সন্তানের দাম্পত্য অশান্তিতে মানসিক চিন্তা। প্রেম-প্রণয়ে বিশ্বাস ভঙ্গ ও মনঃকষ্ট। ব্যবসার অগ্রগতি। ... বিশদ
কয়েক মাস আগেও অবশ্য এই অবস্থা ছিল না। বিরোধীদের তুড়ি মেরে ৪০০ আসনের ভেঁপু বাজিয়ে তিনি তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসছেন, এই ছিল উচ্চকিত প্রচারের অভিমুখ। অযোধ্যার মন্দির উদ্বোধনের পর হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা আরও চেপে বসে দেশজুড়ে। ঢাক ঢোল কাড়া নাকাড়ার আওয়াজে একসময়ে তা কার্যত গর্জনে পরিণত হয়। কিন্তু ভোটপর্ব এগতেই বাংলার মতো বহু রাজ্যে মোদিজির অতি ব্যবহৃত ‘গুগলি’ আর কাজে আসছে না। এতেই বেপরোয়া বিজেপি শেষ চেষ্টায় নেমেছে। রাহুল গান্ধীকে ভোট দেওয়া মানে পাকিস্তানকে সমর্থন করা কিংবা কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে করাচিতে পটকা ফাটবে, মা-বোনেদের মঙ্গলসূত্রটাও কেড়ে নেবে, এসব সস্তা ন্যারেটিভ দেওয়ালে পিঠ না ঠেকলে কোনও সরকারের মুখ এবং মুখোশরা প্রকাশ্যে উচ্চারণ করে? গত এক সপ্তাহে আবার সেখান থেকেও সরে ভয় দেখানো হচ্ছে, ওবিসিদের থেকে কেড়ে মুসলিমদের জন্য ধর্মের নামে আলাদা সংরক্ষণ করবে কংগ্রেস। এসব শুনেই দিল্লির পোড়খাওয়া আমলারা পর্যন্ত একান্তে বলছেন, ‘দাদা, শায়েদ কাঁটা লাগ গ্যায়া’।
প্রথম দফার ১০২ আসনে ভোট মিটতেই একটা অনিশ্চয়তা তাড়া করছে। সেই আতঙ্ক থেকেই ভুলভাল বকা। দেশ দেখছে, কতটা নীচে নামলে, প্রতিপক্ষের প্রতি কতটা ঘৃণা পোষণ করলে তবে তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন মনে লালন করা যায়, তার হাড়হিম প্রদর্শনী! বিকাশ, উন্নয়ন, সব কা সাথ, সব কা বিশ্বাস, পৃথিবীর তৃতীয় সমৃদ্ধশালী দেশের তকমা অর্জনের স্বপ্নকে পিছনে ফেলে, এখন শুধুই বিষাক্ত মেরুকরণের অস্ত্রে শান। দশ বছর দেশ শাসন করা ‘বিশ্বগুরু’ প্রকাশ্যে কংগ্রেসকে বলছেন, শীর্ষ শিল্পপতিদের থেকে ‘মাল কিতনা মিলা’? রাষ্ট্রনেতার মুখে এমন কদর্য ভাষা-সন্ত্রাস সীমান্তে অনুপ্রবেশকারীদের একে ৪৭ মারণাস্ত্রের চেয়েই বা কম কীসে? জনগণনাই হয়নি, তবু রহস্যজনকভাবে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর জানিয়েছে, গত ৭০ বছরে দেশে হিন্দুর সংখ্যা কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। মুসলিমরা সংখ্যায় বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। অর্থাৎ হিন্দু ধর্ম খতরে মে! নির্বাচনের মাঝে এমন রিপোর্ট প্রকাশ করার একটাই লক্ষ্য হতে পারে, হিন্দু ভোটকে আরও সঙ্ঘবদ্ধ করে ফায়দা তোলা।
আর বাংলায়? একুশের বিধানসভার পর চব্বিশেও চক্রান্ত ব্যর্থ। বহুবার লিখেছি, ৪ জুন মধ্যাহ্নে একুশের বিধানসভা ভোটের রিপিট টেলিকাস্ট দেখার অপেক্ষাতেই রাজ্যবাসী। বিরোধীদের বিশেষ করে গেরুয়া দলের গর্জন ক্রমেই স্তিমিত হয়ে আসছে। সেই সঙ্গে বিসর্জন হতে চলেছে বাংলা বিরোধী ষড়যন্ত্রেরও। এখনও পর্যন্ত রাজ্যে তিন দফার নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। উত্তরবঙ্গের ৮ ও মুর্শিদাবাদের দু’টি কেন্দ্র মিলিয়ে মোট দশটি আসনে মতদান শেষ। এবার পরীক্ষা বিস্তৃত দক্ষিণবঙ্গ ও কলকাতার ৩২টি আসনে। মানুষ নয়, সংগঠন