সন্তানের দাম্পত্য অশান্তিতে মানসিক চিন্তা। প্রেম-প্রণয়ে বিশ্বাস ভঙ্গ ও মনঃকষ্ট। ব্যবসার অগ্রগতি। ... বিশদ
২০১৮ সালের জুন মাসে আমার তৃতীয় সন্তান হয়। সদ্যোজাতকে নিয়ে আনন্দে আত্মহারা সবাই। গরমে সবাই মিলে ছুটি কাটাতে বেড়াতে যাব। আমিও প্রথমে খুব উচ্ছ্বাসে ছিলাম। কিন্তু সেই গ্রীষ্মের পুরো সময়টাই অন্ধকার বেডরুমে কাটিয়েছিলাম। বিষাদ, দুশ্চিন্তা আর অবসাদে ভরা সব দিন। পরিবার, বন্ধু-সহকর্মী কারও সঙ্গে দেখা করা এবং চাকরিতে আবার যোগ দেওয়ার কোনও ইচ্ছেই ছিল না আমার। কল্পনাশক্তি, চিন্তন ক্ষমতা ক্রমে যেন হারিয়ে যাচ্ছিল। দীর্ঘ হতাশা এবং দুশ্চিন্তা টেনে এনেছিল অনিদ্রা। সারাদিন অবসাদগ্রস্ত হয়ে কাঁদতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। জুলাইয়ের এক নিদ্রাহীন রাতে হঠাৎ আমার মনে হল মাথার উপর ঘুরতে থাকা ফ্যানটা যেন আমাকে বলছে তোমার সন্তানরা ঘুমোচ্ছে, ওদের গায়ে আগুন লাগিয়ে দাও, গোটা বাড়িকে জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও তোমার সদ্যোজাতকে! প্রতিনিয়ত এইসব ধ্বংসাত্মক চিন্তা এমন তোলপাড় করছিল আমায়। সেই রাতেই আমার হঠাৎ মনে হয়েছিল রান্নাঘরের ড্রয়ারে দেশলাই বাক্সটা আছে কি না, দেখে আসি। চূড়ান্ত হতাশায় দিশেহারা হয়ে স্বামীকে বলেছিলাম, আমার হাতটা ছেড়ো না। এর পরবর্তী দু’মাস মানসিকভাবে আমি আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। মাত্রাতিরিক্ত রাগ, অস্থিরতা, মানসিক বিভ্রম এবং দুশ্চিন্তা ক্রমশ বাড়তে থাকে। চোখ বুজলেই দেখতে পেতাম আমার সন্তানদের হিংস্র কোনও পশু বুঝি বা আক্রমণ করছে, কখনও বা দেখতাম সন্তানরা চলন্ত গাড়ির চাকায় পিষ্ট হচ্ছে। কী ভয়ঙ্কর সেসব দৃশ্য! পরে মনোরোগ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে বুঝলাম আমি পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন অর্থাৎ প্রসবোত্তর বিষণ্ণতায় আক্রান্ত। এই অবসাদকে পোস্ট ন্যাটাল ডিপ্রেশনও বলে। শিশুকে জন্ম দেওয়ার পরবর্তী কিছু দিন ভয়ঙ্কর মানসিক অবসাদ, বিভ্রম, ধ্বংসাত্মক চিন্তার সাক্ষী হতে হয় আমার মতো অনেক মাকেই...।’
২০২০ সালের ১৯ মার্চ নেভাডা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজিত সভায় এই দীর্ঘ বক্তব্যটি রাখেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডা অঞ্চলের অভাবী শিশুদের পঠন-পাঠনে সাহায্যকারী সংস্থা ‘রেজিং হার্ট’-এর প্রধান কার্যনির্বাহিকা আয়ুর্বান হ্যারিসন।
প্রায় সব সংস্কৃতিতেই মাতৃত্বকে মনে করা হয় নারীর জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার। কিন্তু কখনও কখনও মাতৃত্বের সীমাহীন আনন্দ পেরিয়েও তৈরি হয় বিষণ্ণতা। প্রসবের পর মায়ের মানসিক আবেগের অবিচল উথালপাথাল নিয়ে আসে এক অদম্য অবসাদ। যার স্থায়িত্ব প্রসব পরবর্তী এক বা দু’সপ্তাহ থেকে প্রায় এক মাস বা এক বছর পর্যন্ত। সীমাহীন উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, বিষাদ, অবিরাম কান্না, নিদ্রাহীনতা সমন্বিত এই মারাত্মক অবসাদকে বলা হয় প্রসবোত্তর বিষণ্ণতা।
