সন্তানের দাম্পত্য অশান্তিতে মানসিক চিন্তা। প্রেম-প্রণয়ে বিশ্বাস ভঙ্গ ও মনঃকষ্ট। ব্যবসার অগ্রগতি। ... বিশদ
বাঙালি নাকি ডাক্তারি ও ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া কিছুই ভাবে না। বাংলার বাইরের রাজ্যগুলি সর্বভারতীয় স্তরে আমলা হওয়ার পরীক্ষা নিয়ে যেটুকু সচেতন, এই বঙ্গ ততটা নয়। বাংলার এই বদনাম গত কয়েক বছর ধরে খুব ধীরে ধীরে মুছছে। সুযোগ ও পরিকাঠামোরও খানিকটা উন্নতি হয়েছে। বাংলা থেকে প্রায় ১৫-১৬ জন পরীক্ষার্থীর নাম রয়েছে চূড়ান্ত তালিকায়। তার মধ্যে রাজ্য সরকার পরিচালিত ইউপিএসসি কোচিং সেন্টার থেকে উঠে এসেছেন ৭ জন। অশোকনগরের ব্রততী দত্ত ও শ্রীরামপুরের অনুষ্কা সরকার তাঁদের মধ্যে অন্যতম সেরা। র্যাঙ্ক যথাক্রমে ৩৪৬ ও ৪২৬। দক্ষিণবঙ্গের মেয়েদের সাফল্যে একপ্রকার নজির গড়লেন এঁরা। প্রস্তুতির খুঁটিনাটি ও ‘সিভিল সার্ভেন্ট’ হওয়ার ইচ্ছে ‘চতুষ্পর্ণী’-র সঙ্গে ভাগ করে নিলেন ব্রততী ও অনুষ্কা।
বাঙালি তো এই ধরনের পরীক্ষা খুব একটা দেয় না! আপনারা দু’জনেই হঠাৎ এই পরীক্ষাকে বাছলেন কেন?
ব্রততী: আমি যে খুব সচেতন হয়ে এই পরীক্ষাকে বেছেছিলাম এমন নয়। যখন স্নাতকের পড়াশোনা করছি, তখনই বুঝতে পারি, আমাকে দ্রুত ও ভালো চাকরি পেতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে প্রশাসনিক কাজে আমার আগ্রহ ছিল। আরও উচ্চতর পড়াশোনা করে অ্যাকাডেমিক দিকে যাওয়ার মতো রেজাল্টও ছিল। তাই খানিক দোটানায় পড়ে যাই। কিন্তু অ্যাকাডেমিক পথটা অনেক দীর্ঘ। তাই ঠিক করি অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসেই চেষ্টা করব।
অনুষ্কা: আমার ক্ষেত্রে গল্পটা একটু আলাদা। আমি তখন রাউরকেল্লা এনআইটি-তে পড়ি, তখন আমি যে হস্টেলে থাকতাম, সেখানে থাকতেন ইউপি-র এক শিক্ষার্থী। তিনি ইউপিএসসি-র প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাঁর মুখ থেকেই প্রথম ইউপিএসসি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি। ভালো লাগতে শুরু করে। তখনই শুরু করি প্রস্তুতি।
আপনাদের পড়াশোনা কোথায় ও বিষয় কী?
ব্রততী: আমি ক্লাস সিক্সে বাণীপুরের জওহর নবোদয় বিদ্যালয়ের অ্যাডমিশন টেস্টে বসি। সেখানে হস্টেলে থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পাশ করার পর আমি এগ্রিকালচার নিয়ে বিশ্বভারতীতে পড়াশোনা করি। তখনও অবধি জানতাম, অ্যাকাডেমিক দিকেই যাব। মাস্টার্স করার বড় সুযোগ আসে ওড়িশা ইউনিভার্সিটি অব এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে।
অনুষ্কা: আমি ছোটবেলায় সেন্ট জোসেফ’স কনভেন্ট, চন্দননগরে পড়তাম। লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে ভূগোল নিয়ে বিএসসি করেছি। রাউরকেল্লা এনআইটি থেকে মাস্টার্স। তবে পড়াশোনা আমার কাছে নেশার মতো। আমি এমন অনেক বিষয়েই ছোট ছোট কোর্স করে রেখেছি যেগুলো হয়তো আপাতদৃষ্টিতে সরাসরি পড়াশোনার অঙ্গ নয়। যেমন আমি এই মুহূর্তে একটা জিআইএস-এর ক্লাস করছি। এটা কোনও ডিগ্রি বা ডিপ্লোমার জন্য নয়, জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন শিখছি বিষয়টা নিয়ে আগ্রহ আছে বলে। ইদানীং জিআইএস ব্যবহার করে সরকারি নানা স্তরে কাজ করা হয়। নির্দিষ্ট কোন অঞ্চলে জনঘনত্ব বেশি বা কোথায় কোভিড হানা বেশি হয়েছে ইত্যাদি জানতে
এটি কাজে লাগে।
দু’জনেই একটি ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হলেন কেন? নিজে পড়ে কি এই পরীক্ষায় সুযোগ পাওয়া যায় না?
