কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীর ঈর্ষার কারণে সম্মানহানি হবে। ব্যবসায়ীদের আশানুরূপ লাভ না হলেও মন্দ হবে না। দীর্ঘ ... বিশদ
একটা আনুমানিক হিসেবে দেখা যাচ্ছে কমপক্ষে ১৬টা। তারমধ্যে চারটি হয়েছে ভারতের বাইরে। দুটি পাকিস্তানে, দুটি বাংলাদেশে। সঠিক হিসেবে এর থেকে বেশি সংখ্যকও হতে পারে। অথচ মজার কথা হল, শরৎচন্দ্র তাঁর এই উপন্যাসটিকে নিতান্ত কাঁচা কাজ হিসেবেই গন্য করতেন। এমনকী তাঁর সমবয়সী মামা সুরেন যখন ভাগলপুর থেকে উপন্যাসটির পান্ডুলিপি ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় পাঠিয়েছিলেন প্রকাশের জন্য, তখন সে খবর পেয়ে শরৎচন্দ্র ভারতবর্ষ পত্রিকার কর্ণধার প্রমথ ভট্টাচার্যকে চিঠি লিখে উপন্যাসটি প্রকাশ না করার অনুরোধ পর্যন্ত করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘... ওটার জন্য আমি নিজেও লজ্জিত।’ সম্ভবত সে চিঠি প্রমথবাবু যখন পান তখন আর সময় ছিল না। ভাগ্যিস ছিল না! না হলে নরেশ মিত্তির, প্রমথেশ বড়ুয়া, বিমল রায় থেকে শুরু করে হাল আমলের সঞ্জয় লীলা বনশালি, অনুরাগ কাশ্যপ থেকে ব্রাত্য বসু পর্যন্ত তাঁদের জীবনের অন্যতম সেরা একটি কাজ করা থেকে বঞ্চিত হতেন। বিখ্যাত হত না দিলীপকুমারের সেই সংলাপ—কৌন কামবখ্ত বরদাস্ত করনেকে লিয়ে পিতা হ্যায়...!
উল্লেখ্য, দেবদাসের মঞ্চ স্বাঙ্গীকরণও হয়েছে। অতি সম্প্রতি এই ২০১৮ সালে মুম্বইয়ের এজিপি ওয়ার্ল্ড নামে একটি সংস্থা হায়দর হাসান সফির পরিচালনায় হিন্দিতে ‘দেবদাস’ অবলম্বনে একটি মিউজিক্যাল প্রযোজনা করে। এছাড়া গত শতকের তিনের দশকের শেষাশেষি মিনার্ভা থিয়েটারে নিয়মিত অভিনয় হতো ‘দেবদাস’ নাটক। জহর গঙ্গোপাধ্যায় ও সরযূবালা দেবী অভিনয় করতেন যথাক্রমে দেবদাস ও পাবর্তীর ভূমিকায়। অনেক পরে দিলীপ রায় ও সুমিত্রা মুখোপাধ্যায় জুটি বেঁধে ‘দেবদাস’ নাটকটি করতেন ওয়ান ওয়াল থিয়েটার হিসেবে। পরিচালক ছিলেন দিলীপ রায়ই (সূত্র: ডঃ শঙ্কর ঘোষ)। এতসব সালতামামি যে কারণে তা হল, সম্প্রতি দমদম ব্রাত্যজন ফের মঞ্চে এনে হাজির করেছে শরৎচন্দ্রের দেবদাসকে। তবে এ দেবদাস হুবহু শরৎচন্দ্রের স্বাঙ্গীকরণ নয়। এ হল দেবদাসের বিনির্মাণ।
এখানে একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, কী এমন আছে এই উপন্যাসে যে বারেবারে যুগে যুগে এটিকে নিজেদের মতো করে বলতে চেয়েছেন বিভিন্ন মাধ্যমের শিল্পীরা। সম্ভবত দেবদাসের ট্র্যাজেডিই এই উপন্যাসের মূল আকর্ষণ। দেবদাসের করুণ পরিণতিতে দর্শক কিংবা পাঠকের মনে যে দুঃখবোধ জন্ম নেয়, তা তার বাস্তব জীবনের দুঃখকে অনেকটাই লাঘব করতে পারে। যাকে ইংরেজিতে বলে ক্যাথারসিস। তাই এই উপন্যাস এতটা জনপ্রিয় এবং শিল্পীরা বারে বারে একে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। যার শেষতম উদাহরণ হল দমদম ব্রাত্যজনের ‘দেবদাস’।
এ নাটকেও কাহিনীর পটভূমি বদলে, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বদলে, চরিত্রের মনস্তত্ব বদলে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যার মূল কারিগর ব্রাত্য বসু।
