সামাজিক কল্যাণকর্মে সামাজিক স্বীকৃতি আর সন্মান। গৃহ পরিবেশে চাপ। আর্থক প্রগতি বজায় থাকবে। ... বিশদ
লড়াই, আন্দোলন, সংগ্রামের জন্য লাগে মেরুদণ্ডের জোর। যুবসমাজ হল রাজনৈতিক দলের শিরদাঁড়া। তরুণরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। যে দলের প্রতি নতুন প্রজন্মের আগ্রহ ও অংশগ্রহণ যত বেশি তার ভবিষ্যৎ তত উজ্জ্বল। যুবসমাজ মুখ ফিরিয়ে নিলে সেই দলের স্থায়িত্ব নিয়েই দেখা দেয় সংশয়। তারুণ্যের উচ্ছ্বাস না থাকলে সেই দল হয়ে যায় বদ্ধ জলাশয়। অস্তিত্ব কোনও রকমে টিকে থাকলেও তা কাজে লাগে না। তাই কেউ ফিরেও তাকায় না।
শত চেষ্টা সত্ত্বেও বাংলার রাজনীতিতে ধর্ম, জাতপাত সেভাবে কখনও থাবা বসাতে পারেনি। তাই ক্ষমতা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বারবার গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে পরিষেবা ও সরকার বিরোধী আন্দোলন। সেইসব আন্দোলনই সাফল্য পেয়েছে, যার নেতৃত্বে ছিল যুব সমাজ। ইতিহাস অন্তত তেমনটাই বলে।
১৯৬০ দশকের মাঝামাঝি সময় বাংলা মুখরিত হয়েছিল একটি স্লোগানে, ‘তোমার নাম আমার নাম/ ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম।’ শুধু রাজনৈতিক কর্মসূচিতেই নয়, সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ফিরত এই স্লোগান। ভিয়েতনাম তখন একইসঙ্গে ফরাসি উপনিবেশবাদ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। তাই ভিয়েতনাম হয়ে উঠেছিল মানুষের আবেগ। সেই আবেগকে সামনে রেখে বামেরা বঙ্গে বাড়িয়ে নিয়েছিল তাদের প্রভাব।
তেমনই এক পরিস্থিতিতে বাংলার ছাত্র রাজনীতিতে পা রেখেছিলেন দুই তরুণ তুর্কি। একজন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, অন্যজন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তাঁদের লড়াইয়ে উত্তাল হয়েছিল বাংলার যুব সমাজ। রাজনীতিতে জন্ম হয়েছিল প্রিয়-সুব্রত জুটির। তাঁদের দুর্বার আন্দোলন কেড়ে নিয়েছিল বামেদের পালের হাওয়া। বামপন্থীদের তখন প্রবল দাপট। তারই মধ্যে ১৯৭১ সালে বাংলার রাজনীতিতে ঘটে যায় দু’টি নজিরবিহীন ঘটনা। ঘটনা না অঘটন, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। তবে, দু’টি ঘটনাই পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়।
সেবার দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি স্বাধীনতা সংগ্রামী গণেশ ঘোষকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। আর মাত্র ২৫ বছর বয়সে অধ্যাপক জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্যকে হারিয়ে বিধায়ক হয়েছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। পরের বছর ফের নির্বাচন হয়েছিল। সেই নির্বাচনে জিতে সুব্রতবাবু হয়েছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মন্ত্রিসভায় তথ্যমন্ত্রী। ১৯৭২ থেকে ’৭৭ সাল পর্যন্ত বাংলার কংগ্রেস শাসন ছিল ঘটনাবহুল। দেশে জারি হয়েছিল জরুরি অবস্থা।
ইন্দিরা গান্ধীর জারি করা ‘কালা কানুন’কে হাতিয়ার করে বাংলার দখল নিয়েছিল বামেরা। তবে, সেক্ষেত্রে আন্দোলনের চেয়েও গুরুত্ব পেয়েছিল রাজনৈতিক কৌশল। জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্তর মতো নেতারা তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। তবে, আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, শ্যামল চক্রবর্তী, সুভাষ চক্রবর্তীর মতো নেতারাও। সেই সময় তাঁরা ছিলেন সিপিএমের নতুন প্রজন্ম। অথচ ক্ষমতায় বসে তাঁরাই বেমালুম ভুলে গেলেন নতুন প্রজন্ম তৈরির কথা।
প্রায় সাড়ে তিন দশক বাংলাকে শাসন করেছে বামেরা। এই সময়কালের মধ্যে প্রচুর ছাত্র ও যুবক বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। তাঁদের অনেকের সাংগঠনিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা পূর্বসূরিদের থেকে কোনও অংশে কম ছিল না। তা সত্ত্বেও নতুন মুখ তৈরি হয়নি। বলা ভালো, সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্ব সেটা চায়নি। ক্ষমতা হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে তাঁদের উঠতে দেয়নি। তাই আশিতে পৌঁছেও বিমান বসুকে এখনও হাঁটতে হয় বামেদের মিছিলে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন যাদবপুরে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়েছিলেন তখন তিনি যুব কংগ্রেসের নেত্রী। তাঁর একের পর এক আন্দোলন নড়িয়ে দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকারের ভিত। কংগ্রেসের মধ্যে থেকেও সিপিএমের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই ছিল আপসহীন। তাই তিনি হয়ে উঠেছিলেন লড়াইয়ের মূর্ত প্রতীক। তিনি তৃণমূল না গড়লে বামেদের ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড গড়ার আসল কারণটা প্রকাশ্যে আসত না। তাঁর জন্যই উদ্ঘাটিত হয়েছিল ‘সেটিং’ রহস্য।
