বিদ্যার্থীদের ক্ষেত্রে আজকের দিনটা শুভ। কর্মক্ষেত্রে আজ শুভ। শরীর-স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। লটারি, শেয়ার ... বিশদ
জাদু শব্দগুলো হল—‘জাতীয় স্বার্থ’। এরা সঠিকতার সঙ্কেত দেয় না, চূড়ান্ত অবস্থার সঙ্কেত দেয়। কারণ, প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন যে সিদ্ধান্তটি জাতীয় স্বার্থে নেওয়া হয়েছিল। তাই তাঁর প্রত্যাশা ছিল যে সমস্ত সমালোচনা থেমে যাবে এবং যাবতীয় বিতর্কেরও অবসান ঘটবে।
বিজেপি তথা এনডিএ জমানায় কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে গৃহীত সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপগুলির হিসেব নেওয়ার চেষ্টা করছি, দেখছি কতগুলি ক্ষেত্রে তারা জাতীয় স্বার্থের দোহাই দিয়েছিল। তালিকাটি লম্বা ও বিতর্কিত। যতগুলি জোগাড় করতে পারলাম এখানে জানাচ্ছি:
নোট বাতিল এবং জিএসটি
ডিমানিটাইজেশন বা নোট বাতিল করা হয়েছিল জাতীয় স্বার্থে—সরকার বারংবার এই দাবিটাই করেছিল। কিন্তু সমালোচকদের মতে, এটি ছিল একটি বিরাট ভুল এবং তার পরিণাম যা হয়েছিল তা বিপর্যকর। অর্থনীতির ভিতরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ক্ষেত্র হল কৃষি, নির্মাণ শিল্প, খুচরো ব্যবসা-বাণিজ্য এবং স্বনিযুক্তি। এগুলির চালিকা শক্তি হল নগদ টাকা। বাজার থেকে ব্যাপক হারে নগদ টাকা তুলে নেওয়ার কারণে এই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলি বিকল হয়ে পড়েছিল। অতি ক্ষুদ্র (মাইক্রো) এবং ছোট (স্মল) উদ্যোগগুলির মালিকরা বাধ্য হয়েছিলেন তাঁদের ব্যবসার ঝাঁপ বন্ধ করে দিতে এবং তাঁদের অনেকেই আর ব্যবসা-বাণিজ্য নতুন করে শুরুই করতে পারলেন না। সেই সময় কাজ হারানো বহু মানুষ পরবর্তীকালেও কর্মহীন বা বেকার রয়ে গেলেন। নোট বাতিল জাতীয় স্বার্থে না কি জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে করা হয়েছিল সেই মীমাংসাও হয়নি।
সরকারের দাবি অনুসারে, জিএসটি আইনটাও পাস করা হয়েছিল জাতীয় স্বার্থে। একটি সংগত বিতর্ক দেখা দিয়েছিল যে জিএসটি আইনটি আদৌ আটঘাট বেঁধে তৈরি হয়েছিল তো—তাহলে এই কর হারটা নরমসরম (মডারেট) একটিমাত্র করে করা যেত, সেইমতো সফটওয়্যারটাও প্রস্তুত রাখা দরকার ছিল, সংশ্লিষ্ট কর্মী ও অফিসারদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রশাসন-যন্ত্রটাকেও উপযুক্তভাবে তৈরি রাখা জরুরি ছিল। অন্যদিকে, জিএসটি চালু হওয়ার প্রায় বছর দুই বাদে বাস্তবে কী দেখছি আমরা? জিএসটি যতটা সংগ্রহ হবে বলে সরকার ধরেছিল বাস্তবে সংগ্রহের পরিমাণ তার চেয়ে কম। ‘জিএসটি কমপেনসেশন সেস’ যতটা পাওয়া গিয়েছে কেন্দ্রের প্রতিশ্রুতিমতো রাজ্যগুলির ক্ষতিপূরণ করার পক্ষে তা যথেষ্ট নয়। আর ‘রিফান্ড’-এর বিষয়টি সরকার এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে গন্ডগোল বাধার একটি বড় ব্যাপার হয়ে উঠেছে। জাতীয় স্বার্থে জিএসটি থেকে সরে আসা যাবে না (রোল ব্যাক), যে ছকে এবং হারে এখন জিএসটি নেওয়া হচ্ছে সেটাকেও আঁকড়ে থাকা যাবে না জাতীয় স্বার্থে। তাই প্রশ্ন উঠছে, তাহলে দেশের স্বার্থটা কী?