অনুরাগ কাশ্যপ তাঁর দেবদাসের বিনির্মাণ ‘দেব ডি’ সম্পর্কে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘... আমাদের সমাজ কোনও ছেলে খারাপ পথে গেলে সমাজ তাকেই দোষ দেয়। কিন্তু সমস্যাটা আসলে ছেলেটার নয়। সে ছেলেটি দুর্বলচিত্তের, সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। তার দরকার ভালোবাসার, নির্ভরতার আর নৈতিক জোরের... । সমস্যটা আসলে ব্যক্তির নয়, সমাজের।’ ব্রাত্যর বিনির্মাণেরও মূল সুরটি সেই তারেতেই বাঁধা। নাটকের অন্তিমপর্বে দেবদাস তার অভিভাবকদের উদ্দেশে বলে, ‘তোমার কেউ আমার কথা একটুও ভাবলে না। আমার জেদ, রাগ, অভিমান এগুলোকেই বড় করে দেখলে। একবারও ভাবলে না আমি কতখানি অসহায়। এই এতবড় পৃথিবীতে তোমরা আমাকে একেবারে একলা করে দিলে! কেউ তো আমার হাতটা ধরতে পারতে। জানো তো আমি একলা চলতে পারি না। আমার ভয় করে।’
অনুরাগও তাঁর ছবিতে এই হাত ধরার ব্যাপারটাকেই বোঝাতে চেয়েছেন। দিগভ্রষ্ট মানুষকে হাত ধরে সঠিক পথে চালনা করতে পারে তার নিকটজন, আত্মীয়বন্ধু এবং সমাজই। দোষ দিয়ে দূরে ঠেলে দেওয়াটা দায়িত্ব এড়ানোরই শামিল।
এইভাবে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের মূল সুরটিকে ব্রাত্য অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। উপন্যাসে শরৎচন্দ্র দেবদাসের করুণ পরিণতির জন্য সমাজকেই দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন। ব্রাহ্মণের ছেলের সঙ্গে কায়েতের মেয়ের বিয়েতে আপত্তি তুলেছিল দেবদাসের বাবা-মা। দেবদাস সেই সামাজিক অন্যায়ের প্রতিবাদ করে রুখে দাঁড়াতে পারেনি। ফলে হতাশ পার্বতী অন্য জায়গায় বিয়েতে রাজি হয়। আজ সে যুগ নেই। স্বাভাবিক কারণেই ব্রাত্যর দেবদাসে দু’জনে বিয়ে না হওয়ার কারণ হিসেবে আমদানি করতে হয়েছে একটি খল চরিত্রকে। সে ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে দেবদাস ও পার্বতীর মধ্যে ফাটল ধরায়। দেবদাসও আগুপিছু বিচার না করে পার্বতীকে দোষী ঠাউরে তাকে ত্যাগ করে—দুর্বলচিত্ত, অস্থিরমতি মানুষের যা স্বভাব! ব্রাত্যর নাটকে দেবদাসের মৃত্যু হয় না। অন্তিমপর্বে সে আর চন্দ্রমুখী বারোতলার ফ্ল্যাটে ভবিষ্যতের স্বপ্নের ফানুস ওড়ায়। বহিরঙ্গে অর্থাৎ পোশাক আসাকে নাটকটিকে ব্রাত্য শরৎযুগে ধরে রাখলেও এর প্রেক্ষাপট আধুনিক। ব্রাত্যর নাটকে দেবদাসের বাবা একজন প্রোমোটার, তিনি মোবাইলের টাওয়ার বসানোর ব্যবসাও করেন। মাঝে মাঝেই সংলাপে এসেছে ‘জিও’ শব্দটি। কলকাতায় যাওয়ার আগে দেবদাস পার্বতীকে মোবাইলের সিম দিয়ে যায়। বলে, এই সিম থেকে তাকে ফোন করতে। চন্দ্রমুখী চুণীবাবুর কাছে জানতে চায়, তাদের পেশায় কবে জিএসটি চালু হবে। দু’ হাজার টাকার নোট ব্যান হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করে তারা। সঙ্গে আছে হিন্দি ও বাংলা ছায়াছবির প্রচুর জনপ্রিয় গান। গানগুলি সুপ্রযুক্ত। এটি ব্রাত্যর সিগনেচার। এর আগেও অনেক নাটকেই জনপ্রিয় হিন্দি গানকে প্রয়োগ করেছেন তিনি। নাটক চলতে চলতে মাঝে মাঝেই দেখা যায় পুলিসের এনকাউন্টারে একজন করে মারা যায়। কে এরা? দেবদাসের প্রশ্নের জবাবে চুণীবাবু ঠোঁট উলটে বলে যে সে জানে না। দেশের সাম্প্রতিক জ্বলন্ত অবস্থার কথা মনে পড়ে যায় দর্শকের!
