কাজকর্মে আকস্মিক বিঘ্ন ও ভোগান্তি। আইনজীবী ও মুদ্রণ, কাগজ ও কৃষিজ পণ্যের ব্যবসায়ীদের শুভদিন। ... বিশদ
বাহানাগা কাণ্ডে যখন পিছন ফিরে দেখার পর্ব চলছে, ঠিক তখনই এই দুর্ভাগ্য নেমে এল রেলযাত্রীদের জীবনে। একবছর আগের ঘটনার সূত্রে সামনে এসেছে এক করুণ কাহিনি। শেখ জামাল্লুদিন নামে এক যুবক চেন্নাইয়ের উদ্দেশে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় তাঁর স্ত্রী মাফোজাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, মোটা আয়-রোজগার করেই বাড়ি ফিরবেন তিনি। মাফোজাকে নিয়ে যাবেন নামী স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। কারণ সতেরো বছরের বিবাহিত জীবনে তাঁরা নিঃসন্তান। মাফোজার এই মনোকষ্ট এবার ঘোচাবেন বলেই কথা দিয়েছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার জামাল। স্বামীর আশ্বাসে আশায় বুকও বেঁধেছিলেন স্ত্রী। কিন্তু তা চুরমার হতে তাঁদের চব্বিশ ঘণ্টাও লাগেনি। রাজমিস্ত্রিদের এগারো সদস্যের একটি দলে সেদিনের করমণ্ডলে ছিলেন জামালও। সেই ট্র্যাজেডির ঠিক একবছর পরও মাফোজা অবশ্য অপেক্ষায় রয়েছেন। কারণ দুর্ঘটনাস্থল, হাসপাতাল এবং অস্থায়ী মর্গে হাজার খোঁজাখুঁজি করেও জামালের দেহ মেলেনি। বেওয়ারিশ সংরক্ষিত লাশগুলির কোনোটিরই সঙ্গে ম্যাচ করেনি জামালের বাবার ডিএনএর নমুনা। সৎকারের জন্য স্বামীর দেহটাও হাতে পাননি বলে মাফোজা নিজেকে সবচেয়ে হতভাগিনী ভাবেন। একই কারণে, বলা বাহুল্য, সরকারি নিয়মে তাঁকে কোনও আর্থিক ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। বাহানাগা কাণ্ডে এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতা কেবল মাফোজার নয়, আরও বেশকিছু পরিবারের হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে বাংলারও একাধিক পরিবার। তখনই সবাই নিশ্চিত ছিল যে বালেশ্বর ট্রেন দুর্ঘটনার স্মৃতি দেশবাসীকে বহুদিন তাড়া করে বেড়াবে। কারণ মৃত্যুর চেয়ে পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকার যন্ত্রণা বহুগুণ। আর যেসব পরিবার অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রিয়জনের জীবন-মৃত্যুর মাঝে রয়ে গিয়েছে, তাদের কষ্টের কথা তো বর্ণনার অতীত!
প্রতিবছর দেশে একাধিক বড় রেল দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। প্রত্যেকবারই প্রত্যাশা থাকে যে, কালো অতীত থেকে উপযুক্ত শিক্ষা নেবেন রেল কর্তৃপক্ষ এবং আগামী দিনের সমস্ত রেলযাত্রা সুন্দর ও নিরাপদ হয়ে উঠবে। কিন্তু সেদিনের প্রতীক্ষা ফুরোয় না ভারতবাসীর—ঘটতেই থাকে নিত্যনতুন দুর্ঘটনা। এর প্রধান কারণ সমস্যার মূল খোঁজার চেষ্টা এদেশের সংস্কৃতির অঙ্গ নয়। প্রথমেই, যাবতীয় দায় এড়াবার এবং সেসব অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে গদিরক্ষার মরিয়া চেষ্টা চলে। এবারও তার ব্যতিক্রম কিছু দেখা গেল না। এমন একটি দুর্ঘটনার কারণ অবশ্যই তদন্তসাপেক্ষ, একটি বালকও তা জানে। তবু ঘটনার পরপরই রেল বোর্ডের চেয়ারপার্সন জয়া ভার্মা সিনহা মন্তব্য করলেন, ‘মালগাড়ির চালক সিগন্যাল অমান্য করাতেই এই দুর্ঘটনা!’ ভারতীয় ট্র্যাডিশন বলে যে, চটজলদি একটি ‘বলির পাঁঠা’ পাওয়া ক্ষমতার আসনের জন্য জরুরি। কাঞ্চনজঙ্ঘা দুর্ঘটনায় এমন একজনকে ‘বলির পাঁঠা’ করা হল, যিনি ‘ব্যা ব্যা’ পর্যন্ত করতে পারবেন না, কারণ ঘটনাস্থলেই প্রাণ গিয়েছে তাঁর! প্রত্যাশা ছিল, একের পর এক দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতাতেও যিনি মন্ত্রক পরিচালনায় সামান্য যোগ্য হয়ে উঠতে পারলেন না, সেই রেলমন্ত্রী অবিলম্বে পদত্যাগ করবেন কিংবা প্রধানমন্ত্রীই সরিয়ে দেবেন তাঁকে। কিন্তু তা হল না এবং হওয়ারও নয়। বিশেষজ্ঞরা অবিলম্বে এই দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করুন। তাতে রেল বিভাগের সীমাহীন গাফিলতিই যে চিহ্নিত হবে তাতে সন্দেহ কী? সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণে সরকার কতটা কঠোর ও নিরপেক্ষ হতে পারবে সেই সন্দেহ থেকেই যায়। কারণ, অতীতের বহু দুর্ঘটনা এবং বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তির ক্রমোন্নতি থেকেও কিছুমাত্র শিক্ষা না-নেওয়ার দায় সবচেয়ে উঁচু আসনের উপরই বর্তাবে।