কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ। যোগাযোগ রক্ষা করে চললে কর্মলাভের সম্ভাবনা। ব্যবসা শুরু করলে ভালোই হবে। উচ্চতর ... বিশদ
এই তো দেখুন না, উত্তরবঙ্গের দিনহাটা ও দক্ষিণবঙ্গের নিমতায় খুন হয়ে গেলেন দুই তৃণমূল নেতা। কেবল সন্দেহের বশে, হ্যাঁ কেবল চোর সন্দেহে খোদ কলকাতার বুকে মানিকতলায় একটি ক্লাবঘরের ভিতরে নির্মমভাবে পিটিয়ে মারা হল এক যুবককে! শুধু কি তাই? ভোট পরবর্তী হিংসায় কোচবিহার, বালুরঘাট থেকে বীরভূম, মেদিনীপুর থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং অবশ্যই উত্তর ২৪ পরগনার ভাটপাড়া নৈহাটি কাঁচরাপাড়ার মতো রাজ্যের নানান এলাকা এখনও রক্তাক্ত হচ্ছে, ঘরবাড়ি ভাঙছে, লাঞ্ছিত হচ্ছেন রাজ্যে প্রধান বিবদমান দুই দল বিজেপি তৃণমূলের নেতাকর্মী সমর্থকেরা! বুধবার রাতে বালুরঘাটে বিজেপি কর্মীর বাড়িতে ভাঙচুর চালাল দুষ্কৃতীরা। তার বদলায় তৃণমূল কর্মীর বাড়িতে হামলা হল। বাড়ির মহিলাদের শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠল হামলাকারীদের বিরুদ্ধে! এরই পাশাপাশি সাঁইথিয়ায় বিজেপির বিজয় মিছিল ঘিরে তৃণমূলের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধল, আহত হল পাঁচজন। স্থানীয় তৃণমূলের কারও পোলট্রি ফার্মে বোমাবাজির অভিযোগ উঠল বিজেপির বিরুদ্ধে! এর আগে মেদিনীপুরের নারায়ণগড়ে বেশ কয়েকজন তৃণমূল কর্মীকে হেনস্তা মারধরের অভিযোগ উঠেছে বিজেপির বিরুদ্ধে! আবার মথুরাপুরে বিজেপি কর্মীকে আক্রমণ এবং মারধরে অভিযুক্ত হয়েছে তৃণমূল! এমন একের পর এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেই চলেছে! কবে যে এই মারামারি শেষ হবে, আদৌ হবে কি না বোঝা যাচ্ছে না! সাধারণ মানুষজনের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যাচ্ছে—পুলিসের একাংশের ভূমিকায় খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তাঁরাও অসন্তুষ্ট। কেউ কেউ তো রীতিমতো ক্ষুব্ধ! স্বাভাবিক। পুলিসের কাজ পুলিস ঠিকমতো করলে তো সমাজবিরোধী দুষ্কৃতীরা এমন অনর্থ ঘটাতে পারে না, রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনাও অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে।
তবে, তথ্যভিজ্ঞরা বলছেন, এইসব ঝামেলার ঘটনা চলতে থাকলে বিজেপির ক্ষতি শাসকের লাভ। শাসক বলতে পারবে বিজেপি রাজ্যে কটা বাড়তি আসন পেয়েই তাণ্ডবে মেতেছে, রাজ্যের ক্ষমতা পেলে কিনা জানি করবে! আর এমন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে চললে এবং তার বেশিরভাগে পদ্মশিবিরের লোকজনের নাম জড়ালে, যে মানুষজনেরা বিজেপি সমর্থক না হয়েও এবার বিজেপিকে নির্বাচনী সমর্থন জানিয়েছেন, তাঁদের সামনেও আগামী বিধানসভা ভোট অব্দি একটা ভালো জনদরদি ভাবমূর্তি ধরে রাখা বিজেপির পক্ষে কঠিনতর হবে।
বিজেপি শাসক হিসেবে এ রাজ্যে অপরীক্ষিত দল বলেই মানুষ তাদের বিচার করবে বাস্তব পরিস্থিতিতে তাদের কাজকর্ম ও রাজনৈতিক ভূমিকা দেখে। সেখানে যদি তাঁরা দেখেন, গেরুয়াদলের কর্মী নেতাদের একাংশও আর পাঁচদলের মতো বুদ্ধিবলের চেয়ে বাহুবলকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন, ক্ষমতার গন্ধটুকু পেয়েই আগ্রাসী হয়ে উঠেছেন—তবে আমজনতার প্রসন্ন মুখে চিন্তা ও শঙ্কার ছায়া তো নামবেই। আর সেই ছায়া যদি গাঢ় হতে শুরু করে তবে বিজেপির ২০২১ সালের বিধানসভা অভিযানের পথ যে অপেক্ষাকৃত দুর্গম হয়ে উঠবে তা বলাই বাহুল্য। কারণ, বিধানসভা অভিযানে সাফল্য পেতে হলে বিজেপিকে নিজস্ব ১৭ শতাংশ ভোটারের সঙ্গে বাইরের ২২ শতাংশ মানুষকেও পাশে পেতে হবে। বাইরের মানুষ বিরূপ হলে প্রত্যাশিত ফল লাভ যে হবে না সেটা রাজ্য বিজেপি বা আরএসএসের শীর্ষ নেতৃত্ব ভালোই জানেন। আর জানেন বলেই দলে বেনো জলের ঢুকে পড়াতে রাশ টানতে চাইছেন তাঁরা। কিন্তু, বীরভূমের মনিরুলকে চাপা দিতে দিতেই বেদের মেয়ে চরিত্রাভিনেত্রীর গেরুয়া শিবিরে যোগদান নিয়ে নতুন করে ‘নাগরিকত্ব’ বিতর্ক ছড়িয়ে গেল! তথ্যপ্রমাণ দাখিল করে তার অবশ্য একটা জুতসই জবাব বিজেপি দিয়েছে। কিন্তু, বিতর্ক তাতেও পুরোপুরি থামেনি!