এই অবসাদ মায়েদের মনকে কমবেশি প্রভাবিত করতে সক্ষম। পৃথিবীর প্রায় ৩০ থেকে ৭৫ শতাংশ সদ্য-মা প্রসবের পরবর্তী সপ্তাহখানেক বিরক্তিকর মানসিক অবস্থা, বিষণ্ণতা, দুশ্চিন্তা, খাবারে অনীহা ও অনিদ্রার শিকার হন যা ‘বেবি ব্লুজ’ তথা প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতার প্রাথমিক প্রভাব রূপে পরিচিত। কখনও এই সব উপসর্গ এক মাস বা এক বছর ব্যাপী মাতৃমনকে আক্রান্ত করে। প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মহিলা এই অবস্থার শিকার হন
মা হওয়ার পর। পরিসংখ্যানগতভাবে ৫০০ থেকে ১০০০ জনের মধ্যে একজন মায়ের প্রসবোত্তর অবসাদ চূড়ান্ত পর্যায় দেখা দেয়, যার ফলে তাঁর পোস্টপার্টাম সাইকোসিস-এ জর্জরিত হওয়ার সম্ভাবনাও জন্মায়। যাতে অলীক কল্পনা ও মানসিক বিভ্রমে আবিষ্ট হয়ে আত্মহননের প্রবণতা তৈরি হয়। এই অবস্থায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মা সদ্যোজাতকে হত্যা করতেও উদ্যত হতে পারেন।
২০২০ সালের ২১ জানুয়ারি ব্রিটেনের এক সংবাদমাধ্যম ইংল্যান্ডের চেস্টারফিল্ড শহরের বাসিন্দা ৩১ বছর বয়সি ল্যরাকে নিয়ে খবর করে। কন্যাসন্তান প্রসবের পরবর্তী প্রায় ১৪ দিন মানসিক দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা, নেতিবাচক কল্পনা ও চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিলেন ল্যরা। এর মধ্যেই একদিন তাঁর স্বামী ড্যান ও একমাত্র কন্যাসন্তানকে নিয়ে বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষায় যাচ্ছিলেন। চালকের আসনে ল্যরা। হঠাৎ তাঁর মনে হল কোনও অশুভ শক্তি তাঁদের ধাওয়া করছে এবং তিনজনের মধ্যে কাউকে আলাদা করতে চায় সেই অশুভ শক্তি! বিভ্রমে আবিষ্ট ল্যরা ব্যস্ত রাস্তায় অতর্কিতে গাড়ির গতি অস্বাভাবিক বাড়িয়ে তাঁর স্বামী ও সদ্যোজাত কন্যাকে নিয়ে মৃত্যুমুখে এগিয়েই যাচ্ছিলেন প্রায়। কোনওক্রমে ড্যান গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করেন এবং মেয়েকে নিয়ে চলন্ত গাড়ির বাইরে আসতে সমর্থ হন। কিন্তু মানসিক অস্থিরতায় জর্জরিত ল্যরা ফের গাড়ির গতি বাড়িয়ে আত্মহননে উদ্যত হন। ড্যানের নিরলস চেষ্টায় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পান তাঁরা। জিজ্ঞাসাবাদের পর পোস্টপার্টাম সাইকোসিস-এ আক্রান্ত ল্যরা বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর পর আমাদের কেউ পৃথক করতে পারবে না, আমি আগে মারা গেলেও ওদের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করব।’ এই মর্মান্তিক ঘটনার পরবর্তী দু’সপ্তাহ ইংল্যান্ডের নটিংহ্যামশায়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। এখন ল্যরা সুস্থ।
বিজ্ঞানীদের মতে, প্রসব-উত্তর দশায় রক্তে স্টেরয়েড হরমোন অর্থাৎ ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন ও কর্টিসলের মাত্রা গুরুত্বপূর্ণভাবে কমে যায়। এছাড়াও থাইরয়েড ও অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি নিঃসৃত হরমোনগুলির পরিমাণগত বৈষম্য মাতৃশরীরের হাইপোথ্যালাসাস— পিট্যুইটারি অ্যাড্রিনাল কর্টেক্স অক্ষকে প্রভাবিত করে মানসিক বিষাদ তৈরি করে। গবেষণালব্ধ তথ্য অনুযায়ী,
