শত্রু বৃদ্ধি হলেও কর্মে উন্নতি ও কর্মস্থলে প্রশংসা লাভ। অর্থকর্মে উন্নতি হবে। সন্তানের ভবিষ্যৎ উচ্চ ... বিশদ
অটলবিহারি বাজপেয়ি তাঁর জমানায় এই কাশ্মীর সমস্যার সমাধান প্রসঙ্গে ‘কাশ্মীরিয়ত-জামহুরিয়ত-ইনসানিয়ত’-এর কথা বলেছিলেন। তখন কি জানা ছিল, ১৯ বছর পরে ওই একইদিনে বাজপেয়িজির ‘ভাবশিষ্য’ নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি তাঁর রাজনৈতিক গুরুর উল্টো পথে হাঁটবেন? বাতিল করবেন সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫(ক) ধারা। কাশ্মীরিত্ব, গণতন্ত্র ও মানবতা— এই ত্রয়ী ধারণার কোনওটাই মোদি-শাহ জমানায় রক্ষিত হয়নি। কাশ্মীরিয়াৎ-এর কথা তোলায় স্বয়ং রাজনাথ সিংকেও বিজেপি-আরএসএস সাইবার আর্মির আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল। জম্মুতে ভোটব্যাঙ্ক অক্ষুণ্ণ থাকায় কাশ্মীর উপত্যকায় বিজেপির জনভিত্তি হারানোর বিশেষ ভয় নেই। বরং অশান্ত কাশ্মীরকে দেখিয়ে সে অবশিষ্ট ভারতে এক ধরনের জনসমর্থন আদায় করতে চায়। এর ফলে সমাধান সূত্র বেরিয়ে আসা দূরে থাক, জটিলতা বেড়েছে এবং কাশ্মীর উপত্যকার সাধারণ মানুষও ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠেছেন। প্রশ্ন ওঠে, একটা গোটা রাজ্যের সবাই জঙ্গি?
ইতিহাস বলে, ১৯৪৭-এর ২৬ অক্টোবর বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে এই কাশ্মীরকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। ওই বিশেষ শর্তে ১৯২৭ সালের একটি আইনকে ভারত সরকার মান্যতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ওই আইনে মহারাজ হরি সিং জম্মু-কাশ্মীরে অ-কাশ্মীরিদের জমি কেনা এবং চাকরি করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। অ-কাশ্মীরিরা তখন থেকেই সেখানে স্থায়ী নাগরিকত্বের অধিকার পেতেন না। আমরা জানি, ১৯৪৭-এ হরি সিংকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিরই ফল সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫(ক) ধারা। আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবার বরাবরই ওই দুই ধারার বিরোধী। জম্মু-কাশ্মীর হাইকোর্টে ওই আইন বাতিলের জন্য তারা দাবিও জানিয়েছিল। কিন্তু হাইকোর্ট সেই দাবি খারিজ করে দেয়। সুপ্রিমকোর্টও হাইকোর্টের সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানায়। সাময়িকভাবে সঙ্ঘ পরিবার পিছু হটে। কিন্তু ২০১৯-এর লোকসভায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে নরেন্দ্র মোদি নিজেই সুপ্রিম কোর্ট! নিজেই সংবিধান! ফলে মোদি-শাহ সেই বছরের ৫ আগস্ট ওই দুই আইন বাতিল করে দিয়েছিলেন। কারণ একটাই, ভোটের অঙ্ক!
জম্মু-কাশ্মীরে ২০১৪-র বিধানসভা ভোটে মোট প্রদত্ত ভোটের মাত্র ২৩ শতাংশ পেয়ে বিজেপি পেয়েছিল ২৫টি আসন। আর মুসলিম প্রধান কাশ্মীরে পেয়েছিল মাত্র ২.২ শতাংশ ভোট! ফলে মিশন ৪৪+ স্লোগান তুলে যে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন অমিত শাহরা, তা অধরাই থেকে গিয়েছিল। তখনকার জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভায় মোট আসন ছিল ৮৭টি। কাশ্মীরে ৪৬, জম্মুতে ৩৭ এবং লাদাখে ৪। অমিত শাহরা বুঝে গিয়েছিলেন, জম্মু-কাশ্মীরকে দখল করতে হলে ভূস্বর্গকে কব্জা করা জরুরি। আর সেই উদ্দেশ্যেই সেখানকার জনবিন্যাসকে ঘেঁটে দেওয়া খুব প্রয়োজন। তাই, সংবিধানের ৩৫-এ ধারা বাতিল করে দিয়ে তামাম ভারতের সামনে কাশ্মীর উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। এখন যে কেউ সেখানে জমি কিনতে পারেন। যে কেউ সেখানকার স্থায়ীবাসিন্দা হতে পারেন। আর স্থায়ীবাসিন্দা মানেই ভোটার। এখানেই শেষ নয়...।
শুরু হয়েছে কাশ্মীর দখলের নতুন চক্রান্ত!
