সঠিক বন্ধু নির্বাচন আবশ্যক। কর্মরতদের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মক্ষেত্রে বদলির কোনও সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। শেয়ার ... বিশদ
স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী রাজনীতিতে সরাসরি জাতপাতের কোনও প্রভাব লক্ষ করা যায়নি। যদিও পশ্চিমবঙ্গের সমাজ-জীবনে জাতপাতের প্রবল উপস্থিতি প্রায় সর্বক্ষেত্রেই ছিল। এরাজ্যে সংবিধানের অন্তর্গত তফসিলি জাতি ও জনজাতিদের নিয়ে অল্পবিস্তর সংগঠিত রাজনীতি দেখা গেলেও সেভাবে কংগ্রেস বা বাম দলগুলি কখনোই জাতভিত্তিক রাজনীতি করেনি। বাম এবং কংগ্রেস উভয় দলের ক্ষেত্রেই সমাজের সব জাতির মানুষের সমর্থন কমবেশি ছিল। যেভাবে মায়াবতীর সঙ্গে দলিতদের সম্পর্ক, মুলায়ম সিং যাদবের সঙ্গে যাদব ভোটারদের সম্পর্ক বা অজিত সিংয়ের সঙ্গে জাঠ ভোটারদের সম্পর্ক আমরা দেখতে পাই পশ্চিমবঙ্গে তেমন সম্পর্ক রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে জাতের দেখা যায় না।
বিধানচন্দ্র রায় থেকে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় পর্যন্ত সকলেই জাতের রাজনীতির বাইরে থেকে রাজ্য-রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। অন্যদিকে বামেরা মূলত শ্রেণীগত রাজনীতির ওপর ভিত্তি করেই নিজেদের সংগঠিত করেছেন। তফসিলি জাতি ও জনজাতিদের জন্য আলাদা করে গণসংগঠন গড়ে তুললেও নির্বাচনী রাজনীতিতে কংগ্রেস বা বামেরা কখনওই নির্বাচনী প্রচারে তাদের আত্মপরিচয়কে ব্যবহার করেনি। বরং সরকারে থাকার সুবিধায় রাজ্য বা কেন্দ্রের তরফ থেকে তফসিলি জাতি এবং জনজাতিদের জন্য যে সমস্ত কল্যাণকর প্রকল্প রূপায়ণ করতে পেরেছে তার ভিত্তিতেই শাসক দল যেমন সমর্থন আদায় করতে চেয়েছে, তেমনি বিরোধীরা তফসিলি জাতি ও জনজাতির মানুষের উন্নয়নের কাজে সরকারের ব্যর্থতাকে সামনে রেখে সংরক্ষিত আসনগুলি জেতার চেষ্টা করেছে। নদীয়া, উত্তর ২৪ পরগনার মতো জেলায় নমঃশূদ্র ভোটব্যাঙ্ক নিয়ে কদাচিৎ কোনও নেতা রাজ্য-রাজনীতিতে উঠে এলেও অল্প সময়ের মধ্যেই জাতিগোষ্ঠীর চেতনার থেকে সরে এসে সার্বিক রাজ্য-রাজনীতির ভাবনার সঙ্গে যুক্ত হতে দেখা গেছে। একথা বামফ্রন্টের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী কান্তি বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও যেমন প্রযোজ্য, তেমনি কংগ্রেস নেতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় দু’কোটি তফসিলি জাতির মানুষ। তাঁদের অর্ধেক নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ভুক্ত, তাঁদের অর্ধেক মতুয়া।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ফরিদপুরের হরিচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে মতুয়াদের সামাজিকভাবে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এর অনেক পরে প্রমথরঞ্জন ঠাকুর বাংলার আইনসভার সদস্য হন। ১৯৬২ সালে প্রমথরঞ্জনবাবু হাঁসখালি থেকে কংগ্রেস প্রতীকে জিতে মন্ত্রী হন। যদিও পরে তিনি রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। তিনি দলীয় রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এলেও মতুয়াদের মধ্যে রাজনীতি সম্পর্কিত একটি সাধারণ ভাবনা সবসময় বিরাজ করছে। এই ভাবনাটি হল, ‘যে জাতির দল নেই সেই জাতির বল নেই।’ এই ভাবনা স্পষ্ট ইঙ্গিত করে মতুয়া নেতৃবর্গ রাজনৈতিক দলকে ব্যবহার করে নিজেদের কৌমকে শক্তিশালী করতে চায়। বাম জমানায় উত্তর ২৪ পরগনা এবং নদীয়ায় মতুয়া-প্রধান বিধানসভা এবং লোকসভাগুলোতে দীর্ঘ সময় মতুয়া ভোটারদের সমর্থন বামপ্রার্থীদের সঙ্গে ছিল। এই পর্যায়ে প্রমথরঞ্জন ঠাকুরের ছেলে কপিলকৃষ্ণের সঙ্গে বামেদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা সুবিদিত। পাশাপাশি একাধিক বাম নেতাও ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। তাঁদের মধ্যে যেমন ফরওয়ার্ড ব্লকের হরিপদ বিশ্বাস ছিলেন, তেমনি ছিলেন সিপিএমের কান্তি বিশ্বাস, সুভাষ চক্রবর্তী বা গৌতম দেব। বামেদের ভূমিসংস্কার কর্মসূচি বা পঞ্চায়েত ব্যবস্থা