সন্তানের দাম্পত্য অশান্তিতে মানসিক চিন্তা। প্রেম-প্রণয়ে বিশ্বাস ভঙ্গ ও মনঃকষ্ট। ব্যবসার অগ্রগতি। ... বিশদ
এই পরিস্থিতির দায় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরী কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারেন না। ‘অধীরের কারণেই বাংলায় ভাঙন ইন্ডিয়ায়’ মমতার পাশে দাঁড়িয়ে সাফ দুষেছিলেন আপ সুপ্রিমো কেজরিওয়ালও। অধীরের এই জোট-বিরোধী অবস্থানকে কংগ্রেস হাইকমান্ড যে কোনোভাবেই সমর্থন করেনি, তা অনেকদিন ধরেই টের পাওয়া যাচ্ছিল। প্রথম বোঝা গিয়েছিল, এবছর জানুয়ারির শেষদিনে রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো ন্যায়যাত্রা’র উপর রাজনৈতিক ‘হামলা’র প্রেক্ষিতে কংগ্রেস নেতৃত্বের নীরবতায়। অধীরের অভিযোগ ছিল, রাহুলের কর্মসূচি বিহার থেকে বাংলায় প্রবেশের পরই, মালদহের গ্রামে আক্রান্ত হয়। ইট মেরে ভেঙে দওয়া হয় নাকি তাঁর গাড়ির পিছনের কাচ! অধীরের অভিযোগের তির স্পষ্ট ছিল তৃণমূলের দিকেই, ‘বুঝে নিন কে ভাঙতে পারে?’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘যত রকমের বিরোধিতা করা যায়, হয়েছে। কোচবিহার থেকেই এই অসহযোগিতার শুরু।’ কংগ্রেসকে সরকারি অতিথিশালা কিংবা স্টেডিয়াম বরাদ্দ নিয়েও ‘বঞ্চনা’র প্রসঙ্গ তোলা হয়। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা এই যে, রাহুলের গাড়িতে ‘হামলা’র ঘটনার অব্যবহিত পরই কংগ্রেস মুখপাত্র জয়রাম রমেশ একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেন। কিন্তু অধীরের অভিযোগ নিয়ে সেখানে একটিও শব্দ খরচ করেননি তিনি! এমনকী, তাঁর বক্তব্যের শেষে জয়রাম মাইকটা যাঁকে এগিয়ে দেন, সেই কানাইয়া কুমারও উচ্চবাচ্য করেননি প্রসঙ্গটি নিয়ে। তিনি বরং বেকারত্ব এবং অন্যান্য জ্বলন্ত সমস্যার নিরসনে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে মোদি ও বিজেপির মুণ্ডপাত করেন।
বলা বাহুল্য, তৃণমূল কংগ্রেস দাবি করেছিল, ওই ঘটনার সঙ্গে রাজ্যের শাসক দল এবং বাংলার কোনও সম্পর্ক নেই। রাহুলের গাড়িতে অপ্রীতিকর, অবাঞ্ছিত তেমন কিছু ঘটে থাকলে তা ঘটেছে তিনি বাংলায় প্রবেশের আগেই। কিন্তু তারপরও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল এবং প্রশাসনকে দোষারোপ করার ব্যাপারে অনড় ছিলেন অধীর। দুধ আর জল দ্রুত আলাদা হওয়ার পরও, দুঃখ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি তাঁকে। তবে সব মিলিয়ে, কংগ্রেস হাইকমান্ডের ধারাবাহিক নীরবতায় অধীরের বক্তব্যই খারিজ হয়ে যায় সেদিন এবং দিল্লির সিলমোহর পড়ে মমতার জোট আন্তরিকতার উপর। দলের লোকসভার নেতার পাশে দাঁড়িয়ে, মমতার সঙ্গে রাজনৈতিক দূরত্ব বৃদ্ধিতে হাইকমান্ড কতটা নারাজ, তার প্রমাণ মেলে অধীরের নির্বাচনী প্রচার সভায় জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতিতে! সোনিয়া, রাহুল, প্রিয়াঙ্কা দূর—দলের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গেও আসেননি নিয়মরক্ষার্থে। এই জিনিস অতীতে কখনও ঘটেছে বলে মনে পড়ে না।