অনুচ্ছেদ ৩৭০ এবং এনআরসি-সিএএ
জাতীয় স্বার্থে ৩৭০ ধারা ব্যবহৃত হয়েছিল ৩৭০ ধারা থেকে মুক্তি দিতেই। যুক্তি দিয়েছিল সরকার। জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যটিকে ভেঙে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরিটাও জাতীয় স্বার্থে। ২০১৯-এর ৫ আগস্ট থেকে উপত্যকাটিকে বিচ্ছিন্ন করে রাখাটা সর্বোচ্চ জাতীয় স্বার্থে (সুপ্রিম ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট)। তিনজন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে বিনা অপরাধে ছ’মাস আটক রাখা এবং তারপর পাবলিক সেফটি অ্যাক্টকে হাতিয়ার করে তাঁদেরকে বিনা অপরাধে আরও অতিরিক্ত দু’বছর আটকে রাখার বন্দোবস্ত—এসব পরম জাতীয় স্বার্থে (প্যারামাউন্ট ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট)। হেবিয়াস করপাস পিটিশনগুলির শুনানি সাত মাসের বেশিকাল আটকে রাখাটাও ছিল জাতীয় স্বার্থ। তালিকাটি দীর্ঘ বটে কিন্তু কাশ্মীরের কেউ এই ব্যাপারে একমত বলে মনে হয় না।
অসমের জন্য জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) তৈরি জাতীয় স্বার্থে। সরকার তাই দাবি করেছিল। সেখানে ১৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৫৭ জনকে ‘বিদেশি’ বা ‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারী’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল জাতীয় স্বার্থে। এঁদেরকে ‘উইপোকা’র সঙ্গে তুলনা করে ২০২৪ সালের ভিতরে ভারতছাড়া করার অঙ্গীকারও করা হল। সেও তো জাতীয় স্বার্থে। ওই তথাকথিত বিদেশিদের মধ্যে ১২ লক্ষাধিক হিন্দু নরনারী আছেন জানার পরই ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের মতো ভয়ঙ্কর কৌশলটা নেওয়া হল, জাতীয় স্বার্থে। খসড়া বিল তৈরি থেকে সংসদে পাস করিয়ে আইনে পরিণত করা পর্যন্ত সময় নেওয়া হল মাত্র ৭২ ঘণ্টা! যে-আইনের সারকথা হল, অমুসলিমরা থাকবেন আর মুসলিমরা চলে যাবেন (অথবা তাঁদের বহিষ্কার করা হবে)—এটা করা হয়েছে সর্বোচ্চ জাতীয় স্বার্থে। জাতীয় স্বার্থে গৃহীত এই সিদ্ধান্তগুলি পুরো দেশটিকেই এক অভূতপূর্ব গোলযোগের মধ্যে এনে ফেলল।
জুবেদা বেগম নামে একজন নিজেকে ভারতের নাগরিক প্রমাণে ১৫টি নথি পেশ করেছিলেন। তার পরেও তাঁর দাবি নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার জন্যে।
রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং বাজেট
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে যাঁরা বলেছিলেন তাঁদের নামে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছিল জাতীয় স্বার্থে। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ আন্দোলন স্তব্ধ করতে লাঠি এবং জলকামান ব্যবহারের পাশাপাশি গুলিও চালানো হয়েছিল। কেবল উত্তরপ্রদেশেই গুলিতে প্রাণ গিয়েছে ২৩ জনের। এসব করা হয়েছিল জাতীয় স্বার্থে। মঞ্চস্থ নাটকে সিএএ-র তির্যক সমালোচনা ছিল। তাই জাতীয় স্বার্থে একজন শিক্ষক এবং একজন অভিভাবককে আটক করা হয়েছিল।
ভোট প্রচারের মিছিলে যোগ দেওয়া মানুষজনকে প্ররোচিত করতে আওয়াজ তোলা হল ‘গুলি মারো’ এবং একজন মুখ্যমন্ত্রীকে বলা হল ‘সন্ত্রাসবাদী’। বলা বাহুল্য, এটাও জাতীয় স্বার্থে। ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করল বিজেপি এবং আপ। জাতীয় স্বার্থরক্ষার্থে এটিকে ‘ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ’ বলে চালানো হল!
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর ১৬০ মিনিটের বাজেট ভাষণ (যদিও অসম্পূর্ণ রেখে যাওয়া হল) ছিল জাতীয় স্বার্থে। কর্পোরেট ট্যাক্সের হারে ছাড় দেওয়ার নামে কয়েকশো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকার খয়রাতি দেওয়া হল, জাতীয় স্বার্থে। রিভাইজড এস্টিমেট বা সংশোধিত হিসেব অনুসারে কৃষি, খাদ্য সুরক্ষা, মিড ডে মিল কর্মসূচি, শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির কর্মসূচি, আয়ুষ্মান যোজনার মতো স্বাস্থ্য পরিষেবা কর্মসূচি প্রভৃতি খাতে ব্যয় বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়াটাও জাতীয় স্বার্থে। ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অর্গানাইজেশনের (এনএসএসও) সেই সমীক্ষাটি চেপে রাখা হয়েছিল, যাতে বেকারত্ব (আনএমপ্লয়মেন্ট) বৃদ্ধি এবং উপভোগ (কনজামপশন) হ্রাসের দুঃসংবাদ ছিল। ওই রিপোর্টে ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে বর্ধিত বেকারত্বের হিসেবটি ছিল ৬.১ শতাংশ এবং উপভোগ হ্রাসের মাত্রাটি ছিল ৩.৭ শতাংশ। এসব করা হয়েছিল ন্যাশনাল ইন্টারেস্টের সেফগার্ডের কথা মাথায় রেখে। দেশবাসীর অন্তরে জাতীয় স্বার্থের চেতনা গড়ে দিতেই স্লোগানও তোলা হয়েছে।
নীরব মোদি, মেহুল চোকসি, বিজয় মালিয়া, যতীন মেহতা, সনদেসারা ভাইগণ এবং আরও কিছু ব্যক্তিকে চুপিসারে দেশ ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়াটা জাতীয় স্বার্থে। ললিত মোদিকে দেশে ফেরানোর ব্যাপারে ব্রিটিশ (ইউকে) সরকারকে চাপ না-দেওয়াটাও জাতীয় স্বার্থে।
জাতীয় স্বার্থের তালিকাটি শেষ হওয়ার নয়। জাতীয় স্বার্থে এত কাঁড়ি সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে সরকারকে ‘ওভারটাইম’ কাজ করতে হচ্ছে। জিডিপি ফুলেফেঁপে উঠছে। আমাদের ভারত পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থনীতির দেশ এবং বিশ্বের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য শক্তিধর হয়ে ওঠাটা শুধু সময়ের অপেক্ষা।