সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (আইএমএফ) তাদের ওয়ার্ল্ড ইকনমিক আউটলুক রিপোর্টে জানিয়েছে, পৃথিবীর শীর্ষ দশটি অর্থনীতির তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ অদলবদল আসন্ন। আর সেখানে সুখবর থাকছে ভারতের জন্য। আইএমএফের অনুমান, ২০২৫-এ সর্বোচ্চ আসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই ধরে রাখবে। তাদের জিডিপির পরিমাণ বেড়ে হবে ২৯,৮৪০ বিলিয়ন ইউএস ডলার। ২০২৪-এ চীনের জিডিপির পরিমাণ ১৮,৫৩৩ ইউএসডি। জিন পিংয়ের দেশ সেটা ২০২৫-এ বাড়িয়ে ১৯,৭৯০ ইউএসডি করতে চলেছে। তার সুবাদে বিশ্ব অর্থনীতির দ্বিতীয় কর্ণধার ফের তারাই থাকছে। থার্ড লার্জেস্ট ইকনমি গণ্য হবে জার্মানি (৪,৭৭২ ইউএসডি)। তার পরের জায়গাটাই দখল করার জন্য তৈরি এখন ভারত। জাপানকে সরিয়েই ভারত হতে চলেছে চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি। কিন্তু ভারতের নমিনাল জিডিপির পরিমাণ বেড়ে কত হবে? মাত্র ৪,৩৪০ মার্কিন ডলার! পঞ্চম স্থানে নেমে যাওয়া জাপানের জিডিপি থাকবে ৪,৩১০ ইউএসডি। তার নীচের দেশগুলি যথাক্রমে ইউকে, ফ্রান্স, ব্রাজিল, ইতালি, কানাডা, মেক্সিকো, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কোরিয়া প্রভৃতি।
আর এখানেই প্রশ্ন, পজিশন ১ বৃদ্ধির পরও ভারতজুড়ে যে কোটি কোটি রামা কৈবর্ত, গফুর মিয়াঁ রয়েছেন, তাঁদের মুখের হাসি চওড়া হবে কতটা? উপরের হিসেবেই তা পরিষ্কার: প্রথমত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জনসংখ্যার চাপে নুয়ে রয়েছে ভারত। ভারতবাসীকে ‘মানবসম্পদ’-এ রূপান্তরিত করার কোনও প্রয়াস নেই। তার উপর ধনবৈষম্য এত ব্যাপক ও বর্ধমান যে নীচের তলার মানুষের দৈন্য হ্রাসের যাবতীয় লক্ষণই অধরা। এরপর আসছে জিডিপির তুলনামূলক আলোচনা। প্রথম ও দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির জিডিপির সঙ্গে ভারতের ফারাক বস্তুত আশমান-জমিন। ফলে সুতীব্র ধনবৈষম্যের ছবিটা মাথায় রেখে ভারতের জিডিপিকে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে যা দাঁড়াবে তাতে আর যাই হোক আমাদের হতাশা বই কোনও কিছুই বাড়বে না। ভারতের নীচে যেসব অর্থনীতি থাকছে, তাদের জনসংখ্যা এতই কম এবং সংহত যে তারা সর্বার্থেই ভারতের পাশে অতিশয় অগ্রণী বলে বিবেচিত হবে। আমাদের অর্থনীতি ‘নিম্ন-মধ্য’ আয়ের স্তরেই ঘুরপাক খাবে এখনও বহু বছর। ‘উন্নত বিশ্ব’-এর পংক্তিভুক্ত হওয়া বা ‘অমৃতকাল’ স্পর্শ করার স্বপ্নের বাস্তবায়ন, সেও এক স্বপ্নমাত্র! কারণ ‘মধ্য’ আয়ের দেশের স্তরে পৌঁছনোটাই ভারতের জন্য, হলফ করে বলা যায়, বিরাট বিরাট বিরাট ... এক চ্যালেঞ্জ! এটাই যখন নির্মম বাস্তব, তখন ভারতের অভিভাবক দেশকে ঋণের আরও সুউচ্চ পাহাড়চূড়ায় বসানোর তোড়জোড় করছেন। চলতি অর্থবর্ষের শেষেই আমাদের ঋণের বহর দাঁড়াবে ১৮৫ লক্ষ কোটি টাকা। স্বভাবতই বাড়বে সুদেরও বোঝা। চলতি অর্থবর্ষের প্রথম সাতমাসে সুদ মেটাতে হয়েছে ৬ লক্ষ কোটি টাকার। ঋণ এবং সুদ বৃদ্ধির এই প্রবণতা বজায় থাকলে বাজেটে এই খাতে ব্যয় সাড়ে ১১ লক্ষ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করবে।
তাই পরবর্তী বাজেট প্রস্তুতি নেমে আয়বৃদ্ধির চিন্তায় মাথার চুল ছিঁড়ছে অর্থমন্ত্রক। ঘাটতি কমাতে দুটি সহজ পথ নিয়েই ভাবনাচিন্তা চলছে: ভর্তুকি ছাঁটাই এবং করবৃদ্ধি। যদিও ভর্তুকির ক্ষেত্রগুলি ক্রমে ছোট করে আনা হয়েছে। ভাবখানা এমন যেন, পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত হওয়ামাত্রই ভারতবাসী যাবতীয় অর্থসংকট কাটিয়ে উঠেছে! অথচ নামে তালপুকুর ঘটি ডোবে না, প্রবাদের এর চেয়ে লাগসই দৃষ্টান্ত সত্যিই কম মেলে। এই ভ্রান্ত অর্থনীতির প্রথম ও প্রধান শিকার গরিব এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এরপর করবৃদ্ধির জন্য মধ্যবিত্তকে জবাই তো চলছেই। কারণ তাদের প্রতিবাদ উপেক্ষা করা গেরুয়া পার্টির কাছে জলভাত ব্যাপার আর কী! কিন্তু রাজকোষের শ্রীবৃদ্ধি এবং ধনবৈমষ্য হ্রাসের যুক্তিগ্রাহ্য ও কল্যাণকর সমীকরণে এই সরকার কোনোভাবেই নজর দিতে রাজি নয়। জনগণের নাম ভাঁড়িয়ে দিল্লিতে বেনিয়ার সরকার প্রতিষ্ঠার মাশুলই গুনছে দেশবাসী। এবার ঋণের বোঝা বৃদ্ধির দায়ও চাপবে সাধারণের নড়বড়ে গ্রীবায়। একদিকে বাড়বে জিনিসের দাম, অন্যদিকে কমতে থাকবে কর্মসংস্থান এবং শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি। সব মিলিয়ে জোড়া ফলায় বিদ্ধ হবেন সম্ভাব্য চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির বেচারা শরিকরা।