পরে অধীর শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চাইলেও রাজনৈতিক মহলের সামনে যা আলগা হয়ে যাওয়ার তা হয়ে গিয়েছিল তখনই, এবং গুছিয়েই। সাধারণ মানুষেরও ঝুঝতে যেটুকু বাকি ছিল সেটুকু পরিষ্কার করে দিলেন গত শনিবার খাড়্গে স্বয়ং। মুম্বইতে মিডিয়ার প্রশ্নের জবাবে তিনি জানিয়ে দেন, মমতা ইন্ডিয়া শিবিরেই রয়েছেন। সিদ্ধান্ত নেওয়ার কেউই নন অধীর। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এবং হাইকমান্ডই এই ব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেবেন। এরপরই অধীরের নাম না-করে তিনি শোনান আরও কর্কশ বার্তা, ‘সেই সিদ্ধান্ত যাঁরা মানতে পারবেন না, তাঁরা দল ছেড়ে বেরিয়ে যান।’ কংগ্রেস হাইকমান্ড এটাও পরিষ্কার করে দেন, মমতা ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম প্রধান কাণ্ডারী। এই জোটের ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনা প্রতি দফা ভোটগ্রহণের পর বেড়ে যাচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দলকে গুরুত্বপূর্ণ আসন দিয়েই যে সোনিয়া গান্ধীর পার্টি আগামী মাসে নতুন সরকার গড়ার ব্যাপারে আন্তরিকভাবে প্রস্তুত হচ্ছে, ঘটনা পরম্পরা থেকে নিশ্চিত রাজনৈতিক মহল।
উনিশের ভোটে বিজেপি (৩৭.৩৬ শতাংশ), এমনকী এনডিএ (৪৫ শতাংশ) আহামরি ভোট না-পাওয়া সত্ত্বেও মোদিকে ‘অভাবনীয় সাফল্যের জাদুকর’ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন অনেকে। কিন্তু বিজেপি জানত, সেই ‘সাফল্য’ আদৌ মোদির ছিল না, তিনি অট্টহাসিতে যে ফসল দু’হাতে গোলায় ভরেছিলেন তা ছিল স্রেফ কংগ্রেস নেতৃত্বের সীমাহীন ব্যর্থতা এবং বিরোধী অনৈক্যের দান। তাই মাস দশেক আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে ও পরিকল্পনায় ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স’, সংক্ষেপে ‘ইন্ডিয়া’ মহাজোট তৈরি হতেই ‘মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল’ অবস্থা হয় বিজেপির। ‘ইন্ডিয়া’ নামটির কী সাংঘাতিক আতঙ্ক মোদিকে গ্রাস করেছিল, তা সারা দুনিয়া চাক্ষুষ করেছে গত সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে। যে-দেশকে এই গ্রহের সকলে ‘ইন্ডিয়া’ নামে চেনে, তাদের সামনে তুলে ধরা হল শুধু আমাদের ‘ভারত’ পরিচয়! সেই শুরু, বিরোধীদের মহাজোটকে নস্যাৎ করার জন্য অতঃপর ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটি মুখে নিতেই তীব্র অ্যালার্জির প্রকাশ দেখালেন মোদিবাবুরা, দিনরাত দুরমুশ চলছে ‘ইন্ডি’কে!
