বিতর্ক বিবাদ এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। প্রেম পরিণয়ে মানসিক স্থিরতা নষ্ট। নানা উপায়ে অর্থ উপার্জনের সুযোগ। ... বিশদ
অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়: সদ্য স্বামীহারা মিসেস সেভিয়ারকে সান্ত্বনা দিয়ে স্বামীজি ফিরে এলেন বেলুড় মঠে। সেইসময় তাঁর শরীর একদম ভালো ছিল না। তিনি তখন মুক্তির আকাশে মুক্ত বিহঙ্গের মতো ওড়ার জন্য ছটফট করছেন। একদিন তিনি তাঁর গুরুভ্রাতাদের বললেন, দেখ আমি তো মায়ের জন্য কখনও কিছু করলুম না; আমার শরীরের যেরকম অবস্থা তাতে দু-এক বছরের বেশি বাঁচব বলে মনে হয় না। তাই আমার ইচ্ছা মাকে কিছু তীর্থ করাই। তাহলে তবু তাঁর কিছু করা হবে। তা তোমরা যদি আমায় এ বিষয়ে সাহায্য কর তো ভালো হয়; আমার নিজের শরীরের তো এই অবস্থা।
এরপরই মা-দিদিমা ও দু-একজন গুরুভ্রাতাকে সঙ্গে নিয়ে স্বামীজি তীর্থভ্রমণে বেরলেন। তাঁরা যাবেন পূর্ববঙ্গ ও আসামের দিকে। শিলং-এ পৌঁছে স্বামীজি আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। শুরু হল প্রবল শ্বাসকষ্ট। এক ফোঁটা বাতাসের জন্য তিনি তখন ছটফট করছেন। গুরুভ্রাতারা স্বামীজির অবস্থা দেখে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়লেন। ভয়ানক শ্বাসকষ্ট উপেক্ষা করেই স্বামীজি তাঁদের বলেছিলেন, ‘যাক, মৃত্যুই যদি হয়, তাতেই বা কি আসে যায়? যা দিয়ে গেলুম, দেড়হাজার বছরের খোরাক।’
এই তীর্থভ্রমণে বেরিয়ে বেশ কয়েকটি মজার ঘটনা ঘটেছিল। একদিন ভুবনেশ্বরী দেবী তাঁর জগৎবিখ্যাত পুত্র স্বামী বিবেকানন্দকে বলেছিলেন, ‘দেখ এসব তো অনেক হলো, বেশ ভাল, এইবার একটা বিয়ে কর।’ উত্তরে স্বামীজি বলেছিলেন, ‘দেখো মা, বিয়ে করবার কি দরকার? এই দেখনা আমার সব কত বড় বড় ছেলে (শিষ্যদের দেখিয়ে) রয়েছে।’ কিন্তু এই বিয়ের প্রসঙ্গ দিদিমা তুললেই, স্বামীজি মজা করে হাসতে হাসতে বলতেন, ‘দেখ দিদিমা, এখনও আমার হাতে কিছু টাকা আছে; তুমি এই বেলা মর, আমি তোমার বেশ ঘটা করে শ্রাদ্ধ করি।’
একজন জন্মসন্ন্যাসী, ঠাকুর যাঁকে এই বলে বিশ্বাস করতেন, যে এই মহাপ্রাণটি জগতের হিতের জন্যে অবতীর্ণ হয়েছেন অনন্তের পরিমণ্ডল থেকে। ঠাকুর এও জানতেন তাঁর এই ধ্রুব শিষ্যটির শরীর বেশি দিন থাকবে না। স্বামীজিও সেকথা জানতেন কিন্তু তিনি সাধারণ পরিবেশে, সাধারণের মতো সাধারণ। তখন তাঁর কোনও অহঙ্কারই থাকত না। সাধারণের সঙ্গে সাধারণের মতোই নিজের বৃহৎ সত্তাকে গুটিয়ে আনতেন। রঙ্গ রসিকতা ,মেয়েলি কথাবার্তাতেও তাঁর আপত্তি ছিল না। এখানে তিনি পবিত্র এক অস্তিত্বকে বহন করে নিয়ে চলেছেন— তাঁর গর্ভধারিণীকে। এই পরিক্রমা বৃত্তাকারে ফিরে আসবে উৎসে। আর সেইখান থেকেই ঘটবে তাঁর আবার ফিরে যাওয়া অনন্তে।
তিনি যে চলে যাবেন এই তথ্যটি তিনি নিজের মধ্যে সঙ্গোপনে রেখে দিয়েছিলেন। কেউ যেন বুঝতে না পারে অগ্নিনির্বাপিত হতে চলেছে। ঘটনাটি এত আকস্মিক যে তাঁর ঘনিষ্ঠ গুরুভ্রাতারাও বুঝতে পারেননি। সেইদিন তিনি দেখিয়ে গেলেন তাঁর লীলা। সম্পূর্ণ সুস্থ সেদিন। একমাইলেরও অধিক পথ হেঁটে এলেন। তারপর নিঃশব্দে নিজের শক্তি দিয়ে যেন জ্বালালেন আর একটি বৃহৎ হোমকুণ্ড, আহুতি দিলেন নিজেকে।
