বিদ্যার্থীদের ক্ষেত্রে আজকের দিনটা শুভ। কর্মক্ষেত্রে আজ শুভ। শরীর-স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। লটারি, শেয়ার ... বিশদ
অনেক অভিনেতা, গায়ককে নানারকম সাহায্য করলেও ভানু নিজের বাড়ির লোকের জন্য সাহায্য চাইতে লজ্জা পেতেন। যেমন ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’ ও ‘কাঞ্চনমূল্য’ ছবিতে ভানুর স্ত্রী নীলিমাদেবীর দু’তিনটে গান ছিল। ভানুপুত্র গৌতম বলছিলেন, ‘তবু মা’র নাম ছিল না। না টাইটেলে, না বুকলেটে। অথচ বাবার চেয়ে আগে নাম করেছিলেন মা। স্বাধীনতার পর গভর্নর হাউসে গাইবার জন্য মা আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। বাবা এসকর্ট হিসেবে মা’র সঙ্গে গিয়েছিলেন। ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ ছবিতে অমর পালের গানটির সুর দিয়েছিলেন মা। কিন্তু টাইটেলে মা’র নাম ছিল না। ‘কাঞ্চনমূল্য’ ছবিতে মেন রোল আমি করেছিলাম। কিন্তু ‘ইন্দিরা’ হলে আমার নাম বা ছবি ছিল না। তাই দেখে বসুশ্রীর জোজো কাকা (সুবোধ মুখোপাধ্যায়) বাবাকে বলেছিল ‘ভানুদা, এটা তোর খুব অন্যায়। অন্তত গৌতমের মুড়োর একটা ছবি দিতে পারতি।’ এই কথাই প্রতিধ্বনিত হল মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কথায়। বলছিলেন, ‘আমি যখন রাজ্যের তথ্যমন্ত্রী ছিলাম, তখন সিনেমা লাইনের বহু লোক আমার কাছ থেকে অনেক সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। একমাত্র ব্যতিক্রম ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। উনি অনেকবার আমার কাছে এসেছেন। অনেক সুযোগ-সুবিধাও আদায় করে নিয়েছেন। কিন্তু তার একটাও নিজের জন্য নয়। এই জন্যই ভানুবাবুকে আমি খুব শ্রদ্ধা করতাম। জেনুইন মানুষ। প্রতিবার আমার জন্মদিনে প্রথম ওঁরই ফোন পেতাম।’
‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’ ছবিতে একটা কাণ্ড হয়েছিল। ছবির সুরকার ছিলেন নির্মলেন্দু চৌধুরী। গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। কিন্তু নির্মলেন্দুবাবুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জানা গেল, ‘গঙ্গা’ ছবির গান শিখিয়ে বেড়াচ্ছেন নির্মলেন্দু। সেখানেও এক অবস্থা। সলিল চৌধুরী সুর করে হাজিরা দিতে না পারায় ভার পড়েছে নির্মলেন্দুর উপর। শেষে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গান শিখলেন নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। ‘মা অবশ্য ছোট থেকেই গানের চর্চায়। সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ছাত্রী। অল ইন্ডিয়া রেডিওর গায়িকা, তবু হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তো!’ এখনও যেন ঘোর কাটেনি গৌতমের।
নিছক কৌতুকাভিনেতা নন, একজন পূর্ণাঙ্গ অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিনয় করেছেন প্রায় ৩০০ ছবিতে। আর প্রায় সব ছবিতেই তাঁকে তৈরি করতে হয়েছে কৌতুক। সংলাপ থেকে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে গড়ে নিয়েছিলেন কমেডির নিজস্ব ভুবন। সাদাকালোর সেই পর্দায় যতবারই তাঁকে দেখা গিয়েছে, ততবারই ম্যাজিক দেখেছেন দর্শক। কখনও শার্ট-প্যান্ট, আবার কখনও কেতাদুরস্ত ধুতি-পাঞ্জাবি পরে নিজস্ব কায়দায় দর্শকদের মনোরঞ্জন করেছেন। ‘ভানু পেল লটারি’, ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’ ছবিগুলো যাঁরা দেখেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারবেন যে, অভিনয়ের জোরে তিনি কাঁদাতেও পারেন। অভিনয়শক্তিতে ভর করে এমন কিছু তিনি করেছেন, বহু শিল্পী শত চেষ্টাতেও যা পারেননি। ভানুর লিপে প্লে ব্যাক করেছিলেন শ্যামল মিত্র ‘পুতুল নেবে গো পুতুল’ গানটিতে। ছবির নাম ‘ভানু পেল