কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ। যোগাযোগ রক্ষা করে চললে কর্মলাভের সম্ভাবনা। ব্যবসা শুরু করলে ভালোই হবে। উচ্চতর ... বিশদ
আপনি তো বিখ্যাত পরিবারের ছেলে? কোথায় জন্মেছিলেন?
আমি ১৯৩৯ সালে কলকাতার কালী দত্ত স্ট্রিটে জন্মেছি। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। আমার মা প্রভাদেবী সেকালের মঞ্চ ও সিনেমার খ্যাতিমান অভিনেত্রী ছিলেন। আমার জ্যাঠামশাই ছিলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ী। শিশিরকুমারের দ্বিতীয় ভাই তারাকুমার ভাদুড়ী ছিলেন আমার বাবা। তিনিও সিনেমায় অভিনয় করতেন। আমার বোন বিখ্যাত মঞ্চাভিনেত্রী, সুগায়িকা কেতকী দত্ত।
তার মানে আপনি শিশিরবাবুকে দেখেছেন, আর তাঁর শ্রীরঙ্গম?
আগে তো নাম ছিল নাট্যনিকেতন, শিশির জ্যাঠামশাই হলটা লিজ নিয়ে নাম পাল্টে রাখলেন শ্রীরঙ্গম। রায়টের সময় অনেক স্টেজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় শ্রীরঙ্গম হলে শরৎচন্দ্রের ‘বিন্দুর ছেলে’ নাটক হত। তাতে অমূল্যর ছোট বয়সটা একটি ছেলে অভিনয় করত। আর বড় বয়সটা করতো আমার বোন কেতকী। ও তখন ছেলের চরিত্রেই অভিনয় করতো। ছেলেবেলার রোলটা যে ছেলেটা করতো সে অসুখের কারণে একদিন আসতে পারেনি। তখনকার দিনে শিশির ভাদুড়ী, অহিন্দ্র চৌধুরী, ছবি বিশ্বাস, রাণীবালা, সরযূবালা দেবীর মতো অনেক নামকরা অভিনেতা অভিনেত্রী অভিনয় করতেন। আমি নিয়মিত তাঁদের অভিনয় দেখতাম। দেখে দেখেই ডায়লগ, কমপজিশন ইত্যাদি সবই আমার মাথার মধ্যে ছিল। তো সেদিন যখন অভিনয় শুরু হতে ২০ মিনিট বাকি তখন মা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তখন আড়াইটে কি পৌনে তিনটে হবে। শ্রীরঙ্গম থেকে আমাদের বাড়িটা ছিল খুব কাছেই। গেলাম শ্রীরঙ্গমে। মা বললেন আজকে এই নাটকে বিন্দুর ছেলের পার্টটা তুই করতে পারবি ? আমি বললাম হ্যাঁ পারব। মা বললেন প্রম্পটার যেমন বলে দেবে শুনে তেমন বলবি। যখন পর্দা উঠলো তখন কিন্তু আমার অভিনয় করতে ভয় করল না। এই প্রথম আমি মঞ্চে অভিনয় করলাম। অভিনয়ের পারিশ্রমিক হিসেবে তিনি আমাকে পাঁচ টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকাটা ওড়াতে ওড়াতে আমি বাড়ি ফিরেছিলাম।
শিশিরবাবুর কোনও স্মৃতি?
তখনও বিশ্বযুদ্ধ চলছে, মাথার ওপর জাপানি বিমান, সাইরেন বাজছে। এই সময় আমরা শ্রীরঙ্গমে থাকতাম। এর ভেতরে একটা বিরাট বাড়ি ছিল। ভিতরের এই অংশটাকে সবাই ভিতর বাটি বলত। শিশিরজ্যাঠার আলাদা একটা ঘর ছিল এই শ্রীরঙ্গমে। দুপুর বেলা আমরা কখনও ঘুমোতাম না, ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম। একদিন দুপুরে জ্যাঠামশাই বললেন, তুমি কবিতা বলতে পার? বললাম, হ্যাঁ পারি। তারপর শোনালাম রবীন্দ্রনাথের কথা ও কাহিনী থেকে... ‘পঞ্চ নদীর তীরে/ বেণী পাকাইয়া শিরে...’ উনি ইজি চেয়ারে শুয়ে শুয়ে পুরো কবিতা শুনে বললেন, খুব সুন্দর হয়েছে। গলাটা তোমার মায়ের মতোই। আমার মা অভিনয় জগতে আসার অনেক আগে নাচের দলের সখি ছিলেন। সখির দলের মেয়েদের থেকেই মাকে অভিনয়ের জন্য বেছে নেন শিশিরজ্যাঠা।
আপনার এই মেয়ে সেজে অভিনয় শুরু হল কীভাবে?