ঠাকুর বলতেন, যাবার আগে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়ে যাব। অর্থাৎ আমি কে, সাধারণ ও অসাধারণ মানুষ উভয়েই বুঝতে পারবে। তাঁরই প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ সিমুলিয়ার ‘বিলেটি’কে তা অগ্নিআখরে আকাশের গায়ে লিখে রেখে যাবেন। সেই কারণেই প্রথম দিনেই শেষ দিনের কথা বলার চেষ্টা। রবীন্দ্রনাথ বড় সুন্দর একটা লাইন রেখে গেছেন— ‘যা পেয়েছি প্রথম দিনে তাই যেন পাই শেষে।’ স্বামীজির শেষ কোথায়! তিনি তো অনন্ত, তিনি তো ব্রহ্মস্বরূপ। তিনি বলতেন অহং ব্রহ্মাষ্মি। হাজার বার বললেও, ব্রহ্মস্বরূপ হওয়া যায় না।
স্বামীজি আবার বলতেন ব্রহ্মের আবার অসুখ কী? শ্বাসকষ্ট, মধুমেহ— এসবই তো শরীরের। ঠাকুর যাকে বলতেন খাঁচা। ঠাকুরও তো বলতেন, রোগ জানুক আর দেহ জানুক। আমেরিকা ভ্রমণের শেষের দিকে স্বামীজি অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন কিন্তু পাত্তা দেননি। পূর্ববঙ্গ ভ্রমণের সময় শরীর সহযোগিতা করেনি। তিনি সেসব গ্রাহ্যের মধ্যেই আনেননি। পরিব্রাজক অবস্থায় হৃষীকেশে গুরুভাইরা মনে করেছিলেন তিনি দেহ ছেড়ে দিয়েছেন। বরাহনগর মঠে একবার ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। স্বামীজির অসুখ করে না, কারণ তিনি মুহূর্তে নিজেকে দেহাতীত অবস্থায় নিয়ে যেতে পারেন। তাঁর শেষের দিনটি স্পষ্ট করে দিয়ে গেছে — দেহ নয় তিনি ছিলেন একটি অগ্নিশিখা। পাশ্চাত্যের পাদরিরাও বারে বারে সে প্রমাণ পেয়েছিলেন।
ফিরে আসি শেষ দিনটির কথায়। সেদিন তিনি ভীষণ সুস্থ। ঠাকুরও চলে যাবার কয়েক ঘণ্টা আগে তাঁর সেবকদের বড় আনন্দ দিয়েছিলেন। সুস্থ মানুষের মতো গলা অন্ন সহজে গ্রহণ করে (স্বামীজিই খাইয়ে দিয়েছিলেন) বড় আরামে বালিশে মাথা রেখে শুয়েছিলেন। আনন্দের হিল্লোল বয়ে গিয়েছিল।
শেষদিনে স্বামীজি কী করলেন! যেটিকে বলা যেতে পারে একটু অন্যরকম। রুদ্ধদ্বার ঠাকুরঘরে দীর্ঘক্ষণ ধ্যানে বসে রইলেন। তারপর বারান্দায় পায়চারি করতে করতে একটি গান বারে বারে গাইলেন। বিকেলে ভ্রমণ শেষে তিনি তাঁর নিজের ঘরে মেঝেতে শুয়ে পড়লেন, সেবককে বললেন বাইরে থাক। সেবক বাইরে থেকে একসময় একটি আর্ত কন্ঠস্বর শুনলেন। এসে দেখলেন স্বামীজি চিরনিদ্রায় নিদ্রিত। এখানেই শেষ নয়, তিনি তাঁর দেহের বাইরে বিচরণ করছিলেন। তা নাহলে তিনি নিবেদিতার প্রার্থনা কেমন করে শুনতে পেলেন। সিস্টার একটি স্মারক নিজের কাছে রাখতে চাইছিলেন। অগ্নি সমন্বিত একটি বস্ত্রখণ্ড পূতচিতাগ্নি থেকে উড়ে এসে তাঁর শরীর স্পর্শ করল। বিদেশিনী স্তম্ভিত। কে কী বুঝলেন জানা নেই, তাঁর এই মানস কন্যা হয়তো রবীন্দ্রনাথের এই লাইনটির অর্থ আর একবার বুঝলেন— এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ...।