বোঝাই যায়, বিরোধী নেতৃত্বের মধ্যে স্বয়ং মোদির এক নম্বর চক্ষুশূল নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলার ‘দিদি’—রাহুল গান্ধী বা মল্লিকার্জুন খাড়্গের নামেও তিনি এবং তাঁর বাজনদাররা সিঁদুরে মেঘ দেখেন না। হ্যাটট্রিকের পথের কাঁটার ‘বদনাম’ করে যাওয়ার প্ল্যানটা তাঁদের তাই শুরুর দিনের, ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণার আগেই। ইস্যু হিসেবে ‘দুর্নীতি’র সলতে পাকানো চলেছে উনিশে রামধাক্কা খাওয়া থেকেই। এবারের ভোটের আগে নয়া সংযোজন ‘সন্দেশখালি’—মানে নারীর অপমানের মতো অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। মোদি-শাহ-যোগীদের সৌজন্যে সন্দেশখালি এখন ন্যাশনাল ইস্যু! কিন্তু ক্যালেন্ডারের পাতা ৪ জুনের দিকে যত গড়াচ্ছে, তত ফিকে হয়ে আসছে দেশে ‘চারশো পার’ কিংবা ‘বাংলায় ৩৫ উইকেট’ তুলে নেওয়ার গপ্পো। একদিকে, ভুরু কুঁচকে দিচ্ছে ভোটের নিম্নমুখী হার, অন্যদিকে, মিলেছে আন্দোলনরত কৃষকদের ‘বিজয় জমায়েত’-এর জব্বর প্রস্তুতির খবর!
এই অবস্থায় কারও পক্ষেই মাথা ঠিক থাকার কথা নয়, তিনি নরেন্দ্র মোদি হলে তো মোটেই নয়। তাই ভাষার ব্যবহারে অসংযম বাড়ছে প্রতিদিন। ১৬ মে, সুদূর ইউপিতে আজমগড়ের মঞ্চ থেকেও মমতাকে লক্ষ্য করে বাণ নিক্ষেপ করেছেন মোদি, ‘কোই মাঈ কা লাল সিএএ বাতিল করতে পারবে না!’ সপার অখিলেশ যাদবকে কটাক্ষ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘উনি এখন পশ্চিমবঙ্গ থেকে নতুন ‘বুয়া’ আমদানি করেছেন, যে-টিএমসি ইউপির বাসিন্দাদের বাংলায় ‘বহিরাগত’ বলে তার নেত্রী তিনি!’
বিজেপি ‘রেউড়ি’ সংস্কৃতিকে দু’বেলা ধুয়ে দিয়েছে দীর্ঘকাল। এমনকী মুফতে সরকারি অর্থ বিতরণ বন্ধে একদিন আইন তৈরিরও ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। আমরা জানি, গরিব এবং পিছিয়ে পড়া শ্রেণিকে উপরে টেনে তুলতে মমতার সরকার কতখানি দরাজ। মোদিবাবুদের ক্রোধটা সেখানেই। বিনাপয়সায় চাল খেয়ে, মাসে মাসে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ঘরে তুলে এবং কৃষক ভাতা, কন্যাশ্রী, রূপশ্রীতে লাগাতার উপকৃত হয়ে বাংলার মানুষের এমন ‘বদঅভ্যাস’ হয়ে গিয়েছে যে তাঁরা মমতার বাইরে কারও দিকেই তাকান না। তাই সেই মোদি এবং তাঁর পার্টি মত বদলে ক্রমে আস্থা বাড়িয়ে চলেছেন আবর্জনার স্তূপে নিক্ষিপ্ত রেউড়িতেই। গত বিধানসভার ভোটে মধ্যপ্রদেশে বিজেপির কামালের রহস্য এটাই নয় কি? আহা, ওই জাদুটাই যদি লোকসভায় হ্যাটট্রিকের কসরতেও ফলে যায়!
মাথা খারাপ হলে আরও যা যা করা সম্ভব, সবই করছেন মোদিরা—মমতার ক্ষতি করার জন্য আপত্তিকর বিজ্ঞাপন ছড়াচ্ছেন। গেরুয়া মঞ্চ থেকে, বাংলায় তো বটেই, দেশজুড়ে কটাক্ষ করা হচ্ছে মমতার সম্প্রীতি-সৌহার্দ্যের রাজনীতিকে। সনাতন সাধুসন্তদের একাংশকেও মমতার বিরুদ্ধে উসকে দিচ্ছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং! অন্যদিকে, বঙ্গ বিজেপির ‘ভগীরথ’ আবার দাবি করছেন, মমতায় মজে কেউ যদি মোদিকে ভোট দিতে ভুলে যান তিনি পাপের ভাগীদার হবেন! কেন? মোদিই নাকি কলির রাম!