আমার বড় ভগ্নিপতি ইস্টার্ন রেলওয়েতে চাকরী করতেন শিয়ালদা ডিভিশনে। উনি একদিন বললেন তুই যদি মেয়ে সেজে অভিনয় করতে পারিস তাহলে তোর একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে পারি। একজন পুরুষ হয়ে মেয়ে সাজব সেটা আমি ঠিক মেনে নিতে পারছিলাম না। আবার তখনকার দিনে রেলে একটা চাকরি হওয়া মানে বিরাট ব্যাপার। তখন আমার মা মারা গিয়েছেন। বাড়িতে রোজগেরে বলতে একা ছোড়দি। টাকার অভাবে আমার পড়াশুনো বন্ধ। বাড়ি বিক্রি হয়ে গিয়েছে। একটা চাকরি হলে ভালোই হয়। কাজেই আমি বললাম, কী নাটক? তিনি বললেন আলিবাবা নাটকে মর্জিনার পার্ট। তা জ্যাঠার আমলে শ্রীরঙ্গম থিয়েটারে আলিবাবা এতবার অভিনীত হয়েছে যে সেটা দেখে দেখে আমার মাথায় মর্জিনার পার্টটা ছবির মতো আঁকা ছিল। প্রতিটি গানই আমার মুখস্ত।
তাহলে শেষপর্যন্ত মেয়ে সেজে করলেন অভিনয়?
আমাকে দেখে ওঁদের পছন্দ হল। ১৬দিন রিহার্সালের পর আমাকে মেয়ে সাজিয়ে দিল। চুল, সাজ পোশাক, গয়নাগাটি পরে যখন আয়নার সামনে দাঁড়ালাম আমি তো নিজেকে চিনতেই পারছিলাম না! আমাকে এত সুন্দর দেখাচ্ছিল যে ছেলেরা আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। যেন সত্যিই আমি একটি মেয়ে। এই অভিনয় করে সাতদিনের মধ্যে আমার চাকরি হয়েছিল।
সেই চাকরি ছাড়লেন কেন?
আমার কাজ ছিল চেনম্যান। মানে চেন ধরে জমি মাপার কাজ। কিন্তু আমাকে বাইরে বেরোতে দেওয়া হত না। আমি অফিসে বসেই কাজ করতাম। অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার নর্থ এর আন্ডারে ছিলাম। তিনি রিটায়ারের সময় বললেন চপল তুমি ভদ্রঘরের ছেলে, একাজ আর কতদিন করবে! তুমি যদি চাও বেলেঘাটা ওয়ার্কশপে তোমাকে একটা ব্যবস্থা করে দিয়ে যেতে পারি। এরফলে ভবিষ্যতে তুমি ফোরম্যান হয়ে যেতে পার। কিন্তু কিছু বন্ধুবান্ধব বলল... না না না, তুমি ও কাজ করতে যেও না চপল। তাহলে তোমার শরীর থাকবে না। তুমি অভিনেতা, অভিনয়ই কর। ওঁদের কথা শুনেই আমি সাহেবকে বললাম না স্যার, আমি এই চাকরি করতে পারব না। তিনি বলেছিলেন, এটা তুমি ভুল করলে চপল। এখনও তাই এক এক সময় ভাবি সেই চাকরিটা করলে আমার জীবনটাই অন্যরকম হয়ে যেত।
তারপর থেকেই নারীবেশে আপনার অভিনয়জীবন শুরু?
