কর্ম, বিদ্যা ক্ষেত্রে উন্নতির যোগ। আয় ব্যয় ক্ষেত্রে সমতার অভাব। স্বাস্থ্য ভালো থাকলেও আঘাতযোগ থাকায় ... বিশদ
আধুনিক ভারতের ইতিহাসের এই আদর্শ ব্যক্তিত্বের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী জাতি সারাবছর ধরে উদযাপন করতে চলেছে। এই শুভক্ষণে তাঁর পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশে আমার সকৃতজ্ঞ শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। শৈশবে ভগবান বিরসা মুন্ডার অনেক কিংবদন্তি কাহিনি শুনেছি। আমাদের এই উত্তরাধিকারের জন্য আমি এবং আমার বন্ধুরা খুবই গর্বিত বোধ করতাম। এখানে আমি সেই কথা স্মরণ করি।
আজকের ঝাড়খণ্ডে উলিহাতু নামে যে জায়গাটি, ভগবান বিরসা সেখানকার ছেলে। মাত্র ২৫ বছরের ছোট্ট জীবনে ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধের নায়ক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ইংরেজ শাসক এবং স্থানীয় ভূস্বামীরা জনজাতিগুলিকে শোষণ করছিল। দখল করে নিচ্ছিল তাদের জমিজমা। এছাড়াও অত্যাচার চলত নানাভাবে। ভগবান বিরসা এই সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। মানুষের অধিকার ফেরানোর জন্য সংগঠিত লড়াই-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিলেন তিনি। ১৮৯০-এর দশকের শেষের দিক তখন। ‘ধরতি আবা’ বা ‘পৃথিবীর পিতা’ নামে পরিচিত ভগবান বিরসা ব্রিটিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ‘উলগুলান’ বা মুন্ডা বিদ্রোহ সংগঠিত করেন।
উলগুলানের গুরুত্ব একটি সাধারণ বিদ্রোহের চেয়ে অবশ্যই অনেক বেশি। সেটি ছিল ন্যায়বিচার এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়—এই দুটিরই জন্য লড়াই। ভগবান বিরসা মুন্ডার বিচক্ষণ চিন্তা—একদিকে, অন্যের হস্তক্ষেপ ছাড়াই আদিবাসীদের জমির মালিকানা ও চাষের অধিকার এবং অন্যদিকে, উপজাতীয় রীতিনীতি ও সামাজিক মূল্যবোধের গুরুত্বকে এক জায়গায় নিয়ে এসেছিল। মহাত্মা গান্ধীর মতোই, তাঁর সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল ন্যায় ও সত্যের সন্ধানে।
তিনি আবেগতাড়িত হয়েই অসুস্থ মানুষের সেবা শুশ্রূষা করতেন। তিনি একজন নিরাময়কারী হিসেবে প্রশিক্ষিত ছিলেন। একের পর এক ঘটনা থেকে মানুষের মনেও এই বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল যে, শুধুমাত্র ছুঁয়েই নিরাময় করার ক্ষমতা ভগবান তাঁকে দিয়েছেন। অসুস্থ যে কাউকেই তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি বলতেন। তিনি আরও বলতেন, ‘আমার কাছে আনা যদি নিতান্তই অসম্ভব হয়, তবে সেই অসুস্থ মানুষকে দেখতে যাব আমি নিজেই।’ তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে অসুস্থ মানুষজনকে কাছে ডেকে নিতেন। তাঁর দক্ষতা ও নিরাময় স্পর্শ দিয়ে, এইভাবে অসংখ্য মানুষকে তিনি সুস্থ করে তুলেছেন।
ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মহান বিপ্লবীদের ইতিহাসে তাঁর আত্মত্যাগের কাহিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাঁদের সংগ্রাম এই ভূখণ্ডের অনন্য ঐতিহ্যকে তুলে ধরে, যেখানে কোনও সম্প্রদায়ই মূলধারা থেকে আলাদা নয়। যে বনবাসীরা আজ তফসিলি জনজাতিভুক্ত, তাঁরা সবসময় সমগ্র জাতির অংশ।
একটা সময় পর্যন্ত ভগবান বিরসা মুন্ডা এবং অন্যরা ছিলেন ইতিহাসের ‘অখ্যাত নায়কদের’ অন্যতম। তবে সাম্প্রতিককালে তাঁদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের সত্য প্রশংসিত হচ্ছে। ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’-এর সময়ে ভারতের সংস্কৃতি এবং কৃতিত্বের গৌরবময় ইতিহাস আমরা উদযাপন করেছি। যেসব মহান দেশপ্রেমিক এতদিন স্বল্প পরিচিত ছিলেন, এই মহোৎসব তাঁদের বীরগাথা সম্পর্কে সব মানুষকে, বিশেষ করে তরুণদের আরও জানার সুযোগ করে দিয়েছে।
আদিবাসী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অবদান স্মরণে সরকার ২০২১ সালে ভগবান বিরসা মুন্ডার জন্মবার্ষিকী উদযাপন করার কথা ঘোষণা করে। এই উপলক্ষ্যে ১৫ নভেম্বর দিনটিকে ‘জনজাতীয় গৌরব দিবস’ হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইতিহাসের সঙ্গে এই নয়া সম্পর্কস্থাপন আমাদের প্রাণিত করে। ভগবান বিরসা মুন্ডার উত্তরাধিকারের স্মৃতিচারণ আদিবাসীদের দীর্ঘ উপেক্ষিত ইতিহাসকে ভারতের ইতিহাসের কেন্দ্রে তুলে এনেছে।
