সামাজিক কল্যাণকর্মে সামাজিক স্বীকৃতি আর সন্মান। গৃহ পরিবেশে চাপ। আর্থক প্রগতি বজায় থাকবে। ... বিশদ
সদ্যোজাত শিশুর মা-বাবার প্রার্থনা একটাই, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’ কিন্তু সেই সন্তান বড় হয়ে বয়ঃসন্ধির দোরগোড়ায় পৌঁছলে প্রার্থনা হয়ে দাঁড়ায়, আমার সন্তান যেন থাকে নিরাপদে। সন্তানের কেরিয়ার ও স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়ার পাশাপাশি তার আচরণগত সমস্যা নিয়ে কপালে ভাঁজ পড়ে বহু অভিভাবকের। আজকাল প্রায় সব পরিবারই ছোট। বাবা-মা ভিন্ন অন্য কাউকে শিশু তেমন করে কাছে পায় না, যার কাছে সে তার মনের গোপন আগল খুলে দেবে। পেলেও স্বভাবগত কুণ্ঠা থেকে দূরে সরে থাকে অনেকে। ফলে একাকিত্ব থাবা বসায় অজান্তেই। আর তাতেই ঘনায় বিপদ। কেউ মাদকদ্রব্যের শিকার হয়, কেউ নিজস্ব কম্পিউটারে বানিয়ে নেয় অবৈধ কোনও জগৎ। স্কুল-কলেজের সিনিয়র দাদা-দিদি বা বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে বুঁদ হতে পারে নানা অবৈধ ভিডিওতেও।
মনস্তত্ত্ববিদ ডাঃ অমিতাভ মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘আজকাল মা-বাবা তাঁদের মতো করে ব্যস্ত, সন্তানও তার নিজস্ব জগতে ব্যস্ত। কে কখন কী করে বেড়াচ্ছে, কেউই জানতে পারে না। আপাত শান্ত, ভদ্র সন্তানও কখন কোন চক্রে পড়ে মাদকের নেশা শুরু করছে বা অবৈধ ছবি দেখছে, টের পাচ্ছেন না বাবা-মা। এই বয়সে অনেকেই নিছক কৌতূহলের বশে এগুলো শুরু করে। কেউ বা সিগারেট, মাদক এসব নেওয়াকে বড় হওয়ার ‘লাইসেন্স’ হিসেবে ধরে নেয়। কেউ আবার নিজের শরীরের পরিবর্তনকে হালকাভাবে নিতে পারে না। তাদের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি কৌতূহল বাড়ে। কেউ কেউ না বুঝেই শিকার হয় কোনও ফাঁদের। বিশেষ করে নামী স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের রীতিমতো টার্গেট করে মাদক সরবরাহকারী চক্র। তাই বাবা-মা সচেতন না হলে সমূহ বিপদ।’
তাঁর মতে, একটু চেষ্টা করলেই কিন্তু বড় হতে থাকা ছেলেমেয়ের মন বোঝা যায়। কোনও কুসঙ্গ তাঁদের ক্ষতি করছে কি না এটুকু বুঝতে মা-বাবার প্রয়োজন একটু ঠান্ডা মাথা, বুদ্ধি আর সন্তানকে জরিপ করার মতো মন। এই তিন অস্ত্রেই কিন্তু সন্তানের বয়ঃসন্ধিজনিত স্খলন রুখতে পারেন আপনি। অমিতাভবাবু দিলেন নিদান।
কোন কোন লক্ষণে ভয়
• সন্তান খুব ঠান্ডা ও চুপচাপ ছিল। আজকাল কথায় কথায় রাগ দেখায়। বিরক্তি প্রকাশ করে কুৎসিতভাবে। অথবা খুব দুরন্ত, ছটফটে অনর্গল কথা বলতে থাকা সন্তান হঠাৎ কেমন চুপ মেরে যায়। নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে রাখতে চায়। একা একা সময় কাটাতে ভালোবাসে। বেশিরভাগ সময় ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকে।
সবক’টি ব্যবহারই বয়ঃসন্ধিতে স্বাভাবিক। মনমেজাজের পরিবর্তনে বছর কয়েক এমন হতেই পারে। তবে এগুলিকে হালকাভাবে নেবেন না। সতর্ক থাকতে চাইলে কিন্তু সবকিছু নিয়েই ভাবতে হবে। চেষ্টা করুন সন্তানের বিরূপ আচরণ বা বদলে যাওয়ার কারণ খুঁজতে। তার আগে আরও কয়েকটি লক্ষণের দিকে নজর দেওয়া যাক।
• সন্তান কি ঘন ঘন বাথরুমে যাচ্ছে? একবার বাথরুমে গেলে অনেক দেরি করে বেরচ্ছে এবং মোবাইল নিয়ে বাথরুমে ঢুকছে? তাহলে সতর্ক হোন। অনেক ছেলেমেয়েকেই এই সময় অনলাইন গেমসের নেশা পেয়ে বসে। বাথরুমেও তারা গেমস খেলতে থাকে। এটিও কিন্তু বয়ঃসন্ধির আর এক ধরনের নেশা।
• হঠাৎ মনোযাগী ছাত্রের পড়াশোনায় অবনতি ঘটছে। পড়া মনে রাখতে পারছে না। এমন হলে সতর্ক হতে হবে। মাদক নেওয়া শুরু করলে অনেক সময় মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে নানা জটিল খেলা শুরু হয়। তার প্রভাব পড়ে কাজকর্ম ও পড়াশোনায়।
