোও ঢোকে না। শুধু দু’বেলা জড়িবুটির কটা বিস্বাদ।
এই রোগটা নাকি নপুংসকদের, বলেছিল সুধা। সেটা কী, জানে না দিব্যেন্দু। মন, শরীর, জীবন সবই তার পঙ্গু। একটা অসাড় জীবন বয়ে চলেছে বোঝার মতন। ভার নেই, কষ্ট আছে। শুধু কষ্ট আর কষ্ট।
কতদিন সে ভেবেছে, পালিয়ে যাবে। যাবে কোথায়? দরজা তো বন্ধ, শিকল তোলা।
এখন ঘরের জানলা খুলল সে। এই দুপুরে কি আর ভোর আছে? সব শূন্য, ওটা কোথাও চলে গিয়েছে। জানলার রেলিং বেয়ে দুপুরের রোদ। ঘরের উল্টোদিকে একটা ছোট ঝিল। ঝিলে কচুরিপানা, পদ্মচাষ। পদ্মপাতায় কালো ডাহুক ঘোরে। পাখিদের কিচিরমিচির, কলরব। সাদা কোঁচাক মাছ ধরার জন্যে ঝিলের ধারে গাছের ডালে বসা। ডালের ছায়া ঝিলের জলে।
ঝিলের ওপারে গাছপালার ফাঁকে ঘরবাড়ি। প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। এখনও সেই খালধার পর্যন্ত মাঠঘাট। ওদিকেই প্রকৃতি থাকে। সেই প্রকৃতি কত খোলামেলা! মাঠঘাট পেরিয়ে দিগন্ত না কী যেন বলে লোকে, আছে। সে ঘরবন্দি, তাই সেই দিগন্তকে চেনা হয়নি। এক কামরার ছোট ঘর। তার আকাশ দুপুর বিকেল। সেখানে দিগন্ত বলে কিছু নেই।
মুখ ধুয়ে এল দিব্যেন্দু। ছোট টেবিলে চা আর দুটো হাতরুটি। সকালে ভাইবোনদের ঘরে মাখন দেওয়া পাউরুটি। শিঙাড়া, জিলিপি, আপেল, কাজু। সুধা জানিয়েছে, ওর বন্দিঘরে এসব ঢোকে না। সুধার চুপচাপ আসা। দু-চারটে কথা।
সেই কথায় কয়েকদিন আগে অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করেছিল সে, ‘কত বছর ভোরের সূর্যটা দেখনি? দেখতে ইচ্ছে করে না?’ ছোট প্রশ্ন, নাড়িয়ে দিয়েছে দিব্যেন্দুকে— তার জীবনের বেলা-অবেলা, বয়স, পুরুষত্ব, ভালোবাসা, দুঃখকষ্ট, নিঃসঙ্গতা, আরও নানা কিছু খুঁটিনাটি।
বার বার ভেবেছে, সত্যি তো ভোর কেমন, কী করে হয়। কখন আসে? তার কাছে ভোর মানে দুপুর। সেখানে কি কোথাও লুকনো থাকে ভোর? দুপুরের পরে বিকেল নামে, তাহলে ভোরবেলাটা কি কোথাও হারিয়ে গেল? প্রকৃতি কি ওটা ছেঁটে ফেলেছে? কোথাও দরকার নেই ওই বেলাটুকুর?
চা খেয়ে অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল। ঘরের দরজা সামান্য খোলা, শিকল তুলতে ভুলে গিয়েছে সুধা। আজ তার মুক্তির দিন। সে আর ঘরবন্দি থাকবে না কয়েদিদের মতো। তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরে নিল। বাইরে এল, অনেক বছর পরে। পাশের ঘরে নতুন মা নেই, কোথাও গিয়েছে। সুধা রান্নাঘরে ব্যস্ত। মাছভাজার গন্ধ।
মায়ের বিছানায় টাকার পার্স। পার্স খুলে কিছু টাকা পকেটে পুরে নিল। নিঃশব্দে সিঁড়ি ভেঙে নামে। তারপর হাঁটা, গলিটা পেরিয়ে গেলেই কাছেই রেলস্টেশন। লোকাল ট্রেনের আনাগোনা। তাড়াতাড়ি একটা ট্রেনে চড়ে গেল সে। কোথায় যাচ্ছে, কে জানে!
