সন্তানের দাম্পত্য অশান্তিতে মানসিক চিন্তা। প্রেম-প্রণয়ে বিশ্বাস ভঙ্গ ও মনঃকষ্ট। ব্যবসার অগ্রগতি। ... বিশদ
মোবাইলের প্রতি ভীষণ আসক্ত বুবুলও। তবে গেম নয়, তার ঝোঁক জীবজন্তুর প্রতি। অ্যানিমাল লাইফ সংক্রান্ত সব অনুষ্ঠান, ডকুমেন্টারি ইত্যাদি একেবারে কণ্ঠস্থ তার। এদিকে ইতিহাসের তারিখ মুখস্থ করতে খাবি খায়! বাবা মায়ের বারণ অমান্য করে লুকিয়ে ফোন দেখা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে তার।
মোবাইল আসক্তি এখন ঘরে ঘরে বাচ্চাদের মধ্যে বাড়ছে। বিহেভিয়ারাল থেরাপিস্ট এবং মনোবিদদের মতে এই যুগে মোবাইল ‘নেসেসারি ইভিল’। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় জিনিস অথচ তা মারাত্মক নেতিবাচক। আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে মোবাইল বা সেই ধরনের বৈদ্যুতিন যন্ত্রের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া আমাদের উপায় থাকে না। অথচ তার লাগামছাড়া ব্যবহারে বাচ্চাদের বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি হয়ে যায়। তাহলে বাচ্চার মোবাইল আসক্তি দূর করতে বাবা মা কী করবেন?
চাইল্ড সাইকোলজিস্ট রমেশ গোয়েল জানালেন, এই নিয়ে দেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন গবেষণা হয়েছে ও হচ্ছে। সেইসব থেকে প্রমাণিত যে, শুধুমাত্র বাচ্চারাই নয়, অনেক বয়স্কও মোবাইলের প্রতি আসক্ত। কিন্তু বয়স্করা পরিণত ও সচেতন। তাই তাঁরা নিজেদের এই অভ্যাস থেকে চাইলে বিরত থাকতে পারেন। বাচ্চাদের সেই ক্ষমতা থাকে না বলেই বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্ষতি মনোযোগের অভাব। ব্রেন কোনও একটা জিনিসের উপর বেশিক্ষণ স্থিরভাবে আটকে থাকে না। মনোযোগের স্থায়িত্ব তিরিশ সেকেন্ড থেকে দেড় মিনিটের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। এছাড়া চোখেরও প্রচণ্ড ক্ষতি হয়। দৃষ্টি দুর্বল হয়ে যায়, অনেকের অতিরিক্ত মোবাইল বা বৈদ্যুতিন যন্ত্র নির্ভরতার ফলে চোখ খারাপ হয়, চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়ে, ড্রাই আই-এর সমস্যা দেখা দেয়।
এখন প্রশ্ন হল বাচ্চার মোবাইলের প্রতি আসক্তি রোধ করবেন কী করে? এক্ষেত্রে বিহেভিয়ারাল থেরাপিস্ট ডাঃ অঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, এই বিষয়ে গবেষণার পর ইউরোপের মডেলে একটি ‘পেরেন্ট ট্রেনিং প্রোগ্রাম’ তাঁরা চালু করেছেন আমাদের দেশেও। বাবা-মায়েদের ট্রেনিং দিয়ে বাচ্চার মোবাইল নির্ভরতা দূর করা হয়। বাচ্চার বয়স ভেদে এই ট্রেনিংয়ের ধরন ভিন্ন। একেবারে শিশু বয়সে বাচ্চা যদি মোবাইলের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে, খাওয়া থেকে ঘুম সবসময়ই যদি তার মোবাইল ফোনের প্রয়োজন হয় তাহলে বাবা মাকে ফোন কেড়ে নিতে হবে। বাচ্চার কান্না, রাগ, দুঃখ ইত্যাদিতে ভুললে চলবে না। এই নিয়ে বাচ্চার সঙ্গে কোনও আলোচনাতেও তাঁরা যাবেন না। ফোনের সঙ্গে তার সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে হবে। প্রথম কিছু সপ্তাহ কান্নাকাটি থেকে খাওয়া বন্ধ, জিনিস ভাঙচুর সবই হতে পারে। কিন্তু বাবা মা শক্ত হলে ক্রমশ বাচ্চা এই আসক্তির কথা ভুলে যাবে।
