ইউনিভার্সাল হেলথেকয়ার বা সকল নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে উন্নত কিছু দেশ। তাদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রণী হল নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, কানাডা, ব্রিটেন প্রভৃতি। বিষয়টিকে নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের নিছক কর্তব্যপালন হিসেবে তারা দেখে না, তার দ্বারা কেবল নাগরিকের মৌলিক অধিকার আদায় হয় না, বিষয়টি বরং অনেক বেশি অর্থনৈতিক। একটি দক্ষ স্বাস্থ্যব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে অপরিমেয় অবদান রাখতে সক্ষম। কারণ এই ব্যবস্থা সুস্থ সবল নাগরিক গড়ার লক্ষ্য নিয়ে এগতে থাকে। সেই নাগরিকই তাঁর সবটা উজাড় করে দিয়ে মাথা খাটাতে পারেন এবং আনন্দের সঙ্গে কাজ ও গবেষণা করতে পারেন, যিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ সবল। এই ব্যবস্থার প্রত্যক্ষ ও ইতিবাচক প্রভাব পড়ে উন্নয়ন এবং শিল্পায়নে। মৃত্যুহার হ্রাসের পাশাপাশি নাগরিকের গড় আয়ু বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও সকলের জন্য স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিশেষভাবে কার্যকরী হয়ে থাকে। এই পুরো বিষয়টি বহু দেশে এক প্রমাণিত সত্য।
সব জেনেও ভারত এই মডেল কখনও অনুসরণ করেনি। তার ফলে বর্তমানে দেশে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মোট ব্যয়ের পরিমাণ জিডিপির ১.৯ শতাংশ মাত্র। তাও এই ছবি বাজেট বরাদ্দ এবছর কিছুটা বৃদ্ধির পর। ২০১৭ সালে ঘোষিত জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিতে দাবি করা হয়েছিল যে, স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয় বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ভিতরে জিডিপির ২.৫ শতাংশ করা হবে। মোদি সরকার এই সামান্য লক্ষ্যপূরণেও নিজেকে ‘অযোগ্য’ বলে চিহ্নিত করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশ ভারত স্বাস্থ্য পরিষেবায় অন্যদের চেয়ে কতটা পিছনে রয়েছে? কয়েকটি দেশের ছবি (বন্ধনীতে প্রদত্ত সংখ্যাগুলিকে জিডিপির শতাংশ হারের নিরিখে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হিসেবে পড়তে হবে) পাশে রাখলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১৬.৬), জার্মানি (১২.৭), সুইজারল্যান্ড (১১.৩), ফ্রান্স, কানাডা ও জাপান (১০), দক্ষিণ কোরিয়া (৯.৭)। গেরুয়া নেতারা মুখে ‘রামরাজ্য’ প্রতিষ্ঠার কথা বললেও তাঁদের নেতৃত্বে গত একদশকে ভারতের যে উত্তরণ ঘটেছে, তাতে উপরে বর্ণিত নামগুলি আমাদের কাছে রীতিমতো ‘স্বপ্নের দেশ’ই রয়ে গিয়েছে। এই স্বপ্ন কবে বাস্তবরূপ পাবে তার উত্তর ‘অমৃতকাল’-এর উদ্গাতাদের কাছেও নেই।
এই পরিতাপের কালে ভারতের মতো যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় একটি প্রান্তিক রাজ্য সরকারের পক্ষে সর্বোচ্চ যতটুকু করা সম্ভব, ২০১১ সাল থেকে সেটাই করে চলেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। একজন জনদরদি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ২০১২ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বহু হাসপাতালে ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান বা ফেয়ার প্রাইস শপ চালু করেন। প্রকল্পটি শুরু থেকেই সুপারহিট। তারপর মমতা এনেছেন সম্পূর্ণ বিনামূল্যের চিকিৎসা বা ফ্রি মেডিসিন, স্বাস্থ্যসাথীসহ একের পর এক নয়া ও ‘স্বাস্থ্যকর’ প্রকল্প। সেই স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেই ফের মারাত্মক মাস্টারস্ট্রোক দিতে চলেছেন জননেত্রী: ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলার ৩৪৭টি ব্লক এবং গ্রামীণ হাসপাতালও পাবে ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান। গ্রামবাংলাসমেত সারা রাজ্যে এমন দোকানের সংখ্যা বেড়ে হবে ৪৬০-এরও বেশি। পরিকল্পনায় রয়েছে, সুলভ মূল্যের অন্তত ১৪০টি ওষুধ ওইসব দোকানে মিলবে। বেঁচে থাকার জন্য বহু মানুষকে সুগার, থাইরয়েড, ব্লাড প্রেশার, হার্ট, পেট, কিনডি, চোখ, নার্ভসহ নানা রোগের ওষুধ নিয়মিত খেতে হয়। কিন্তু সেগুলির দাম এতই চড়া যে অনেকে সবসময় তা কিনতে পারেন না কিংবা একটু সাশ্রয়ের জন্য বেশি ডিসকাউন্টের ফার্মেসি খুঁজে হয়রান হন। এই পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রীর মানবিক সিদ্ধান্ত কতখানি স্বস্তিদায়ক তা ভেবে দেখার বিষয়। কারণ, রি-টেন্ডার করা পুরনো ন্যায্য মূল্যের দোকানগুলিতে অন্তত ৫০ শতাংশ ছাড়ে ওষুধ পাবেন রোগীরা। সর্বোচ্চ ডিসকাউন্ট মিলবে প্রায় ৮৬ শতাংশ। ব্লক হাসপাতালের দোকান থেকেও গ্রামের মানুষজন একইরকমভাবে উপকৃত হবেন। আগের ব্যবস্থার মতো এক্ষেত্রেও খেয়াল রাখতে হবে ওষুধের গুণমান যেন বজায় থাকে। কারণ নিম্নমানের সস্তার ওষুধ কোনও সমাধান নয়, তাতে বরং রোগীরই ক্ষতি। আশা করা যায়, সবদিকে সদাসতর্ক সরকার বিষয়টি মাথায় রেখেই জনস্বার্থবাহী প্রকল্পটির রূপায়ণে যত্নবান হবে।