একবার একজন ভক্ত জপ করিয়াও মনে শান্তি পাইতেছে না বলিয়া শ্রীমার নিকট দুঃখ প্রকাশ করে এবং মন্ত্র জপ না করিলে শ্রীগুরুর অনিষ্ট হয় বলিয়া সে মন্ত্র শ্রীমাকে প্রত্যর্পণ করিতে চাহিল। তাহা শুনিয়া শ্রীমা বলিলেন: “দেখ, একি কথা! তোমাদের জন্য যে আমি ভেবে ভেবে অস্থির হলুম। ঠাকুর তোমাদের যে কবে (পূর্বেই) দয়া করেছেন।” বলিতে বলিতে শ্রীমার দুই চক্ষু অশ্রুতে ভরিয়া উঠিল। শ্রীমা আবেগের স্বরে বলিলেন: “আচ্ছা, তোমাকে আর মন্ত্র জপ করতে হবে না”। ইতিমধ্যে ভক্তের হৃদয়ে চেতনার উদয় হইয়াছে। সে আতঙ্কিত হইয়া বলিয়া উঠিল: “মা আমার সব কেড়ে নিলেন। এখন আমি কি করি? তবে কি মা, আমি রসাতলে গেলুম?” শ্রীমা তৎক্ষণাৎ দৃঢ়তার সহিত অভয়মন্ত্র শুনাইয়া তাহাকে বলিলেন: “কি, আমার ছেলে হয়ে তুমি রসাতলে যাবে? যারা এখানে এসেছে আমার ছেলে, তাদের মুক্তি হয়ে আছে। বিধির সাধ্য নেই যে, আমার ছেলেদের রসাতলে ফেলে। আমার ওপর ভার দিয়ে নিশ্চিত থাকো। আর,—এটা সর্বদা স্মরণ রেখো যে, তোমাদের পিছনে এমন একজন রয়েছেন যিনি সময় আসলে তোমাদের সেই নিত্যধামে নিয়ে যাবেন”। কি স্নেহপূর্ণ সেই বাণী! শ্রীমার শান্তিময় আশ্বাস লাভ করিয়া ভক্ত শান্ত হইল। এজন্যই বলি যে, বিশ্বরূপিণী শ্রীসারদাদেবী একাধারে ছিলেন জননী, গুরু ও দেবতা। মানবীর বেশে ছিলেন শ্রীমা করুণার জাহ্নবীধারা! বাগবাজারে উদ্বোধনের বাটীতে একবার শেষ অসুখের সময় এক ভক্তকে শ্রীমা বলিয়াছিলেন: “তোমরা কি মনে করো—যদি ঠাকুর (নিজের দিকে দেখাইয়া) এ শরীরটা না রাখেন তাহলেও যাদের ভার নিয়েছি তাদের একজনও বাকী থাকতে আমার ছুটি আছে? তাদের সঙ্গে থাকতে হবে তাদের ভালমন্দের ভার যে নিতে হয়েছে। মন্ত্র দেওয়া কি চারটিখানি কথা! কত বোঝা ঘাড়ে তুলে নিতে হয়, তাদের জন্য কত চিন্তা করতে হয়। এই দেখ না, তোমার বাপ মারা গেলেন, আমারও মনটা খারাপ হ’ল। মনে হ’ল, ছেলেটাকে ঠাকুর কি আবার একটা পরীক্ষায় ফেললেন? কিসে ঠেলে-ঠুলে বেঁচে উঠবে—এই চিন্তা। সেইজন্যই তো এত কথা বললুম। তোমরা কি সব বুঝতে পার? যদি তোমরা সব বুঝতে পারতে, আমার চিন্তার ভার অনেক কমে যেত। ঠাকুর নানান ভাবে নানান জনকে খেলাচ্ছেন, টাল সামলাতে হয় আমাকে। যাদের নিজের বলে নিয়েছি, তাদের তো আর ফেলতে পারিনে।” গুরু-শিষ্য-সম্পর্ক যে অনন্তকালের একথাই শ্রীমা অতিসহজ সরল কথায় সেইদিন সকলকে বুঝাইয়া দিয়াছিলেন।
শ্রীমার প্রকৃত সন্তানবাৎসল্যের নিদর্শনস্বরূপ আর একটি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করি। একবার জয়রামবাটীতে শ্রীমার নিকট স্বামী বিশ্বেশ্বরানন্দ মহারাজ আসিয়াছেন। তিনি আহারের পর তাঁহার উচ্ছিষ্ট দ্রব্য তুলিতে যাইবেন এমন সময়ে শ্রীমা হাত ধরিয়া তাঁহাকে বাধা দিয়া থালাখানি নিজেই তুলিয়া লইলেন। বিশ্বেশ্বরানন্দ মহারাজ সবিস্ময়ে বলিলেনঃ “মা, আপনি কেন? আমিই নিচ্ছি।” শ্রীমা তাহাতে বলিলেন: “আমি তোমার আর কি করেছি? মার কোলে ছেলে বাহ্যে করে, কত কি করে। তোমরা দেবের দুর্লভ ধন”। সেই সময়ে শ্রীমার নিকট অন্য যে সকল স্ত্রীভক্তরা থাকিতেন তাঁহারা শ্রীমার সেই ধরনের আচরণ বা ব্যবহার ঠিক পছন্দ করিতেন না, উপরন্তু সময়ে সময়ে অনুযোগ করিয়াও শ্রীমাকে বলিতেন: “তুমি বামুনের মেয়ে, আবার গুরু, এরা তোমার শিষ্য। তুমি এদের এঁটো নাও কেন? এতে যে এদেরই অমঙ্গল হবে”। শ্রীমা হাস্য করিয়া সহজভাবে তাহাদিগের কথার উত্তর দিয়া বলিতেন: “আমি যে মা গো। মা ছেলের করবে না তো কে করবে?”
‘বিশ্বরূপিণী মা সারদা’ থেকে