মতুয়াদের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে কিছুটা ইতিবাচক আবহ তৈরি করেছিল। কিন্তু, তাঁদের জাতিসত্তার সংরক্ষণ, নাগরিকত্ব সমস্যার সমাধান, ঠাকুরবাড়ির উন্নয়নে বামেরা কোনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারেনি। এই অবস্থায় সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম আন্দোলনের প্রভাবে নদীয়া ও দুই ২৪ পরগনার কৃষকদের কাছে তো বটেই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রহণযোগ্য বিরোধী মুখ হয়ে ওঠেন মতুয়া নেতৃবর্গের কাছে। ২০০৮ সালের পর থেকে মূলত জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০১০ সালে বীণাপাণি দেবী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মতুয়া মহাসভার মুখ্য উপদেষ্টার পদে বসান। রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মমতা দেবী শরণার্থীদের পুনর্বাসনের নীতি প্রণয়ন, ঠাকুরনগরে খেলার স্টেডিয়াম নির্মাণ এবং রেলওয়ে হাসপাতাল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এছাড়া ঠাকুরনগরের পবিত্র পুকুর কামনাসাগরের জন্য মমতা অর্থ প্রদান করেছিলেন।
২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচন থেকেই মতুয়াদের ভোটদানের প্রবণতায় স্পষ্টভাবে তৃণমূলের প্রতি ঝোঁক ধরা পড়েছিল। শেষবেলায় বামেরা বিমান বসুকে নামিয়েও মতুয়া সম্প্রদায়ের তৃণমূলের প্রতি এই ঝোঁককে ঠেকাতে পারেনি। ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে তৃণমূলের প্রতি মতুয়াদের স্পষ্ট সমর্থন ধরা পড়ে। তৃণমূল নেতৃত্বও ঠাকুরনগরে বীণাপাণি দেবীর সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে থাকেন। বীণাপাণি দেবীর ছেলে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরকে গাইঘাটা কেন্দ্র থেকে জয়ী করে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেন মমতা। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে বীণাপাণি দেবীর আর এক ছেলে কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর বনগাঁ থেকে তৃণমূল এমপি হন। এই পর্যায় পর্যন্ত মতুয়াদের ভোটব্যাঙ্ক তৃণমূলের প্রতি অটুট ছিল। কিন্তু কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী মমতা ঠাকুরকে উপনির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থী করার সঙ্গে সঙ্গেই ঠাকুর পরিবারে বিবাদ শুরু হয়। মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে এসে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর তাঁর পুত্র সুব্রত ঠাকুরকে ওই নির্বাচনে বিজেপির প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করান। মতুয়া শিবিরে রাজনৈতিক বিভাজনও সেই থেকে স্পষ্ট। দলকে ব্যবহার করে মতুয়া সম্প্রদায়কে শক্তিশালী করার কথা কেউ কেউ বলছেন, আবার একটি অংশ মতুয়া মহাসংঘকে ভারত সেবাশ্রম সংঘ বা রামকৃষ্ণ মিশনের মতো রাজনীতিমুক্ত রাখার পক্ষপাতী।
এই ভোটেও বনগাঁর তৃণমূল প্রার্থী মমতাবালা ঠাকুর। অন্যদিকে শান্তনু ঠাকুর বিজেপি প্রার্থী। মতুয়া ভোটাররা কি নির্দিষ্ট কোনও রাজনৈতিক ভাবনা থেকেই ভোট দিচ্ছেন? নাকি আর পাঁচটি লোকসভা কেন্দ্রের ভোটারদের মতোই মতুয়া ভোটারদের নির্বাচনী আচরণের বহিঃপ্রকাশ হয় তা পরখ করে দেখার সুযোগ রয়েছে বনগাঁ নির্বাচনের ফলাফল থেকে। তবে আপাতত তৃণমূল এবং বিজেপি উভয় শিবির থেকেই দাবি করা হচ্ছে তারাই মতুয়াদের প্রকৃত বন্ধু। বিজেপি ২০১৬ সালের নাগরিকত্ব সংশোধন বিল প্রচারে এনে মতুয়াদের বোঝাতে চাইছে স্থায়ীভাবে মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে তারা কতটা আন্তরিক। অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপি’র নাগরিকত্ব পঞ্জিকরণ উদ্যোগ যে মতুয়াদের সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে তা নিয়ে সরব।