সেই সময় পুরুষেরাই নারী চরিত্রে অভিনয় করত। তো আমিও নারী চরিত্রে অভিনয় করা শুরু করলাম। টাটা, আসানসোল, বর্ধমান ইত্যাদি জায়গা থেকে স্ক্রিপ্ট ও অ্যাডভান্স টাকা পাঠিয়ে দিত। এইভাবে প্রচুর শো করতে করতে একদিন দেওঘরে অনুকূল ঠাকুরের আশ্রমে অভিনয়ের সময় একটি ছেলের সঙ্গে আলাপ হয়। সেই ছেলেটি বলল, তুমি পেশাদারী যাত্রা দলে এস। বেশি টাকা মাইনে পাবে। ভাবলাম আমি কি পারব! আশ্বিন থেকে টানা জ্যষ্ঠী মাস পর্যন্ত কাজ। এই আটমাস বাড়ির সঙ্গে কোনও সম্পর্কই থাকবে না। যাত্রায় তখন ছবিরানীর খুব নাম ডাক। শুনলাম এই ছবিরানীর পরিবর্তেই নট্ট কোম্পানিতে আমাকে অভিনয় করতে হবে। তো গেলাম নট্ট কোম্পানিতে। মাখনলাল নট্ট আমাকে পছন্দ করলেন। এটাই আমার প্রথম যাত্রায় অভিনয়।
এই যাত্রার হাত ধরেই তো আপনি চপলরাণী হয়ে উঠলেন?
হ্যাঁ, এই যাত্রা জগতে চপলরাণী হয়ে উঠতে আমাকে সাহায্য করেছিলেন তিনজন। পালাকার ব্রজেন দে, নট্ট কোম্পানির ম্যানেজার সূর্যকুমার দত্ত এবং মাখনলাল নট্ট। আমাকে নিয়েই একের পর এক যাত্রাপালা তৈরি হতে লাগল। চাঁদসুলতানা, দেবী মহীয়সী কৈকেয়ী, সুলতানা রিজিয়া এইরকম প্রচুর হিট হিট যাত্রা পালা হতে লাগল। ১৯৬৬ সালের পর বাদানুবাদ হলে নট্ট কোম্পানি ছেড়ে দিয়ে যোগ দিলাম নবরঞ্জন অপেরায়। এই সময়ে আমি নবরঞ্জন, সত্যম্বর অপেরা ইত্যাদি দলে অভিনয় করছি।
উত্তমকুমার আপনার অভিনয় দেখতে এসেছিলেন?
হ্যাঁ, একদিন উত্তমকুমার আমাদের নবরঞ্জন অপেরার ‘মাইকেল মধুসূদন’ যাত্রাপালা দেখবেন বলে এসেছিলেন রবীন্দ্রসদনে। তো আমি মায়ের চরিত্রে অভিনয় করছি। উত্তমবাবু আয়োজকদের বলেছিলেন, ওই ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিন। আমি মেকআপ তুলে উত্তমকুমারের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। উত্তমবাবু বললেন না না, ইনি নয়। যে ভদ্রমহিলা জাহ্নবী চরিত্রে অভিনয় করেছেন তাকে ডাকুন। তখন সবাই বললেন ইনিই জাহ্নবী চরিত্রে অভিনয় করেছেন।। এই কথা শুনে উত্তমবাবু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়েই রইলেন। কিছুক্ষণ পর আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন তুমি বিয়ে করেছ? বললাম না। উনি বললেন, বাঃ তুমি মা নও, বাবাও নও কিন্তু ঐ নাড়ি ছেঁড়া আর্তনাদ করে কান্না আর ঐরকম শরীরী ভঙ্গি কী করে করলে? এরপর তিনি বললেন, বলো তুমি আমার কাছে কী চাও? আমি ওঁর পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে বললাম আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন যাতে আমি আরও ভালো অভিনয় করতে পারি। তখন উত্তমবাবু আমাকে দু’ হাত দিয়ে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তখন তো আর সেলফি ছিল না। কিন্তু আমার হৃদয়ের সেলফিতে সেই ছবি আজও জ্বলজ্বল করছে। সেটা কেউ কোনও দিন ডিলিট করতে পারবে না। এরপর যখন একসময় যাত্রায় প্রচুর মেয়েরা এসে গেল তখন ওঁরা বলল, চপলদা আপনাকে আর রাখতে পারছি না। সময়টা ৭২ কি ৭৩ সাল হবে ঠিক মনে করতে পারছি না, আমি যাত্রায় অভিনয় করা ছেড়ে দিলাম।
এরপর কী হল?
এবার আমি আর কোনও উপায় খুঁজে পেলাম না। সময়টা ৭৪ কি ৭৫ সাল হবে। আমি যেন কোথায় চলে গেলাম। একটানা ২০ বছর আমি অভিনয় ছাড়া ছিলাম। এই ২০ বছর আমার জীবনে ভয়ংকর দৈন্য দশা গেছে। আমাদের বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে। এখানে ওখানে বাড়ি ভাড়া করে থাকতে হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এতটাই দুঃসময় ছিল যে সেটা কাউকে বলার মতো নয়। তাই সেই প্রসঙ্গটা বাদ রাখছি।
২০ বছর পর ফিরে কোথায় উঠলেন?