কেবল সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ নয়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘উন্নয়ন’ও কিন্তু রাজ্য বিধানসভা জয়ের পথে বিজেপির সামনে একটা বড় বাধা। গত সাত সাড়ে সাত বছরে পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম শহরে মমতা উন্নয়নের যে বিপুল উদ্যোগ নিয়েছেন, পানীয় জল রাস্তাঘাট হাসপাতাল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সমেত যাবতীয় অত্যাবশ্যক পরিষেবার যে বিস্তার ঘটিয়েছেন, স্বাস্থ্যসাথী, কন্যাশ্রীর মতো গরিব সাধারণের অভাব অনটনের সমাধানে আর্থিক অনুদানের যেসব প্রকল্প রূপায়িত করেছেন—তার একটা জোরালো প্রভাব রাজ্যের, বিশেষত গ্রামবাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে এখনও সক্রিয়। একটু ভালোভাবে নজর করলেই তাই বোঝা যায়—বর্তমান শাসকের কাজ নিয়ে মানুষের অভিযোগ তেমন নেই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা এখনও পাহাড় থেকে সাগর লক্ষ লক্ষ মানুষের নয়নের মণি, তাঁর মা-মাটি-মানুষের প্রতি ভালোবাসায় দায়বদ্ধ উজ্জ্বল ভাবমূর্তি এখনও রাজ্যবাসী অধিকাংশের মনে অম্লান। মানুষের যা কিছু ক্ষোভ রাগ অসন্তোষ স্থানীয় তৃণমূলের কিছু অসংযমী, ধান্দাবাজ, দায়িত্বজ্ঞানহীন, তোলাবাজ সিন্ডিকেটি ফড়ে ফেরেব্বাজের ওপর। দলনেত্রী নানা সভাসমিতি থেকে নানা সময় এদের সতর্কবার্তা পাঠিয়েছেন, দল থেকে বহিষ্কার করার হুমকিও দিয়েছেন। তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপও নিয়েছেন। তাতে কিছু কাজ নিশ্চয়ই হয়েছে। সল্টলেক নিউটাউন রাজারহাটে সিন্ডিকেট রাজের বজ্জাতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। রাজ্যের অন্যত্রও এই শ্রেণীর তৃণমূলীদের দৌরাত্ম্য কিছু কমেছে। সবটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে, তৃণমূলী ওইসব নেতাকর্মী সকলে সাধু হয়ে গেছে এমন বলছি না। তবে, ভোটফল বেরনোর পর তারাও একটা অশনি সংকেত পেয়েছে। কিন্তু, কয়লা বলে কথা। শত ধুলেও ময়লা কি যায়! এদের অনেকে এখন নতুন গুড়ের লোভে রং পাল্টানোর চেষ্টায় নেমেছে বলে খবর।
এদের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভটাই প্রতিফলিত হয়েছে ভোটবাক্সে—এমনটাই অভিমত তথ্যভিজ্ঞজনেদের অনেকেরই। কিন্তু, বিজেপিতে এদের মুখ দেখলে মানুষের কী প্রতিক্রিয়া হবে তা সহজেই অনুমেয়। সুতরাং এদের আটকানোও এখন গেরুয়া শিবিরের একটা বড় এবং কঠিন কাজ। দ্বিতীয়ত, মমতার উন্নয়নপন্থী ভাবমূর্তির তো কেবল বঙ্গে নয়, দেশ তথা বিশ্বের দরবারেও স্বীকৃতি পেয়েছে। তার একটা আলাদা প্রভাবও আছে বাংলার মানুষজনের মধ্যে। সেখান থেকে মমতাকে সরানোও সহজ কাজ নয়। রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব সেটা ভালোই জানে। এমন পরিস্থিতিতে বঙ্গবাসীর মনে বিজেপি সম্পর্কে নতুন ভাবনা জাগাতে হলে যে একটা ন্যায়পরায়ণ শান্ত-সংযত মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং অবশ্যই সহিষ্ণু ভাবমূর্তি গণদরবারে পেশ
করতে হবে—তাও তাঁদের অজানা নয়। কিন্তু,
নৈহাটি ভাটপাড়া সমেত রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় চোখ রাঙানো সন্ত্রাসের যে আবহ কায়েম হয়েছে
তা সেই ভাবমূর্তি নির্মাণের পথে পদে পদে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।
তার ওপর মমতার মতো নেত্রীর সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়তে পারেন—এমন মুখ এখনও রাজ্য বিজেপি খুঁজে উঠতে পারেনি। লোকসভার লড়াইটা মোদিজির মুখ দেখিয়ে তাঁর কথা শুনিয়ে তাঁকে ১৮ জনসভায় পেশ করে উতরে যাওয়া গেছে। হয়তো, আগামীতেও রাজ্য বিধানসভার প্রচার সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে গেরুয়া ব্রিগেডের হয়ে মঞ্চে দেখা যাবে। কিন্তু, মূল রণক্ষেত্রে মমতার মোকাবিলা তো তিনি করবেন না। করতে হবে অন্য কাউকে। তিনি কে? এখনও জানে না পশ্চিমবঙ্গ। এই সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিত ও প্রতিকূলতার বিচারেই হয়তো বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব এ রাজ্যের বিধানসভা ভোটকে একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ মনে করছে। এখন এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা বিজেপি শেষ অব্দি কীভাবে কতটা করতে পারে সেটাই দেখার—তাই না?