রাজ্যে যে ৬৮টি তফসিলি জাতির আসন রয়েছে তাতে ২০১৬-এর বিধানসভা ভোটে তৃণমূল একাই ৪৬.৪১ শতাংশ ভোট পেয়ে ৪৯টি আসন পেয়েছিল। অন্যদিকে বাম-কংগ্রেস জোট ৪০.২১ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৯টি আসন পায়। বিজেপি এই কেন্দ্রগুলিতে ১০ শতাংশ ভোট পেলেও কোনও আসন পায়নি। আমরা যদি নদীয়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় মতুয়া-প্রধান তফসিলি জাতি বিধানসভা কেন্দ্রগুলির ফলাফলের দিকে তাকাই, তবে সেক্ষেত্রে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট এই তিন জেলার ২১টি তফসিলি কেন্দ্রে ছিল ৪৮.৫৭ শতাংশ। যা ৬৮টি তফসিলি কেন্দ্রের তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হারের থেকে ২ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে বামেদের এই তিন জেলায় প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হার ২ শতাংশ কম ছিল। এই তথ্য অবশ্যই প্রকাশ করে তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত ৬৮টি কেন্দ্রের মধ্যে মতুয়াপ্রধান ২১টি বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের পক্ষে অতিরিক্ত সুইং ছিল। অর্থাৎ তৃণমূলের পক্ষে অতিরিক্ত ২ শতাংশ ভোট মতুয়াপ্রধান বিধানসভাগুলিতে ছিল। অন্যদিকে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও বর্ধমানে বাগদি-প্রধান ১৬টি তফসিলি জাতি বিধানসভা কেন্দ্রের গত বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হার ছিল ৪৭.২৮ শতাংশ। যা নদীয়া, দুই চব্বিশ পরগনায় মতুয়াপ্রধান তফসিলি জাতির বিধানসভা কেন্দ্রগুলির থেকে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোটের ১ শতাংশ কম।
বাম আমলে অধিকাংশ তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত কেন্দ্রগুলি তাদের দখলে ছিল। এই প্রবণতা তৃণমূলের আমলেও প্রায় অব্যাহত বলা যায়। পার্থক্য শুধু মতুয়া-প্রধান তফসিলি কেন্দ্রগুলিতে প্রচারের ধরন ও বহরে। যেখানে শাসক এবং মূল বিরোধী উভয় পক্ষই মতুয়াদের পরিচয় সত্তার রাজনীতির ওপর জোর দিচ্ছেন।
আমাদের রাজ্যে তফসিলি জনজাতিদের জন্য ১৬টি বিধানসভা কেন্দ্র এবং ২টি লোকসভা কেন্দ্র রয়েছে। ২০১৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস এই ১৬টি কেন্দ্রের মধ্যে একাই ১৩টি লাভ করে। বাম-কংগ্রেস জোট পায় ২টি, ১টি কেন্দ্র বিজেপি’র পক্ষে ছিল। তফসিলি জনজাতির জন্য সংরক্ষিত ২টি লোকসভা আসনে তৃণমূল কংগ্রেস গত লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল। কিন্তু গত নির্বাচনে আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ এই দুটি কেন্দ্রেই বিজেপি’র উত্থান লক্ষ করা গেছে। ২০১৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হার যেখানে ছিল ১০ শতাংশের মতো, সেখানে বিধানসভার ১৬টি তফসিলি জনজাতি আসনে বিজেপি ১৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। অন্যদিকে তৃণমূলের ভোট ছিল প্রায় ৪৫ শতাংশ এবং বামেদের ৩২ শতাংশের মতো। বিধানসভা নির্বাচনের পর তফসিলি জনজাতি কেন্দ্রগুলির রাজনৈতিক ভাবনায় স্পষ্ট পরিবর্তন লক্ষ করা গিয়েছে। মূলত শাসকদলের অন্তর্দলীয় বিবাদ এবং দুর্নীতির নেতিবাচক প্রভাবে পঞ্চায়েত নির্বাচনে আলিপুরদুয়ার এবং ঝাড়গ্রাম দুটি লোকসভার অন্তর্গত বিভিন্ন ব্লকের ফলাফল কিন্তু তৃণমূলের বিপক্ষে গিয়েছিল। পাশাপাশি মালদা থেকে জলপাইগুড়ি বা দক্ষিণবঙ্গের অন্য জেলাগুলিতেও আদিবাসী এলাকাগুলিতে বিজেপি’র স্পষ্ট প্রভাব বৃদ্ধি লক্ষ করা গেছে। আলিপুরদুয়ার জেলা পরিষদের ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে তৃণমূল যেখানে ৪৮.৪৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে, বিজেপি’র সেখানে প্রাপ্ত ভোট ৩৬.১৬ শতাংশ। আবার ঝাড়গ্রাম জেলা পরিষদে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট যেখানে ৪৯.৬১ শতাংশ, বিজেপি’র প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪০.১১ শতাংশ। পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও আলিপুরদুয়ার এবং ঝাড়গ্রাম জেলায় বিজেপি যে ফলাফল করেছে তা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, রাজ্যের দুটি তফসিলি জনজাতি কেন্দ্রেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।