সঠিক বন্ধু নির্বাচন আবশ্যক। কর্মরতদের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মক্ষেত্রে বদলির কোনও সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। শেয়ার ... বিশদ
গত শুক্রবার হাতেনাতে তার প্রমাণ আর একবার মিলল। প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ শুক্রবার সকালে ওড়িশার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেড়-দুশো কিলোমিটার বেগে বেশ কয়েক ঘণ্টা দাপিয়ে বেড়াল বটে, ভাঙচুরও করল অনেক—কিন্তু মানুষের প্রাণ বিশেষ কাড়তে পারল না। গোটা ওড়িশায় মাত্র আট হতভাগ্যের প্রাণ নিয়েই এ যাত্রায় ফণীকে বিদায় নিতে হল। অথচ, এর আগে এই শতকের শুরুর কয়েক মাস আগে ১৯৯৯ সালের ২৯ অক্টোবর ওড়িশায় যে সুপার সাইক্লোন হয়েছিল তাতে ধ্বংসের ছবি আর মৃত্যুর সংখ্যা প্রকৃত অর্থেই মর্মান্তিক পর্যায়ে পৌঁছেছিল। মৃত্যু ছাড়িয়ে ছিল দশ হাজার, ২৫ লক্ষেরও বেশি মানুষকে গৃহহীন করে ধূলিসাৎ হয়েছিল সাড়ে তিন লাখের মতো বাড়িঘর। এই বিরাট ক্ষয়ক্ষতির কারণ ছিল একটাই—প্রকৃতির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে উপযুক্ত তথ্যের অভাব। সেদিন তার সুযোগেই অসহায় অপ্রস্তুত ওড়িশায় অমন কালান্তক হত্যালীলা চালাতে পেরেছিল সুপার সাইক্লোন।
এবার সেই সুপার সাইক্লোনের দোসর ফণী কিন্তু তার ধারেকাছেও পারল না! পারল না কেবল ওড়িশায় নয়—পারল না তার গতিপথে পড়া পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশেও। ওড়িশায় অবশ্য তাণ্ডবে কিছুটা সফল হয়েছে ফণী কিন্তু প্রাণ নিতে তেমন পারেনি। আর পারল না তার কারণ যে তার উগ্র বিধ্বংসী চলন সম্পর্কে অনেক আগে থেকে পেতে থাকা বিপদবার্তা এবং সুপার সাইক্লোনের পর ভবিষ্যৎ বিপর্যয় মোকাবিলায় নেওয়া ওড়িশা সরকারের পদক্ষেপগুলি—তাতে সন্দেহ কী? এবার তো পুরী সমেত ওড়িশার সমুদ্রপাড় ফণী আসার বহু আগে খালি করে দেওয়া হল, বিশেষ ট্রেনে পর্যটকদের নিরাপদে বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা হল, হোটেল অফিস-কাছারি দোকানবাজার মায় বিমানবন্দর অব্দি বন্ধ রাখা হল। এমনকী জগন্নাথদেবের মন্দিরের ধ্বজাও ফণীর আসার আগে খাটো করে দেওয়া হল। ফলে, প্রায় জনশূন্য বন্ধ হাটবাজার, দোকানপাটের পুরীতে বা সতর্ক ভুবনেশ্বর কটক বালেশ্বরের মতো জায়গাগুলোতে দাপিয়ে বেড়ালেও বড় সংখ্যায় প্রাণহানি ঘটাতে ব্যর্থ হল ফণী। তবে তার ছোবলে এয়ারপোর্ট রেলস্টেশন হোটেল রেস্তরাঁ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মতো কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দোকানপাট বাড়িঘর লণ্ডভণ্ড হল। ক্রেন ভেঙে পড়ল বসত বাড়ির উপর, মোবাইল টাওয়ার উপড়ে গেল। গাছপালা খেতখামারের কিছু ক্ষতি হল এবং সবমিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণও মোটেই কম নয়। তবে, যা আশঙ্কা ছিল তার চেয়ে এবার ক্ষতি হয়েছে অনেক কম—সেটা বিশেষজ্ঞ তথ্যভিজ্ঞজনেরা কিন্তু স্বীকার করছেন।