দেবদাস আদতে ট্রাজেডি হলেও এই নাটকটি নাচে, গানে চোখা সংলাপে জমজমাট। এক মুহূর্তও দর্শককে সিটে হেলান দিতে দেবে না।
টুকরো টুকরো দৃশ্যে আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকেও ব্যঙ্গের কষাঘাতে জর্জরিত করেছেন ব্রাত্য। নাটকের শেষলগ্নে মঞ্চে দুটি গ্লো-সাইন বোর্ড দেখা যায়। একটিতে লেখা ‘ইন্দ্রনাথ সিং ও প্রদীপ কাজোরিয়া নিবেদিত... বায়োপিকে দেবদাস, প্রান্তিক চৌধুরীর ছবি’। অপরটিতে লেখা ‘যশপাল মেহতা ও প্রদীপ বাজোরিয়া নিবেদিত গোয়েন্দা দেবদাস, প্রান্তিক চৌধুরীর ছবি’। উল্লেখ্য এই নাটকটির অন্তপ্রনর প্রদীপ মজুমদার। বিনির্মাণ সম্ভবত ব্রাত্যর প্রিয় বিষয়। এই বিষয়ে তাঁর দক্ষতা প্রশ্নাতীত। যাঁরা তাঁর ‘হেমলাট—দ্য প্রিন্স অব গরাণহাটা’ নাটকটি দেখেছেন তাঁরাই একবাক্যে সে কথা স্বীকার করবেন। ‘দেবদাস’-এও ব্রাত্য তাঁর সেই দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন।
দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন অভিনেতারাও। দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন দেবদাসের ভূমিকায় সুমিতকুমার রায়, পাবর্তীর ভূমিকায় দেবলীনা সিংহ ও চুণীবাবুর ভূমিকায় সুমন্ত রায়। এছাড়া চন্দ্রমুখীর চরিত্রে ভালো লাগে দেবযানী সিংহকেও। এ নাটকের সব থেকে বড় সম্পদ দলগত নৈপুণ্য। মঞ্চে একসঙ্গে গোটা পনেরো চরিত্র ঘোরাফেরা করেছে অনেক দৃশ্যে। কিন্তু তাল কাটেনি একবারও। তেমনি ভালো পৃথ্বীশ রানার মঞ্চ ও আলোর পরিকল্পনা। আপ স্টেজের মধ্যিখানে একটি আয়তঘনাকার অংশকে ব্যবহার করা হয়েছে কখনও বিয়ের বাসর, কখনও দেবদাস, কখনও পার্বতীর বাড়ি আবার কখনও বার হিসেবে। দিশারী চক্রবর্তীর আবহও দারুন। নাট্যরূপ দিয়েছেন সুদীপ সিনহা, পরিচালনা প্রান্তিক চৌধুরী। সব মিলিয়ে বাংলা রঙ্গমঞ্চের সেরা আকর্ষণ হতে চলেছে ‘দেবদাস’।