• ঘন ঘন পার্টি করতে যাচ্ছে, নানা অছিলায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে অথবা রাত করে নেশাড়ু চেহারায় বাড়ি ফিরছে। এমন হলে অবশ্যই মনোবিদের সাহায্য নিতে হবে। প্রথম থেকেই শক্ত হাতে রাশ না টানলে পরে সন্তানের নেশার কাছে সব অস্ত্রই ভোঁতা ঠেকবে।
• ছেলেমেয়ের ব্যাগে বা পকেটে সিগারেটের পোড়া টুকরো, দেশলাই ইত্যাদি দেখলে সাবধান হোন। নিছক কৌতূহল বা ভুল করেও এই কাজে সে প্রবৃত্ত হতে পারে। তবে ঘটনাটি আসলে কী, তা না জেনে বিষয়টি হালকাভাবে নেবেন না। এই বিশেষ মুহূর্তগুলোয় সন্তানপ্রেমে অন্ধ হলেও তাদের পুরোটা বিশ্বাস করবেন না। চেষ্টা করুন আড়ালে খোঁজ নেওয়ার।
• ঘন ঘন ফোন বা অনলাইনে সারাক্ষণ চ্যাট করতে দেখলে বিষয়টি খোলসা করে জানুন। এমনকী, হাতখরচের টাকা দিন দিন বেড়ে চলেছে দেখলেও সচেতন হতে হবে।
• কোনও কারণ ছাড়াই হঠাৎ রোগা হয়ে গেলে বা চেহারায় শুষ্কভাব দেখা গেলে সতর্ক হতে হবে। যে কোনও মাদকদ্রব্য শরীরকে শুষ্ক করে।
প্রতিরোধের উপায়
বড় করুন ভালোবেসে: প্রধান ও প্রথম প্রতিরোধ হল ছেলেবেলা থেকেই ওর বড় হওয়ার দিকে খেয়াল রাখা। টাকা বা খেলনা দিয়ে নয়, ওর মন জয় করুন উপযুক্ত সময় দিয়ে। মা-বাবার সঙ্গ, টুকটাক আত্মত্যাগ এগুলোর প্রভাব অনেক। সন্তানকে বুঝতে দিন, ও আপনাদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও আপনারাও ওর সবচেয়ে শুভাকাঙ্ক্ষী। একাকিত্বর স্বাদ যত কম পেতে দেবেন, ততই ভালো। ওকে একটা সহজ, সরল শৈশব দিতে পারলে পরে আর কোনও নজরদারির প্রয়োজন পড়ে না।
শখ তৈরি করুন: সন্তানের সামনে নিজেদের শখের যত্ন নিন। ওর মধ্যেও ভালো বই পড়া, গান শোনা বা বাগান তৈরির মতো গঠনমূলক শখের জন্ম দিন। কোনও গুণ থাকলে তা চর্চা করার সুযোগ দিন। পোষ্য ভালোবাসলে তার সঙ্গে থাকতে দিন। ঠান্ডা মাথায় আলোচনা: শাসনের চোটে সন্তানকে আরও ভুল করার দিকে ঠেলে দেবেন না। চেষ্টা করুন কড়া শাসন বা ভয় দূর করে বন্ধুর মতো বসে আলোচনা করতে। তবে আজকাল অভিভাবকরা বন্ধুর মতো মিশতে গিয়ে এতই বন্ধু হয়ে ওঠেন যে একটা সময়ের পর সন্তান সমীহটুকুও করে না। অভিভাবক ও বন্ধুর মাঝামাঝি চরিত্র হয়ে ওঠার চেষ্টা করুন। ওর সঙ্গে কী ঘটছে, কারা যোগাযোগ করছে, মাদক নিচ্ছে বুঝলে তা কোথা থেকে নিচ্ছে, কে সরবরাহ করছে ও কতদিন ধরে নিচ্ছে, জানার চেষ্টা করুন। মাদক ছাড়ানোর জন্য কাউন্সেলিংয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়।
বন্ধুদের বাড়িতে ডাকুন: বয়সজনিত স্খলন থাক বা না থাক, ওর বন্ধুদের মাঝে মাঝেই বাড়িতে ডাকুন। কোন কোন বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করা হবে সে ভার ওকেই দিন। তাতে কাদের সঙ্গে সন্তান ওঠাবসা করছে, দলে নতুন কে এল এই সব আপনার নখদর্পণে থাকবে।
অনলাইনে নজরদারি: সন্তানের কম্পিউটার বা ল্যাপটপ মাঝেমধ্যেই চেয়ে নিন। প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকলে তার সার্চ হিস্ট্রি আপনারও চোখে পড়বে। কোনও সাইট পাসওয়ার্ড দিয়ে লক করা থাকলে সরাসরি কথা বলুন।
কী করবেন না
সন্তানের খেয়াল রাখবেন, তবে গোয়েন্দাগিরি নয়। আলোচনা ঠান্ডা মাথায় করবেন, উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হলেও সন্তান যেন বোঝে যে আপনি যা করছেন, তা ওর ভালো চেয়েই। আপনারা ওর ব্যবহারে কষ্ট পেলে সেটাও বোঝান। ওকে বাড়ির কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিন বা মতামতে শামিল করুন। ওর গুণের প্রশংসা করুন। এভাবে নিজেকে পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য মনে করবে ও। ফল পাবেন ম্যাজিকের মতো।