পাশাপাশি বিশেষজ্ঞরা এটাও বলছেন, পশ্চিমবঙ্গে ঢুকেও ফণী এবার বিশেষ ক্ষতি করতে পারত না। ফণীর হাওয়ার জোর যদি ঘণ্টায় দেড় দুশো কিলোমিটার থাকত তাহলে ওড়িশার মতো ক্ষয়ক্ষতি হতো ঠিকই তবে প্রাণহানি হতো না। ফণী আসার খবর পাওয়ামাত্র যুদ্ধকালীন তৎপরতায় যেভাবে এবার মমতা-প্রশাসন বিপর্যয় মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং দীঘা শঙ্করপুর মন্দারমণির মতো রাজ্যের সমুদ্র উপকূলবর্তী পর্যটনকেন্দ্রগুলি থেকে পর্যটকদের নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করেছে, যেভাবে বিপজ্জনক বাড়ি বা এলাকার মানুষজনকে আগেভাগে রেসকিউ সেন্টারে তুলে এনেছে, যেভাবে পুলিস পুরসভা দমকল ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলি কোমর বেঁধে ঝড়ের মোকাবিলায় একজোট হয়ে নেমে পড়েছে, তা অনেকের কাছেই রাজ্যে নজিরবিহীন বলে মনে হয়েছে। অনেকের কথা শুনে মনে হয়েছে—মমতার বিপর্যয় মোকাবিলা প্রস্তুতি রাজ্যবাসীর মনে এই আত্মবিশ্বাসটা জাগিয়ে দিয়েছিল যে ঘূর্ণিঝড় ফণী আর যা-ই হোক আয়লার মতো তাঁদের সর্বনাশ করতে পারবে না। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর প্রশাসনের সর্বাত্মক চেষ্টায় তাঁরা এবার আগেভাগেই সুরক্ষিত এবং সচেতন। সে জন্য মমতা বিরোধী থেকে পথঘাটের সাধারণ—বহুজনই স্বীকার করছেন, ঝড়, শেষপর্যন্ত তার ভয়াল রূপ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বুকে ছোবল না মারলেও তার মোকাবিলায় মমতা যে তৎপরতা দেখিয়েছেন তা তুলনারহিত। ফণী-বিপর্যয় মোকাবিলার প্রস্তুতিতে ফুল মার্কস মমতার।
আসলে মনে হয়, আয়লার মারাত্মক স্মৃতি এখনও বহুমনেই পুরনো ঝাপসা দুঃস্বপ্নের মতো লেগে আছে। সামান্য কয়েক মুহূর্তের ঝড়ে সেদিন কীভাবে চুরমার হয়ে গিয়েছিল কলকাতা, ভেসে গিয়েছিল সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা, বাঁধভাঙা নোনাজলে কীভাবে ছারখার হয়ে গিয়েছিল একর একর খেতখামার, হারিয়ে গিয়েছিল কত বাড়িঘর সংসার কত মানুষ মুহূর্তে নিঃস্ব হয়ে প্রাণ বাঁচাতে ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়েছিলেন অসহায়—সেই ব্যথার অতীত কি সহজে ভোলার! আর সরকার?! সেদিন রাজ্যের সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাম সরকার ও তার প্রশাসনের কিংকর্তব্যবিমূঢ় দিশেহারা ভাবটিও কি ভোলার! গোটা রাজ্যে সেদিন প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় বলতে কি কোনও ব্যবস্থাই যে ছিল না। গাছ পড়ে কলকাতা অচল হয়ে থেকেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। উপায় নেই। কোথায় ইলেকট্রিক করাত, কোথায় গাছ সরিয়ে রাস্তা সাফ করার আধুনিক সরঞ্জাম? সরঞ্জাম বলতে কুড়ুলের মতো পুরনো হাতিয়ার! যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি অথচ কাজ হচ্ছে ঠুকঠুক করে। নোনা জলে ঘরবাড়ি ভেসে গেছে, একচিলতে বাঁধের ওপর খোলা আকাশের নীচে আশ্রয় নিয়েছে হাজার হাজার—রেসকিউ সেন্টারের নামগন্ধ নেই রাজ্যে—তাঁরা যাবেন কোথায়? আয়লা বিধ্বস্তদের হাতে সামান্য খাবার, পানীয় জল তুলে দিতে চাইলেও দেওয়ার উপায় নেই—রাস্তাঘাট গাছ পড়ে বন্ধ না হয় ঝড়জলের তোড়ে এমনভাবে ভেঙেছে যে উপদ্রুত এলাকায় যাওয়াই যাচ্ছে না!