কিন্তু বাচ্চার বয়স যদি বারো, পনেরো হয় তখন তার মোবাইল অসক্তি ছাড়াতে বাবা মাকে বিশেষভাবে সক্রিয় হতে হবে। এই সংক্রান্ত গবেষণা থেকে কয়েকটা উপায়ের কথা উঠে এসেছে।
প্রথমত বাচ্চার সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতে হবে। বাবা মা বাচ্চার সঙ্গে বসবেন এবং তার মোবাইল নির্ভরতা ও সেই থেকে হওয়া ক্ষতি বিষয়ে তাকে বোঝাবেন। কাজটা একদিনের নয়। প্রতিদিন নিয়ম করে বাচ্চাকে বোঝাতে হবে। তার মোবাইল ব্যবহারের সময়সীমাও বেঁধে দিতে হবে। বাবা মা যখন বাড়িতে থাকবেন না, তখন বাড়ির অন্য কেউ বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করবেন।
ফ্যামিলি টাইম বের করা ভীষণ জরুরি। এমন একটা সময় যখন বাবা মা বাচ্চা এবং বাড়ির অন্যান্যরা একে অপরের সঙ্গে সময় কাটাবেন। দিনে অন্তত আধঘণ্টা এই ফ্যামিলি টাইমের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে। তখন কেউ টিভি দেখবে না, ফোন করবে না, কম্পিউটার দেখবে না, শুধুই একে অপরের সঙ্গে কথা বলবে, সারা দিনের ঘটনা শোনাবে এবং তা নিয়ে আলোচনা, গল্প ইত্যাদি করবে।
খাবার টেবিলে ফোনের ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে। বাচ্চা এবং বড় কেউই খাবার সময় ফোন ব্যবহার করতে পারবে না।
বাচ্চার ঝোঁক অনুযায়ী তার জন্য কিছু অ্যাক্টিভিটি তৈরি করে দিতে হবে। এবং সেগুলোরও সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে। বাচ্চার যদি গান-বাজনার প্রতি ঝোঁক থাকে তাহলে তাকে সেই সংক্রান্ত কাজে নিবিষ্ট রাখতে হবে দিনের কিছুটা সময়। সে যদি
আঁকতে ভালোবাসে তাহলে আঁকার দিকে তাকে ঠেলে দিতে হবে।
পড়ার সময় বাঁধা থাকবে। সারাদিন অল্প অল্প পড়লাম, বাকি একটু উঠলাম, একটু গল্প করলাম, টিভি দেখলাম, ফোন দেখলাম— এই রুটিন রাখা যাবে না। নির্দিষ্ট সময় বাচ্চার পড়ার জন্য নির্ধারিত থাকবে এবং সেই সময় সে পড়ার বই ছাড়া অন্য কিছুতেই মন দিতে পারবে না। এই মনিটরিং বাবা অথবা মা করলে সবচেয়ে ভালো। বাচ্চা টিউশন ক্লাসে পড়লেও রোজকার হোমওয়ার্ক, টিউশনের পড়া, স্কুলের কাজ ইত্যাদি বাবা মাকে নিয়ম করে দেখতে হবে।
রাতে বাচ্চার শোওয়ার সময় ফোন বা ট্যাবলেট বা অন্য কোনও বৈদ্যুতিন যন্ত্র তার বিছানায় রাখা চলবে না। তার জন্য মান অভিমান, মন কষাকষি হতে পারে। কিন্তু বাবা মা শক্ত হাতে ব্যাপারটার মোকাবিলা করবেন।
বাচ্চাকে যে অভ্যাস করাচ্ছেন, সেটা বাবা মাকেও মেনে চলতে হবে। অর্থাৎ বাচ্চাকে ফোন ব্যবহার করতে বারণ করে নিজে সারাক্ষণ ফোন দেখলে কিন্তু হিতে বিপরীত হবে। ফ্যামিলি টাইম, খাওয়ার সময় ফোন বন্ধ— এই নিয়মগুলো বাড়ির সবাই মেনে চললে তবেই শিশুর মোবাইল আসক্তি রোধ করা যেতে পারে।
সাইকোলজিস্ট এবং বিহেভিয়ারাল থেরাপিস্টরা একটা বিষয়ে একমত, বাবা মাকে শক্ত হতে হবে। শিশু থেকে টিনএজ বাচ্চার মেজাজ, ক্ষোভ, জেদ ইত্যাদির জন্য তৈরি থাকতে হবে। তাহলেই বাচ্চার মোবাইল নির্ভরতা কমবে।