নয়, সার্বিক জনমতও নয়, মূলত কয়েকটি ইস্যুকে সামনে রেখেই এবারের ভোটে জেতার কৌশল সাজিয়েছিল বিজেপি, যার সর্বাগ্রে ছিল শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি এবং সন্দেশখালি কাণ্ড। সঙ্গে অবশ্যই আর একটি মারাত্মক ইস্যু আচমকা মাথাচাড়া দেয়। রাজভবনের ঘেরাটোপে স্বয়ং রাজ্যপালের বিরুদ্ধে এক অস্থায়ী কর্মীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ। আমরা সবাই জানি, দেশের রাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যপালরা বিশেষ সাংবিধানিক রক্ষাকবচ পেয়ে থাকেন। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তা যতই গুরুতর হোক না কেন তার ভিত্তিতে এফআইআর করে মামলা শুরু করা যায় না। এক্ষেত্রেও রাজ্যপাল তাই আইনি ধরাছোঁয়ার বাইরে। রাজ্য সরকার তদন্ত করতে চাইলেও পাল্টা তোপ দেগেছেন সি ভি আনন্দ বোস। পুলিসকে ফুটেজও দেননি। তাই আসল রহস্য উদ্ঘাটিত হওয়া কঠিন। কিন্তু জনমন থেকে এই অভিযোগকে কি সহজে মুছে ফেলা যাবে? তার বদলে রাজভবন থেকে যে হাস্যকর ভিডিওটি প্রকাশ করা হয়েছে তা দিয়ে রাজ্যপাল ‘নির্দোষ’, এমন কথা হলফ করে বলা যায়? একটি রাজ্যের দায়িত্বশীল রাজ্যপাল পদে আসীন ব্যক্তি কোন আক্কেলে এক তরুণীর পরিচয় এভাবে সামনে আনলেন। একটা অভিযোগ ঢাকতে এ তো আর একটা বেআইনি কাজ। রাজ্যপালের আসনে বসে এক দুঁদে প্রাক্তন আমলার এমন কাণ্ড শোভা পায়?
যত সময় যাচ্ছে ব্যুমেরাং হচ্ছে সন্দেশখালি ইস্যুও। একটার পর একটা ভিডিও গোটা ঘটনাটি সত্য না স্রেফ ভোটের প্রয়োজনে সাজানো, তা নিয়ে চাঞ্চল্যকর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে জনমনে। স্থানীয় বিজেপি নেতা গঙ্গাধর কয়াল গেরুয়া দলের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিচ্ছেন গ্রাম্য মজলিশে। মাথা হেঁট। এর বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। আবার বঙ্গের গেরুয়া নেতারা পিঠ বাঁচাতে এটাকে তৃণমূলের কারসাজি বলে চালাতে চাইলেও সন্দেহ কিন্তু কিছুতেই পিছু ছাড়বে না। তদন্ত শেষে যদি সবটাই মিথ্যা প্রমাণিত হয়, সেক্ষেত্রে বঙ্গ বিজেপি’র মুখটা কোথায় থাকবে? ইতিমধ্যেই এর অভিঘাত রাজ্যের সীমা পেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছে সারা দেশে।
শিক্ষক দুর্নীতি ইস্যুতেও ধাক্কা খেয়েছে বিজেপি। সুপ্রিম কোর্ট ২৬ হাজারের চাকরি বাতিলের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে গুরুত্বপূর্ণ রায় দিতেই হাওয়া বদলে গিয়েছে। আপাতত ভোটপর্বে কারও চাকরি যাচ্ছে না। ১২ জুলাই পর্যন্ত কাউকে সুদ সহ বেতনও ফেরত দিতে হবে না। আবার এসএসসিও আদালতে যোগ্য ও অযোগ্যদের পৃথক করতে সক্ষম বলে জানিয়েছে। সবমিলিয়ে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার ছক তেমন কাজে আসছে না। বরং ‘চাকরি খেকো’ দুর্নাম জুটছে বিরোধীদের। সরকার চাকরি বাঁচাতে চায়, আর চাকরি কাড়াতেই সর্বসুখ বিরোধীদের। বিকাশবাবুরা আর কত চাকরি খাবেন, এই আওয়াজ তুলে খোদ আদালতের বাইরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন প্রার্থীরা।