লটারি’। এই ছবির মতো ‘ভানু গোয়েন্দা জহর এ্যাসিস্ট্যান্ট’ ছবিতেও তাঁর নাম ব্যবহার করে ছবির নামকরণ হয়েছে। এই দৃষ্টান্তও এক জহর ছাড়া আর কোথায়! ভানুর লিপে অসাধারণ গান আরও রয়েছে। ‘স্বর্গ মর্ত্য’ ছবিতে ‘এই মধু রাতে বধূ তুমি কাছে ডাকো’ গেয়েছিলেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। ‘পার্সোনাল এ্যাসিস্ট্যান্ট’ ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছিলেন ‘ক রয়েছেন কলকাতায়’, ‘তোমাদের নতুন কুঁড়ির’, ‘এই বেশ ভালো লাল সাদা কালো’। কিশোরকুমার গেয়েছিলেন ‘সাবরমতী’ ছবিতে ‘তাক ধিন ধিন তা’। এই গানটির সিংহভাগ অবশ্য ছিল উত্তমকুমারের লিপে। ‘আশিতে আসিও না’ ছবিতে মান্না দে গেয়েছেন ‘তুমি আকাশ এখন যদি হতে’, ‘ও ভোলা মন’।
১৯৭৯ থেকেই ভানুর শরীর ভাঙতে শুরু করে। দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছিলেন। সেই অবস্থাতেই ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ করেন। এনলার্জড হার্ট ছিল। তিন-চারবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাওয়ায় শেষ দিকে খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। তারমধ্যে রেনাল ফেলিওর। চলে যাওয়ার এক মাস আগে ভর্তি হলেন নার্সিংহোমে। ডাক্তার তিন মাস রেস্ট নিতে বললেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ছাড়া পেয়েই একবার উত্তরবঙ্গে গিয়ে যাত্রা করে এলেন। ফিরে আসার পর একদিন সকাল থেকে হঠাৎ শুরু হল বমি। ১৯৮৩ সালের ৪ মার্চ। ভর্তি করা হল উডল্যান্ডসে। যাওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে শুয়ে মেয়ে বাসবীকে জিজ্ঞেস করেন, ‘উডল্যান্ডসে একদিনের ভাড়া কত রে?’ গৌতম বলছিলেন, ‘দোতলায় আইসিইউতে ছিল বাবা। ভাই তার সাতদিন আগেই দেশে ফিরেছে ন’বছর পর। ভগ্নীপতির সঙ্গে ও-ই রাত জাগতে হাসপাতালে ছিল। সে রাত আর গড়াল না।’ বারোটা নাগাদ খবর এল ভানু আর নেই। আজীবন আপামর বাঙালিকে হাসিয়ে নিজের শেষযাত্রায় সকলকে কাঁদিয়ে শেষবারের মতো বাড়ির কর্তা ভিটে ছাড়লেন। তাঁর শেষ ছবি ‘শোরগোল’ মুক্তি পেয়েছিল মৃত্যুর এক বছর পরে, ১৯৮৪ সালে।
আড্ডায় বসে ভানু প্রায়ই বলতেন, ‘আমার দশা ক্যামন জানেন। মা মারা গ্যাসে। শ্মশানে গেসি। চোখে জল। একটা লোক কাছে আইয়া কইল, আরে ভানুদা না! কী হইসে? কোনওক্রমে কইলাম, ভাই মা মারা গ্যাসেন। শুইন্যা হালায় হাসতে হাসতে চইল্যা যাইতে যাইতে কইল, দ্যাখ ভানুরে কাঁদলে কেমন লাগে দ্যাখ। বুঝেন একবার। হালায় নিজে যখন শ্মশানে যামু লোকে হয়তো কইবে, ওই দ্যাখ, ভানুর মাথাটা কেমন নড়তাসে।’ নিজেকে কেবল পূর্ববঙ্গীয় নয়, খাস ঢাকার বলেই গর্ব করে পরিচয় দিতেন— আমি বাঙাল। হীনমন্যতা নয়, এই পরিচয় দানে ছিল প্রবল অহংবোধ। অথচ একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এপার বাংলার অনেক গুণী শিল্পী সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নানাসময় ঢাকা গিয়েছিলেন। কিন্তু ভানুকে কেউ ঢাকা নিয়ে যাননি। অবশ্য, পরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গিয়ে তিনি বিটিভিতে একটি অনুষ্ঠানও করেছিলেন। সেই অনুষ্ঠান শেষে আক্ষেপও করেছিলেন, ‘আপনাদের ডাকের অপেক্ষায় বহুদিন ছিলাম। আপনারা কেউ আমাকে ডাকেননি।’ এ লজ্জা কিন্তু সমগ্র বাঙালির। দুঃখের বিষয় হল, মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা ছাড়া কোনও প্রাতিষ্ঠানিক সম্মানই তাঁর ভাগ্যে জোটেনি কোনওদিন। কী আর করা যাবে! বাংলা চলচ্চিত্রের অগণিত দর্শকের অন্তরেই বেঁচে থাকবেন তিনি। স্বমহিমায় চিরকাল।
সন্তানদের সঙ্গে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
অনুচিত্রণ: ভাস্কর মুখোপাধ্যায়
অলংকরণ: চন্দন পাল