সেই ভয়ঙ্কর অতীতের পাশে আজকে মমতার উদ্যোগকে রাখলে যে কেউই আশ্বস্ত বোধ করবেন, প্রকৃতির তাণ্ডবের মুখে দাঁড়িয়েও হিম্মত হারাবেন না—তা বলাই বাহুল্য। অবশ্য, মমতা প্রথম থেকেই বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষের হয়ে লড়েন। সে আমরি বা পার্ক স্ট্রিটের বহুতলে অগ্নিকাণ্ডই হোক কি মেছুয়া বা মাঝেরহাটের ব্রিজ বিপর্যয় মা-মাটি-মানুষের নেত্রী সবসময় সবার আগে, সবার পাশে অতন্দ্র সক্রিয়। ভাবুন তো, মুখ্যমন্ত্রী মমতা স্বয়ং রাত জেগে মনিটরিং করছেন, তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য, পুরসভার মেয়র থেকে শুরু করে ছোটবড় নেতানেত্রীরা ঝড়ের অপেক্ষায় পথে নেমেছেন—পরস্পর যোগাযোগ রেখে ঝড়ের গতিবিধির খোঁজখবর নিচ্ছেন—ঝড় তাণ্ডব করে যাওয়ার অব্যবহিত পর থেকে কী কী করতে হবে তা বারবার ঝালিয়ে নিচ্ছেন—এমন দৃশ্য কলকাতা কবে দেখেছে? সিপিএমের ৩৪ বছরে কিছু কেউ করেননি এমন কখনওই বলব না। কিন্তু, বিপদের মুখে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সিপিএমের মুখ্যমন্ত্রীরা বা তাঁদের সহকর্মীরা কে কবে এভাবে রাত জেগে জনপদ পাহারা দিয়েছেন?! মানুষকে ক্রমাগত সাহস জুগিয়ে চলেছেন?
এ কথা ঠিক, এবার ফণী বাংলায় প্রাকৃতিক কারণেই তেমন কোনও প্রভাব বিস্তার করতে পারল না। শনিবার সকালে আকাশের খানিকটা প্রসন্ন মুখ দেখে মানুষ বিপদ কেটে গেছে বুঝে আশ্বস্ত হলেন। ফণীর আগমন সংবাদে থমকে যাওয়া ভোটযুদ্ধের ময়দানেও হয়তো শনিবারের এক ঝলক রোদ ফের দামামা বাজিয়ে দেবে, পঞ্চমদফার প্রচারে সরগরম হয়ে উঠবে ভোটবাজার। কিন্তু, দিনের শেষে সত্য এটাই যে ভবিষ্যৎ ফণীর সম্ভাবনা থেকেই যাবে—হয়তো অন্য নামে অন্য ধাঁচে। সুতরাং, আজ রেহাই মিলেছে বলে কাল যে বিপদ এসে সামনে দাঁড়াবে না, তছনছ করে দেবে না আমাদের ঘরসংসার—এমন গ্যারান্টি কোথায়? নেই। আর নেই বলেই একটা জোরদার অত্যাধুনিক বিপর্যয় মোকাবিলা ব্যবস্থার প্রয়োজন সবসময় বহাল থাকছে। রাজ্য জুড়ে ব্যাপক উন্নয়নের মাঝে সেই ব্যবস্থাটাও মুখ্যমন্ত্রী মমতা করে ফেলেছেন। ফুল মার্কস মমতা। বাংলার মানুষকে এবার সেটাই কি জানিয়ে গেল দুরন্ত ফণী!