ট্রেনের ভেতরে জায়গা পেল। ঘণ্টা দেড়েক পরে ক্যানিং স্টেশন। বাবা আগে একবার তাদের সকলকে নিয়ে সুন্দরবন গিয়েছিল। সব আবছা, তবু মনে পড়ছে। বদলে গিয়েছে ক্যানিং। শহর হয়েছে, আগে শহর ছিল না, ছোট নদীঘাট। লঞ্চ, নৌকো, ভটভটি ছাড়ত, কত দিকের লোকজন।
তারপর একদিন লঞ্চ বন্ধ হল। নদীটার নাম কী যেন... কী যেন... মনে পড়ল— মাতলা। বিশাল নদী, বড় বড় ঢেউ, পারাপারের ব্যস্ততা। নদী দেখলে ভয় লাগে, এপার-ওপার দেখা যায় না।
স্টেশনে পৌঁছতে দুপুর। একটা পাইস হোটেলে ট্যাংরার ঝোলভাত খেল দিব্যেন্দু, কী স্বাদ! বেশ রান্না। সারাদিন ঘুরে বেড়ানো এদিক-ওদিক। সেই চেনা ক্যানিং নেই। ভ্যানরিকশ, অটো। নদী আছে, লঞ্চঘাট আছে, খেয়াঘাট আছে, হারিয়ে গিয়েছে সুন্দরবনে ঢোকার পুরনো ক্যানিং। ওপারে ডকঘাট, ভাঙনখালি, সে সব জায়গাও নাকি বদলে গিয়েছে।
সন্ধের খেয়াঘাটে দিব্যেন্দু। এখন দুপুরের মতো ভিড় নেই। এক মুসলমান মাঝিকে বলল, ‘আমাকে ওপারে নিয়ে যাবে?’ এই নদীর দেশে পারে-ওপারে অনেক বড় কথা। জোয়ার-ভাটা আছে। ছোট-বড় ঢেউ, এ অঞ্চলে চারপাশ জুড়ে নদীর রাজপাট। ওটাই সহচর, নদীচর, ঢেউচর।
হাসল মাঝি, দাড়িতে হাত বোলাল। ‘হেইডা কী কন? আমার কাজ মান্সেরে একবার এপার-ওপার কইরে দেওয়া। হেইডা করতাসি। নৌকোয় উইঠে পড়েন। নে যাব ডকঘাট, ওপারে। কতজনেরে পার কইরে দিসি, আজ আপনারে দেবখন।’
ডকঘাটে নামতে রাত। এখন মাতলা নদী, ক্যানিং। ঢেউতোলা স্রোত সব মিলেমিশে একাকার। ঘাটের কাছে একটা ছোট হোটেল পেল দিব্যেন্দু । খড়োচালের হোটেল, রাতটুকু তো থাকা। হোটেল থেকে দিল গরম ভাত, পুঁইশাকের চচ্চড়ি আর পার্শে মাছের ঝোল। নদীর পার্শে। সুধার হাতের রান্না ভালো, হোটেলের রান্নার স্বাদ আরও ভালো।
কাল ভোরে মাতলায় ভোরের সূর্য দেখবে সে। দশ বছর পর। হিসেব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। ওটা পাঁচ কী দশ বছর মনে পড়ছে না। একটা দুঃখ, সুধা জানতে পারল না, জানলে খুব খুশি হতো। বাড়িতে এতক্ষণ মনে হয়, হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছে। খোঁজ আর খোঁজ।
সে এখানে মাতলার এপারে, একটা ভোরের খোঁজে, এটা কেউ জানেই না।
ভোরেই বেরিয়ে পড়েছে দিব্যেন্দু।
এখন ভাটা, জল নেমে যাওয়া, কাদাচর। একটু পরে জোয়ার আসবে। নদীর বাঁধে দাঁড়িয়ে সে। আকাশে আলো ফুটল। নরম জবাকুসুম আলো। ছোট সূর্য একসময় বড় হল, উজ্জ্বল। ভরে গেল মাতলা নদী সেই লাবণ্যময় আলোয়। কাছে ও দূরের গাছপালা, মাঠজমিন গাঙ্পাখিদের ডাকাডাকি। এ জগৎ কার, প্রকৃতির না মানুষের? সেই দিগন্তটা তাহলে কোথায়?
দিব্যেন্দু কাদা ভেঙে, চর ভেঙে নদীর দিকে নেমে যাচ্ছে। ভোরের সূর্যের আলো মাখা জোয়ারের জল ছুঁয়ে দেখবে সে। আজ আর ঘরবন্দি নয়। নদীর বাঁধে গাঁয়ের এক মেয়েছেলে। জোরে বলে উঠল, ‘বাবু, লাববেন না, জোয়ার আসতেস, ভাইসে নে যাবে, উইটে আসুন গো।’
দিব্যেন্দুর কাছে জল, নদীর পাড় দূরে। কাদার পাঁকে পা ডুবে গিয়েছে। তুলতে পারছে না। আর তখনই ঢেউয়ের প্রচণ্ড ধাক্কা। সে পড়ে গেল নদীতে। জোয়ারে মাতলা নদী ভাসিয়ে নিয়ে চলল।
মেয়েছেলেটা লোকজনকে ডাকছে। কাছাকাছি নৌকোর মাঝিরা ঝাঁপ দিয়েছে দিব্যেন্দুকে বাঁচাতে। পারল না। মাতলা তুলে নিয়ে গেল মাঝনদীতে প্রবল ঢেউ তুলে। বন্যার ঢেউ, ডুবিয়ে দিল।
কত বছর পরে আজ ভোরের প্রথম সূর্য দেখেছিল দিব্যেন্দু।
দেখেই সে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছে, ফিরে পেয়েছে পুরনো জীবনকে, যে জীবনে একবার সে সুধাকে জড়িয়ে ধরেছিল। পূর্ণ হয়েছিল। সুধা বাধা দেয়নি, প্রজাপতির মতো ধরা দিয়েছিল।
আজ চলে গিয়েছে দিব্যেন্দু।
আরও কোনও এক একাকী ভোরের খোঁজে।