এই ইতিহাসগুলি আজ আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। কারণ এগুলিই আধুনিক বিশ্বকে শেখায় প্রকৃতির সঙ্গে সংহতি রেখে জীবনযাপন এবং বাস্তুতন্ত্র রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। মনে আছে, সামান্য শুকনো জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের জন্য ছোটবেলায় আমার বাবাকে ক্ষমা চাইতে দেখেছি। অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার চেয়ে সমষ্টিগত কল্যাণের জন্য অনেক বেশি কাজ করেই আদিবাসী সমাজগুলি খুশি থাকে।
মানবজাতির উন্নত ভবিষ্যতের জন্য আদিবাসী সমাজের এই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যটিকে লালন করা দরকার। ভারতের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোয় জনজাতিগুলির গুরুত্বকে যথাযথ স্বীকৃতি দিতে গত দশকে সরকার যে বৃহত্তর প্রচেষ্টার সূচনা করেছিল তার পিছনে যথার্থ কারণ ছিল এটাই। স্লোগানের ঊর্ধ্বে, প্রকৃত জনকল্যাণকে তৃণমূল স্তরে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে সরকার একগুচ্ছ কর্মসূচি ও প্রকল্প ঘোষণা করেছে। আদিবাসী উন্নয়ন এবং কল্যাণে আরও সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গতমাসে চালু হয়েছে ‘ধরতি আবা জনজাতীয় গ্রাম উৎকর্ষ অভিযান’। এতে প্রায় ৬৩ হাজার আদিবাসী গ্রামের সামাজিক পরিকাঠামোগত ফাঁকফোকরগুলি পূরণ হবে। পাশাপাশি, প্রধানমন্ত্রী জনজাতি আদিবাসী ন্যায় মহা অভিযান (পিএম-জনমন)-এর দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে ১১টি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের উপর। এর উদ্দেশ্য, কল্যাণমূলক উদ্যোগগুলিকে আরও অর্থবহ করে তোলা।
আমি বিশ্বাস করি, তফসিলি জনজাতিগুলির সার্বিক উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করাটাই ভগবান বিরসা মুন্ডা এবং আদিবাসী এলাকার অন্যান্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি জাতির তরফে প্রকৃত শ্রদ্ধা প্রদর্শন। আমার জন্য অত্যন্ত তৃপ্তির বিষয় এই যে রাষ্ট্রপতি ভবনও এসটি সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছনোর জন্য নতুন উদ্যোগ নিয়েছে। রাষ্ট্রপতি ভবন মিউজিয়ামে ‘জনজাতি দর্পণ’ নামক একটি গ্যালারি উদ্বোধন করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। দেশ গঠনে আদিবাসী সম্প্রদায়ের অসামান্য অবদানের এক ঝলক খুঁজে পাওয়া যায় এই সমৃদ্ধ শিল্প ও সংস্কৃতির নমুনাগুলির মধ্যে। জনজাতির কল্যাণে উন্নততর সম্পদ ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করার সুযোগ আমার হয়েছিল গত আগস্টে অনুষ্ঠিত রাজ্যপালদের সম্মেলনে।
বিশেষভাবে দুর্বল জনজাতি গোষ্ঠীগুলি (পিভিটিজি) থেকে ৭৫ জন প্রতিনিধিকে রাষ্ট্রপতি ভবন পরিদর্শনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তাঁদের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনার যে সুযোগ আমার হয়েছিল সেটি একটি দারুণ অভিজ্ঞতা। তাঁদের অনেক সুখ-দুঃখের কথা তাঁরা আমার সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন। আমার গর্বের একটি কৃতিত্ব যদি থাকে, তা হল—সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে আমার অধিষ্ঠান—এই পদে আমার মধ্যে আদিবাসী ভাই ও বোনেরা আমাদের সকলের জন্য একটি অভূতপূর্ব স্বীকৃতি দেখে থাকেন।
ভগবান বিরসা মুন্ডার ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উদযাপনের আনন্দ আমি নিশ্চিত যে আমরা সকলেই ভাগ করে নেব। আমি বিশ্বাস করি, ভগবান বিরসা মুন্ডার আদর্শগুলি শুধুমাত্র আদিবাসীদের নয়, বরং দেশের প্রতিটি অংশের সমস্ত সম্প্রদায়ের যুবদের জন্য গর্বের এবং অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর আকাঙ্ক্ষা ছিল—স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, পরিচয় এবং মর্যাদার। এই আকাঙ্ক্ষাগুলি তো প্রতিটি তরুণেরও।