ব্রততী: অবশ্যই যায়। তবে সিলেবাস সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। যেহেতু একটা বড় সিলেবাস, প্রচুর বিষয়, তাই কী পড়ব, কতটুকু কীভাবে পড়ব এটা জানতেই আমি মূলত কোচিং নিয়েছিলাম। তাছাড়া আমি সায়েন্স পড়েছি। ইতিহাস, পলিটি, ভূগোল এগুলো নিয়ে আলাদা গাইডেন্স দরকার ছিল। প্রথম বছর একেবারে একা পড়ে আমিও পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তবে হাতে সময় কম থাকায় তখন আমি ততটা তৈরি হওয়ার সুযোগ পাইনি। সিলেবাসটা একবার বুঝে গেলে একাও পড়া যায়। আমার ফাউন্ডেশন কোর্স আমি একাই করেছি। অনেকেই একেবারে একা প্রস্তুতি নিয়ে আমার চেয়েও ভালো ফল করেছেন। এখানে ভর্তি হলে একই কমিউনিটির অনেকজনকে পাওয়া যায়। এটাও কিছুটা উৎসাহ দেয়।
অনুষ্কা: যেহেতু সিলেবাসটা বড়, আর সেভাবে কিছুই জানি না, তাই ভর্তি হয়েছিলাম এখানে। এখানকার মক টেস্ট, ‘ডাউট ক্লিয়ারিং ক্লাস’ এগুলো থাকায় বিষয়টিকে বুঝতে সুবিধা হয়েছে। ইন্টারভিউয়ের সময় এই সেন্টার থেকে খুব উপকার পেয়েছি। তবে একা পড়েও সম্ভব। ইদানীং ইউটিউব, টেলিগ্রামে ইউপিএসসি-র নানা ফ্রি টিউটোরিয়াল আছে। সেগুলো থেকেও পড়াশোনা ভালো করেই করা যায়। আমরা দু’জনেই সেসবের সাহায্যও নিয়েছি।
এই পরীক্ষা দিতে গেলে কি ভীষণ মেধাবী হতে হয়?
ব্রততী: একেবারেই নয়। তবে হ্যাঁ, কিছুটা মাথা পরিষ্কার হওয়া দরকার। পড়াশোনা দীর্ঘদিন চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো ধৈর্য দরকার। অধ্যবসায় তো অবশ্যই প্রয়োজন।
অনুষ্কা: নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকতে হবে। ব্যর্থতায় ভেঙে পড়লে হবে না। আমি এর আগে তিন বার ব্যর্থ হয়ে চারবারের বার পেলাম। হয়তো ২০২৫-এও আবার বসব, যাতে র্যাঙ্ক আর একটু ভালো হয়।
এই সাফল্যের নেপথ্যে মূল কার উৎসাহ বেশি ছিল?
ব্রততী: বাবা-মা সবসময়ই উৎসাহ দিয়েছেন। সেন্টারের স্যার-ম্যাম সকলেই খুব উৎসাহ দেন।
অনুষ্কা: বাবা-মা তো বটেই, তবে আমার প্রিয় চারপেয়ে ভাই পুচকাই আমাকে খুব সঙ্গ দিয়েছে। আমি যত রাত অবধি পড়তাম, ও আমার পাশেই বসে থাকত। মানসিক জোর পেয়েছি ওর থেকে।
যাঁরা ভবিষ্যতে এই পরীক্ষা দেবেন বলে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাঁদের কী বলবেন?
ব্রততী ও অনুষ্কা: প্রতিটা বিষয়ের গভীরে গিয়ে বিষয়টি জানতে হবে। পড়তে হবে সময় বের করে। অনেকে চাকরি করতে করতে বা স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের পড়াশোনার সঙ্গে এই প্রস্তুতি চালান। তাঁদেরও টাইম ম্যানেজমেন্ট জানতে হবে। নিজের ভুল থেকেই শিক্ষা নিতে হবে। মক টেস্ট বেশি করে দিতে হবে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এসব কয়েকটা বছর ভুলে থাকতে পারলে আখেরে লাভই হবে। মেধা নয়, অধ্যবসায় ও পরিশ্রমই এই পরীক্ষায় সুযোগ পাওয়ার শেষ কথা।