ডিলিমিটেশন তথা বিধানসভা ক্ষেত্রের সীমানা পুনর্বিন্যাস প্রস্তাব তারই সর্বশেষ পদক্ষেপ। ডিলিমিটেশন কমিশনের প্রধান করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি রঞ্জনা দেশাইকে। ডিলিমিটেশনের ক্ষেত্রে সারা দেশে এতকাল যে বিষয়গুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হতো এবং যে অভিজ্ঞতা ও বোঝাপড়াকে মান্যতা দেওয়া হতো জম্মু-কাশ্মীরের ক্ষেত্রে তার সবগুলিকেই কার্যত অস্বীকার করা হয়েছে। বদলে মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে জনবিন্যাসের চরিত্র বদল করে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল। এই কৌশল একসময় নিয়েছিল মুসলিম মৌলবাদীরাও। তারা কাশ্মীর থেকে পণ্ডিতদের উচ্ছেদ করে জনবিন্যাসের চরিত্র বদল করার চেষ্টা করেছিল।
আসন পুনর্বিন্যাসের অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় মাথায় রাখা হয় ঠিকই, কিন্তু সর্বাধিক গুরুত্ব পায় জনসংখ্যা। এক্ষেত্রে জনসংখ্যাকে পাশে সরিয়ে সেই আনুষঙ্গিক বিষয়গুলিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যাতে আগামী নির্বাচনে জম্মু- কাশ্মীরের অধিবাসীদের মতামতের যথাযথ প্রতিফলন ঘটতে না পারে। ডিলিমিটেশন কমিশন যে সুপারিশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, যেখানে জনসংখ্যা কম সেখানে আসন সংখ্যা বেড়েছে। আর যেখানে জনসংখ্যা বেশি সেখানে আসন বাড়েনি বললেই চলে। জম্মুতে ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী জনসংখ্যা ৫৩.৫ লক্ষ, সেখানে আসন বেড়েছে ৬টি। অথচ কাশ্মীর, যেখানে জনসংখ্যা ৬৮.৮ লক্ষ সেখানে বেড়েছে মাত্র একটি। লাদাখের চারটি আসন বাদ হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে কাশ্মীরে ৪৬টি এবং জম্মুতে ৩৭টি আসন রয়েছে। আসনের পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব অনুযায়ী, আগামী বিধানসভা ভোটে জম্মু অংশের আসনসংখ্যা ৬টি বেড়ে হবে ৪৩ আর কাশ্মীর অংশে মাত্র ১টি বেড়ে হবে ৪৭! তাছাড়া পূর্বের জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভায় ২৪টি আসন ফাঁকা থাকত পাক অধিকৃত কাশ্মীরের জন্য। তা এবারও অপরিবর্তিত থাকবে। অর্থাৎ জম্মু-কাশ্মীরের জন্য মোট আসন সংখ্যা হবে ১১৪টি।
যদি ন্যায়সঙ্গতভাবে পুনর্বিন্যাসের সুপারিশ হতো তাহলে কাশ্মীরের আসন ৪৬ থেকে বেড়ে হতো ৫১টি। আর জম্মুর আসন ৩৭ থেকে বেড়ে হতো ৩৯টি। কিন্তু তা করা হয়নি। বিজেপির লক্ষ্য, জম্মুতে বেশি আসনে জিতে কাশ্মীরের ঘাটতি পূরণ করে ক্ষমতা দখল করা। তাই আসনসংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের প্রায় সমান করে দেওয়া হচ্ছে সংখ্যালঘু জম্মুকে! এই গোটা ষড়যন্ত্রটাই মানুষের কাছে আজ পরিষ্কার। কাশ্মীরের আসন বাড়লে গেরুয়া শিবিরের ভয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, বিধানসভার আসন পুনর্বিন্যাস প্রস্তাবের পর কাশ্মীর উপত্যকার রাজনৈতিক দলগুলোকে আরও জোটবদ্ধ হওয়ার আরও এক সুযোগ করে দিয়েছে মোদি সরকার। তারই ছায়া দেখা গিয়েছে সরকারের উদ্যোগে আয়োজিত আবাসন সম্মেলনেও। এই সম্মেলনের বিরোধিতায় জোটবদ্ধ উপত্যকার প্রতিটি রাজনৈতিক দল। এমনকী বিচ্ছিন্নতাবাদী দল হুরিয়ত কনফারেন্সও এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ দাবি করেছে।