রক্তে অক্সিটোসিন হরমোনের পরিমাণগত অভাব মায়ের দুশ্চিন্তা বাড়ায় এবং শিশুর প্রতি যত্ন কমিয়ে দেয়। প্রসবোত্তর বিষণ্ণতা সারিয়ে তুলতে সাধারণত সিটালোপ্রাম, ফ্লুওক্সেটিন, প্যারোক্সেটিন প্রমুখ সেরাটোনিন পুনঃশোষণ রোধক ওষুধ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। যদিও এই সমস্ত ড্রাগ দীর্ঘদিন অথবা উচ্চমাত্রায় ব্যবহার করলে সদ্য মায়ের মাথাব্যথা, ডায়ারিয়া, নাসারন্ধ্রের জ্বলন, অনিদ্রা ও স্নায়বিক দুর্বলতা প্রভৃতি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। মনোবিদরা মনে করেন ড্রাগ প্রয়োগের পরবর্তী সময়ে উপযুক্ত সাইকোথেরাপি প্রসবোত্তর অবসাদ দূর করতে পারে। আক্রান্ত মাকে আত্মীয়দের মধ্যে রাখা, তাঁর মানসিক অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা, তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতা বাড়ানো এবং তাঁকে পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে শামিল করা ইত্যাদিও গুরুত্বপূর্ণ। এতে সদ্য মায়ের আত্মবিশ্বাস, চিন্তন ক্ষমতা, কল্পনাবোধ ও আত্মনির্ভরতা বাড়ে।
আর একটি দিক হল আধ্যাত্মিকতা। দ্য স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্কের গবেষক রবার্ট কিফ জানান, প্রসবোত্তর বিষণ্ণতার শিকার ৩০ জন মহিলার মধ্যে আধ্যাত্মিকতার প্রভাব বোঝার চেষ্টা করা হয়েছিল। ওই মহিলাদের বক্তব্য অনুযায়ী, প্রসব পরবর্তী অবসাদ নির্মূল করার ছ’টি প্রধান সমাধান সূত্র— দুশ্চিন্তা নিরসন, নিজেকে মূল্যবান ভাবা, নিঃসঙ্গতা দূর, অলীক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন, পারিবারিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করা এবং নিজেকে আহত করা থেকে সদা বিরত থাকা। এই ছ’টি সমাধান তাঁরা খুঁজে পান কীভাবে? জানা যায়, নিয়মিত ঈশ্বর অনুধ্যানে। নিয়মিত গির্জায় যেতেন এমন এক মা বলেছিলেন, ‘প্রতি রবিবার চার্চ থেকে বের হওয়ার সময় আমি নতুন উদ্যমে বাড়ি ফিরি।’ ধর্মীয় সঙ্গীত তথা প্রার্থনায় শামিল এক মা তাঁর অবসাদময় দিনের কথা জানাতে বলেন, ‘আমি যখনই ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতাম, তখনই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতাম, তাঁর সঙ্গে কথা বলতাম, আর আমার বিষণ্ণতা দূর হতো।’ ঈশ্বরের প্রতি অবিচল আনুগত্য যেন তাঁদের আশাহীনতা, দুশ্চিন্তা এবং মানসিক অসহায়তা লাঘবের শ্রেষ্ঠ প্রয়াস। আর এক মা জানান, ‘আমি প্রতিদিন গির্জায় আসি দুশ্চিন্তা সঙ্গে নিয়ে। ঈশ্বরকে তা দিতে পারি। তিনি আমার মনকে হাল্কা করেন।’ পোস্টপার্টাম সাইকোসিস-এ আক্রান্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করতে এক মহিলা বলেন, ‘প্রতিনিয়ত ভয়ঙ্কর অলীক দৃশ্য কল্পনা করতে করতে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম, নিয়মিত ঈশ্বর আরাধনার পর আমার উপলব্ধি হয় যে, মাতৃত্বের অধিকারিণী হয়ে নিজেকে রক্তাক্ত করলে বা হত্যা করলে ঈশ্বরের কাছে আমি ক্ষমার অযোগ্য। তাঁর প্রতি নিরন্তর প্রার্থনাই আমাকে মানসিক শান্তি দেয়।’
প্রসবোত্তর বিষণ্ণতার ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তা, নিরন্তর হতাশা এবং মর্মান্তিক পরিণতি দূর করতে নিয়মিত ঈশ্বরের অনুধ্যানে উন্মোচিত হতে পারে আধ্যাত্মিক চেতনা, বাস্তববোধ এবং সৃজনশীল চিন্তার প্রবাহ।