ঘোষণার আগে পর্যন্ত কেউ ভাবতেও পারেননি নবজোয়ারের মতো একটা ম্যারাথন কর্মসূচি তৃণমূল নিতে পারে। বিরোধীরা প্রথম দিকে অভিষেকের এই কর্মসূচিকে কোনও গুরুত্বই দিতে চাইছিল না। কেউ নাক সিঁটকে ছিলেন, কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন খরচ নিয়ে। অনেকে ভেবেছিলেন, মাঝপথেই রণে ভঙ্গ দেবেন অভিষেক। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে তার উল্টো। ইডি তাঁকে ডাকার পর নবজোয়ার কর্মসূচির জনজোয়ার কার্যত তুফানে পরিণত হয়েছে।
এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য পঞ্চায়েত ভোটের জন্য ‘মানুষের প্রার্থী’ খুঁজে বের করা। তারজন্য বুথ থেকে জেলা স্তরের নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন। প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য নেওয়া হচ্ছে ভোট। তা নিয়ে কোথাও কোথাও বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। সবাই ভোট দিতে পারছে না। কোনও কোনও গোষ্ঠী ব্যালট পেপার কেড়ে নিচ্ছে। ভোটিং সিস্টেম নিয়ে সমালোচনার আরও অনেক জায়গা আছে। এখনও লক্ষ লক্ষ মানুষ ভোট দেন স্রেফ প্রতীক চিহ্ন দেখে। প্রার্থীর নাম তাঁরা পড়তে জানেন না। কিন্তু এই ভোটে ব্যালট পেপারে প্রার্থীর নামের পাশে টিক দিতে হচ্ছে। ফলে নিরক্ষররা থেকে যাচ্ছেন প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়ার বাইরে।
খুঁজলে এমন ত্রুটি হয়তো আরও বেরবে। কিন্তু তাতে তৃণমূলের উদ্দেশ্যটা মিথ্যে হয়ে যাবে না। প্রতিটি কর্মসূচিতেই আছড়ে পড়ছে যুবকদের উচ্ছ্বাস। রোড শোয়ে বয়ে যাচ্ছে জনস্রোত। অভিষেক যেখান দিয়ে গিয়েছেন প্রতিটি রাস্তার ধারে মানুষের লম্বা লাইন। জনসভায় মহিলাদের বিপুল উপস্থিতি প্রমাণ করে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের প্রভাব এখনও অটুট। তবে, এসব দেখে কেউ বলতেই পারেন, সবটাই ‘অর্গানাইজড’। পেশাদারি সংস্থার সাজানো চিত্রনাট্য। তাহলেও একটা কথা মেনে নেওয়া ভালো, ডিসিপ্লিনের প্রশ্নে যে কোনও দলকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য তৈরি তৃণমূল। তা না হলে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাজার হাজার মানুষকে দাঁড় করিয়ে রাখা অসম্ভব।
নবজোয়ার কর্মসূচিতে সমালোচনাযোগ্য ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনই ধরা পড়ছে মনে জায়গা করে নেওয়ার মতো কিছু ছবিও। কোথাও অভিষেককে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন অসহায় নিঃসন্তান মা। কোথাও প্রতিবন্ধী যুবক রাস্তায় বসে শোনাচ্ছেন তাঁর কষ্টের কথা। তবে অনেকে বলছেন, এর মধ্যে একটি ছবি খুবই অর্থবহ। বছর দু’য়েকের ছোট্ট শিশুকে কাঁধে নিয়ে হেঁটে চলেছেন অভিষেক। সামনে ও পিছনে অগনতি মানুষের মিছিল। কতটা পথ পেরলে তবে পথিক হওয়া যায়, সেটা জানা নেই। তবে, রাজনীতিতে এভাবেই মজবুত হয় নতুন প্রজন্মের ভিত।
লড়াইয়ের সিঁড়ি বেয়ে নবান্নের চোদ্দতলায় পৌঁছেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই নতুন মুখের গুরুত্ব ও প্রয়োজনটা তিনি জানেন। সেই কারণে বামেরা যে কাজটা সাড়ে তিন দশকেও করতে পারেনি, সেটাই তিনি শুরু করে দিয়েছেন।
‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর তৃণমূল দলটা উঠে যাবে’, এমন প্রচার বিরোধীরা শুরু করে দিয়েছিল জোরকদমে। উদ্দেশ্য ছিল, তৃণমূল দলের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সংশয় সৃষ্টি করা। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হলে সবাই ‘নৌকা’ ছেড়ে পালাতে চায়। সেটা রাজনৈতিক দলই হোক বা প্রতিষ্ঠান। ‘নবজোয়ার’ হল তৃণমূলের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরির গেমপ্ল্যান ভেস্তে দেওয়ার মোক্ষম ‘মাস্টারপ্ল্যান’।