জম্মুতে সম্প্রতি এই আবাসন সম্মেলনের উদ্বোধন করেন জম্মু-কাশ্মীরের উপরাজ্যপাল মনোজ সিনহা। সরকারিভাবে বলা হয়, ওই সম্মেলনে স্বাক্ষরিত হয়েছে ৩৯টি অনুচুক্তি। এগুলো বাস্তবায়িত হলে ১৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা লগ্নি হবে বিভিন্ন ধরনের আবাসন প্রকল্পে। এগুলোর মধ্যে ১৯টি নাগরিক আবাসন–সংক্রান্ত, ৮টি বাণিজ্যিক এবং ৪টি হোটেল প্রকল্প। বাকি প্রকল্পগুলোতে বিভিন্ন ধরনের পরিকাঠামো ছাড়া গড়ে তোলা হবে সিনেমা ও বিনোদনকেন্দ্র। উপরাজ্যপাল জানিয়েছেন, যেভাবে সরকার এগচ্ছে, তাতে আগামী বছরের মার্চ মাসের মধ্যে এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিনিয়োগ প্রস্তাবের পরিমাণ দাঁড়াবে ৬০ হাজার কোটি টাকা। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে ৪৪ হাজার কোটি টাকার লগ্নির প্রস্তাব পাওয়া গিয়েছে।
উপত্যকার রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সরকারি উদ্যোগের উদ্দেশ্য স্পষ্ট। তারা মনে করছে, এভাবে জনবিন্যাসে বদল ঘটিয়ে জম্মু-কাশ্মীরের চরিত্র বদলে বিজেপির মতো হিন্দুত্ববাদী দল ক্ষমতাসীন হবে। বিরোধীরা বলছে, আবাসন সম্মেলনের নামে শুরু হচ্ছে জমি লুট। লুট হতে চলেছে জম্মু-কাশ্মীরের এতকালের স্বতন্ত্র পরিচয়। এভাবেই দেশের একমাত্র মুসলিমপ্রধান রাজ্যকে শেষ করে দিতে সরকার কদম কদম এগচ্ছে। জমির চরিত্র বদলানো হয়েছে। চাষের জমিও বিক্রির বন্দোবস্ত করা হয়েছে। জনবিন্যাসে পরিবর্তন ঘটিয়ে সম্পদ লুট করাই এই সম্মেলনের একমাত্র উদ্দেশ্য। রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পর উপত্যকার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতার জন্য বিজেপির মদতে জন্ম হয়েছিল জম্মু-কাশ্মীর আপনি পার্টির। পিডিপির একসময়ের শীর্ষ নেতা আলতাফ বুখারিকে করা হয় আপনি পার্টির নেতা। বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে জেলা উন্নয়ন পর্ষদের ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তারা শ্রীনগর উন্নয়ন পর্ষদের দখলও নিয়েছে। এই আপনি পার্টিও কেন্দ্রীয় উদ্যোগের বিরোধিতায় নেমেছে। আলতাফ বুখারি বলেছেন, ‘আমরা উন্নয়নের পক্ষে, কিন্তু আবাসিক আইন ও নিজস্বতা বিলিয়ে দিয়ে নয়। জম্মু-কাশ্মীরের জমি ও চাকরির উপর মানুষের অধিকারের সঙ্গে দল কিছুতেই আপস করতে পারবে না। এমন ধরনের যেকোনও উদ্যোগের বিরোধিতায় দল প্রস্তুত।’ রুদ্ধ উপত্যকার নাগরিকদের বিরুদ্ধ-স্বর স্তব্ধ করে দিতে এবার কোন অস্ত্র ব্যবহার হবে? কেউ জানে না!
তবুও তো থমথমে কাশ্মীরে নৈসর্গ আছে। করুণ রস, বীর রস, ষড়যন্ত্র— সবই আছে। ভূস্বর্গের উত্তুঙ্গ শিখরের রং বদল দেখতে, পাইন ও দেবদারুর জঙ্গলের গান শুনতে, ডাল লেকের হাউসবোটে, টিউলিপের বাগানে আপনাকে আমন্ত্রণ জানায় উপত্যকার নাগরিকরা। সোনমার্গ, গুলমার্গ, পাটনিটপ আর পহেলগাঁও আপনারই অপেক্ষায়! তার বাইরে আপনি কিন্তু কিছুই খুঁজে পাবেন না!
শীত পেরিয়ে বসন্ত আসছে। শুরু হবে উপত্যকার চিনার আর দেবদারু গাছের সঙ্গে বসন্তের হাওয়ার ফিসফিসানি। শুরু হবে পাতা ঝরা। পাল্টে যাবে উপত্যকা আর প্রকৃতির রঙ। বদলাবে না শুধু গেরুয়া শিবিরের ‘ক্রোনোলজি’!