‘অব কি বার ৪০০ পার’ ফ্লপ। সিএএ নিষ্ফলা। হরেক কিসিমের গালভরা গ্যারান্টি ভেসে গিয়েছে গঙ্গা, যমুনা, কৃষ্ণা ও কাবেরী দিয়ে। রামমন্দির উদ্বোধন করে হিন্দু আবেগকে উস্কে দেওয়ার কৌশলও ডাহা ফেল। যে আগ্রাসী ন্যারেটিভ নিয়ে মার্চ মাসে গেরুয়া প্রচার শুরু হয়েছিল তা হঠাৎ কেমন ভোঁতা, জবুথবু। গত ২১ এপ্রিল রাজস্থানের জনসভায় যেদিন প্রধানমন্ত্রী কংগ্রেস জিতে এলে মা-বোনেদের মঙ্গলসূত্রও হারাতে হবে বলে প্রলাপ বকলেন সেদিন থেকেই শাসক শিবির আক্রমণ ছেড়ে আশ্রয় নিল আত্মরক্ষার আবর্তে। প্রথম তিন দফায় অর্ধেকের বেশি আসনে ভোট হয়ে যাওয়ার পর পরিস্থিতি আমূল বদলে গিয়েছে। সঙ্ঘ থেকে শেয়ার বাজার সবাই এই সরকারের ফেরা নিয়ে সংশয়ে। একক গরিষ্ঠতা থাকবে তো? দু’দশক আগে বাজপেয়ি জমানার মতো দেড়শোর নীচে আটকে যাবে না তো! সেই সন্দেহ থেকেই এক ঝটকায় সেনসেক্স পড়ে গিয়েছে। উত্তরপ্রদেশে প্রকাশ্য জনসভা থেকে মোদিজির সরকারের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড অমিত শাহ বলেছেন, বিরোধীরা ক্ষমতায় এলে রামমন্দিরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। নিঃসন্দেহে ভয় দেখানোর মরিয়া কৌশল। খোদ উত্তরপ্রদেশে যেখানে দু’মাস আগেও সত্তরটি আসন তুড়ি মেরে জিতে যাওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিল গেরুয়া শিবির, সেখানে হঠাৎ কী হল? এমন অভিযোগও উঠেছে, হিন্দুদের প্রকাশ্যে মুসলিম সাজিয়ে বুথে বসানো হয়েছে। একটা রাজনৈতিক দল কখন এতটা বেপরোয়া ভূমিকা নেয়। নিশ্চিত পরাজয়ের গন্ধ পেলে। ক্ষমতা গেলে রামমন্দিরে ‘বাবরি তালা’র অলীক গল্পই প্রমাণ করে মানসিকভাবে কতটা কোণঠাসা অমিত শাহরা।
দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরাও হঠাৎ যেন কেমন দোদুল্যমান। বিজেপি ভেবেছিল, এত দীর্ঘ ভোট প্রক্রিয়ায় বিরোধীরা নাস্তানাবুদ হবে। এতদিন ধরে টানা প্রচারের পয়সা, লোকবল কিছুই তাদের নেই। প্লেন, কপ্টার বাড়ন্ত। ইডি, সিবিআই সব অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দিয়েছে আগেই। বরং ঘুরে ঘুরে দেশজুড়ে প্রচারের দৌড়ে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার সতীর্থরাই বাজিমাত করবে। কিন্তু সেই অর্থহীন দীর্ঘ ভোটপর্বই কার্যত এখন ব্যুমেরাং হচ্ছে। এত বড় দেশে দীর্ঘ সময় টেম্পো ধরে রাখা সত্যি কঠিন। প্রধানত মোদিজির প্রচারের সুবিধার্থেই একাধিক রাজ্যে ভোটের দফা এবার বেড়েছে। সৌজন্যে নির্বাচন কমিশন। মহারাষ্ট্রে পাঁচ দফায়, কর্ণাটকে দু’দফার মতদান অনেকেরই পছন্দ হয়নি। বাংলায় সাত দফার ভোট সিংহভাগেরই না-পসন্দ। শুধু উত্তরবঙ্গের ৮ আসনে তিন দফার ভোটের রহস্য কী, সেই প্রশ্ন ওঠাও মোটেই অপ্রাসঙ্গিক নয়। একান্তে অনেক বিজেপি নেতাই স্বীকার করছেন, এক, দুই, বড়জোর তিন দফায় ভোট হলে দলেরই লাভ হতো। ভোটের ইস্যু, স্লোগান, প্রেক্ষিত এতটা ঘেঁটে যেত না। খেলাটাও পিছলে যেত না। কিন্তু অল্পে সন্তুষ্ট হতে না পারার চড়া মাশুল দেওয়ার জন্য এখন তৈরি হচ্ছে গোটা গেরুয়া শিবির। বেছে বেছে বিরোধীদের নিকেশ করতে গিয়ে সরকারটাই না শেষে টালমাটাল হয়ে যায়! গেরুয়া বাহিনীর সাড়ে সাতি যোগ এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।