আবার ফিরে এলাম ছোড়দি কেতকী দত্তের কাছে। তখন ছোড়দি বললেন, দ্যাখ চপল জল ছাড়া যেমন মাছ বাঁচে না। তেমনই অভিনয় ছাড়া অভিনেতারাও বাঁচতে পারে না। তাই বলছি তোর জীবনে এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। এবার তুই দ্যাখ অন্য কিছু করে জীবনটাকে দাঁড় করাতে পারিস কিনা। এই তখনই আমি শীতলা পালার গান শুরু করলাম। যেটা ঐ রাস্তাঘাটে, বস্তিতে, মন্দিরে, এখানে ওখানে হয়। যে পালার কোনও স্ক্রিপ্ট নেই। এই শীতলা গান করেই আমি আবার নিজের জীবন নির্বাহ করতে আরম্ভ করলাম। এভাবেই চার ঘণ্টা পাঁচ ঘণ্টা খেটে ৪০ কি ৫০ টাকা রোজগার করতাম। খুব সম্ভবত সময়টা ৯৪ সাল হবে। রাত দুটো তিনটের সময় হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতাম।
আপনি তো বিদেশেও গিয়েছেন শো করতে?
হ্যাঁ। সিগাল মিডিয়া আর্ট এম্পোরিয়ামের নবীন কিশোরের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। উনি আমার শীতলা পালার অনেক ছবি তুললেন। আমার এই ছবি তুলে তিনি বহু দেশ বিদেশে পাঠালেন। আমেরিকা, সানফ্রান্সিস্কো, চীন, জাপান, প্যারিস, কানাডা ইত্যাদি প্রচুর জায়গায়। সেখান থেকে অনেকেই আমাকে আর্থিক সাহায্য পাঠিয়ে দিতেন। আমাকে তারা স্বচক্ষে দেখতেও চেয়েছেন। কিন্তু সব দেশে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। শুধু কানাডায় গিয়ে ২০ দিন ছিলাম। সেখানে প্রতিটি শোতে তিনশ জন দর্শক আমার অভিনয় দেখেছেন। আমি অভিনয় করলাম থিয়েলাভার্স দলের ‘খোলা জানালা বন্ধ চোখ’ নাটকে। তারপর দিল্লী গেলাম, বম্বে গেলাম শীতলা পালা করতে। পৃথ্বী থিয়েটারে অভিনয় করলাম।
রমনী মোহন করেও আপনি তো অনেক খ্যাতি পেয়েছেন?
হ্যাঁ, এই রমণী মোহন নাটকে অভিনয় করে আমি যত পুরস্কার পেয়েছি আচ্ছা আচ্ছা দল তেমন পুরস্কার পায়নি। এরপর ‘আভাস’ নাট্যদলে ‘সুন্দর বিবির পালা’ নাটকে অভিনয় করছি। আমি বেশ কয়েকটি সিনেমা ও সিরিয়ালেও অভিনয় করেছি। যেমন কৌশিক গাঙ্গুলির ‘উষ্ণতার জন্য’ , ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ ইত্যাদি।
অভিনয় জগতের খ্যতিমান শিল্পী চপল ভাদুড়ী আজ বৃদ্ধাশ্রমে ?
হ্যাঁ, তবে বৃদ্ধাশ্রমটা ঘেন্না করার মতো জায়গা নয়। এটা শান্তির নীড়। বুড়ো বয়সে মানুষ একটু শান্তি চায়। ঝগড়াঝাটি অশান্তি পছন্দ করে না। আমি বহুদিন সংসারের মধ্যে ছিলাম। যদিও আমি নিজে অবিবাহিত। তবু সংসার এমনই একটা জায়গা যেখানে অশান্তি হয়ই। তাই আজ আমি কলকাতার হরি ঘোষ ষ্ট্রীটের বৃদ্ধাশ্রমে আছি। ফেলে আসা পথে আমি আর পিছন ফিরে তাকাতে চাই না।
এই জীবন সায়াহ্ন্যে দাঁড়িয়ে আপনার নিজের সম্পর্কে কী মনে হয়?
সব শেষে আমার মনে হয়, আমি কে? আমি কি চপল ভাদুড়ী? নাকি চপলরানি? এখনও সেটা বুঝতে পারলাম না ।