২০ মার্চ, ২০২৩। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেন প্রশাসন প্রকাশ করেছিল ২০২২ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিসেস। তাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন ইস্যুতে বস্তুত ভারতের মোদি সরকারকে তুলোধোনাই করা হয়। বেআইনিভাবে ও নির্বিচারে হত্যা, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতাহরণ, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ এবং ধর্মীয় ও জাতিগত হিংসাবৃদ্ধির মতো গুরুতর অভিযোগগুলিই ছিল প্রধান। রিপোর্ট প্রকাশের পর এরিন বার্কলে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, ‘ভারতের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন।’ বাইডেন প্রশাসনে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং শ্রম বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত এই সহকারী সচিব জানান, মানবাধিকার রক্ষায় ভারতকে আরও যত্নবান হওয়ার জন্য তাঁরা আগেও বলেছেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ফের জোরের সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিরা ভারত এবং আমেরিকার নাগরিক সমাজের সঙ্গে নিয়মিত মিলিত হন। একে অপরের সঙ্গে মতামত বিনিময় করেন এবং দু’পক্ষের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছু শেখেনও তাঁরা। উপযুক্ত পদক্ষেপের জন্য ভারত সরকার যাতে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে, সেই ব্যাপারেও নয়াদিল্লিকে অনুপ্রাণিত করা হয়। ভারতে সরকারি কাজের সমস্ত স্তরে জবাবদিহিতার অভাব এতটাই যে দোষীদের রেহাই পেয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এই প্রসঙ্গে পুলিস এবং সংশোধনাগার বিভাগের তরফে যে নির্যাতন চলে তা অমানবিক। আটক এবং গ্রেপ্তারের অনেক ঘটনার সঙ্গেই আইন ও বিচারের কোনও সম্পর্ক নেই। নির্বিচারে সংঘটিত বহু অন্যায়ের খোলাখুলি সমালোচনাই করে আমেরিকা। ইন্টারনেট ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা, সমাবেশ-জমায়েতের উপর খবরদারি, মানুষে-মানুষে মেলামেশায় বাধা, প্রতিবাদ আন্দোলনের স্বাধীনতাহরণ প্রভৃতি নিয়েও ওই রিপোর্টে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। শরণার্থীদের অধিকার লঙ্ঘনের দিকেও আঙুল তোলে তারা। ভারতে সরকারি ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি নিয়ে রয়েছে আমেরিকার উদ্বেগ। তাদের আরও অভিযোগ ছিল, নানা অজুহাতে হয়রানি চলছে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলির। মার্কিন বিদেশমন্ত্রী টনি ব্লিঙ্কেনেরও বক্তব্য ছিল, ‘গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং শ্রমিকের অধিকার পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। গণতন্ত্রের ধারাবাহিক উন্নয়নের জন্য এই অধিকারগুলির অধিক সুরক্ষা জরুরি।’
বলা বাহুল্য, শুধরে যাওয়া দূর, মোদি সরকার এসব সমালোচনা গায়েই মাখেনি। এর অব্যবহিত পরই, ভারতের পার্লামেন্ট বেনজিরভাবে শতাধিক বিরোধী সাংসদকে সাসপেন্ড করে। এমনকী, প্রধানমন্ত্রীর কট্টর সমালোচক কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর এমপি পদ পর্যন্ত খারিজ করা হয়! আমেরিকা এই প্রশ্নেও ভারতের কড়া সমালোচনা করতে দ্বিধা করেনি। সব মিলিয়ে দেশের মর্যাদাহানির বিরাম নেই। তার ধারাবাহিকতা রক্ষাতেই যেন এবার সামনে এল ‘ইন্ডিয়া: দ্য রিলিজিয়াস ফ্রিডম ইস্যুজ’ (ভারত: ধর্মীয় স্বাধীনতার সমস্যা) শীর্ষক একটি রিপোর্ট। সম্প্রতি প্রকাশিত মার্কিন কংগ্রেসের এই রিসার্চ রিপোর্টে পরিষ্কার লেখা হয়েছে, গেরুয়া জমানায় ভারতে ধর্মীয় হিংসা চরমে পৌঁছেছে। মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলিমদের উপর হিংসার ঘটনা বেড়েই চলেছে। আমেরিকার কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিসের রিপোর্ট মার্কিন এমপিদের হাতে দেওয়া হয়। ধর্মীয় রাজনীতি ভারতে সামাজিক বিভেদ কীভাবে বাড়িয়েছে, তা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে রিপোর্টটিতে। ওইসঙ্গে এই আশঙ্কাও প্রকাশ করা হয়েছে যে, নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে এর বিরূপ প্রভাবই পড়তে পারে।
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশ দপ্তরের একাধিক রিপোর্ট মার্কিন কংগ্রেসে পেশ করা হয়। আর সেসবেই বেরিয়ে আসে ভারতে ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের কঙ্কালসার চেহারা। এ থেকে কেউ কেউ ভাবতে পারেন যে, তৃতীয় মোদি সরকারেরও দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। কিন্তু বিষয়টি অতটা হালকাভাবে নেওয়ার নয়। একটি নির্বাচিত সরকারের চূড়ান্ত পরিচয় দলীয় নয় কোনোভাবেই। যেমন ভারত সরকার এদেশের সব মানুষের—যাঁরা এনডিএ, বিজেপি বা নরেন্দ্র মোদিকে ভোট দেননি তাঁদের ক্ষেত্রেও একথা সমানভাবে প্রযোজ্য। সরকারের ভালো-মন্দ, উত্থান-পতন, খ্যাতি-অখ্যাতির ভাগ দেশের সবার। তাই এই বিষয়ে প্রতিটি নাগরিকের উদ্বেগ থাকা স্বাভাবিক। এই অপমান তাঁদেরও সবার। একের পর এক আন্তর্জাতিক রিপোর্টে, বছরের পর বছর ভারতের এই যে মলিন ছবি প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে এটাই প্রমাণ হয় যে ভারত ‘নামেই তালপুকুর ঘটি ডোবে না’। বৃহত্তম গণতন্ত্রের মর্যাদা উদ্ধার করতে ভারতকে আগামী দিনে বহু বহু অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। সবকিছুকে পাশ্চাত্যের ঈর্ষা কিংবা অন্যায় সমালোচনা বলে ফের উড়িয়ে দিলে ভারতের বাস সেই তিমিরেই রয়ে যাবে। এমনকী, সাগরপারে প্রেসিডেন্ট পরিবর্তনেও ভারত সম্পর্কে আমেরিকার জনগণ এবং প্রশাসনের মূল্যায়ন বদলে যাবে না।