শনিবার, 19 এপ্রিল 2025
Logo
  • শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫

একই বংশে কেউ সুবুদ্ধির কেউ দুর্বুদ্ধির অধিকারী হয় কেন?

‘মহাভারত’-এ কৌরবদের সৎ ভাই যুযুৎসু ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র হওয়া সত্ত্বেও ধৃতরাষ্ট্রের অন্য শতপুত্রদের মতো ছিলেন না। তিনি হয়ে উঠেছিলেন ধার্মিক ও ন্যায়পরায়ণ। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধেও তিনি পাণ্ডবদের সাহায্য করেছিলেন।

একই বংশে কেউ সুবুদ্ধির কেউ  দুর্বুদ্ধির অধিকারী হয় কেন?

‘মহাভারত’-এ কৌরবদের সৎ ভাই যুযুৎসু ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র হওয়া সত্ত্বেও ধৃতরাষ্ট্রের অন্য শতপুত্রদের মতো ছিলেন না। তিনি হয়ে উঠেছিলেন ধার্মিক ও ন্যায়পরায়ণ। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধেও তিনি পাণ্ডবদের সাহায্য করেছিলেন। আবার ‘রামায়ণ’-এ আছেন বিভীষণ। রাক্ষসকুলে জন্মেও যাঁর ধর্মভাব ছিল অটুট। আমাদের চারপাশেও এমন নানা চরিত্র আছে। আবার বাবা-মা নিরীহ, অথচ সন্তান পরে অপরাধ জগতের ‘ডন’ হয়েছে, এমন নিদর্শনও রয়েছে।
কেন এমন হয়? ‘দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ’ বা ‘গোবরে পদ্মফুল’ হয়ে জন্মানোর রহস্য কী? 
প্রতিটি মানুষ নিজস্ব জিন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। সে বেড়ে ওঠে বিভিন্ন পরিবেশের ভিতর। শিশুকাল থেকেই একজনের ভাবনাচিন্তা, স্বভাব সবকিছুরই নিয়ন্তা পরিবেশ ও জিন। বংশানুক্রমিক কোনও বৈশিষ্ট্য তাঁর জন্মসূত্রে পাওয়া। একে বলে জেনেটিক। জিনগত বৈশিষ্ট্যকে বদলে দিতে বা তার উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে পরিবেশ। একে বলে ‘এপিজেনেটিক’। 
 কীভাবে পরিবেশ জিনকে বদলায় ?
কোনও কোনও মানুষের ক্ষেত্রে জিনের প্রভাব বেশি, কারও আবার প্রকৃতিগতভাবেই পরিবেশের প্রভাব বেশি। মানবমস্তিষ্কের দু’টি অংশ প্রি ফ্রন্টাল কর্টেক্স ও অ্যামিগডালার উপর পরিবেশ ও জিন প্রভাব বিস্তার করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় কিছু নিউরোট্রান্সমিটার (ডোপামিন ও সেরোটোনিনেন)। এই সবের মিলিত রেজাল্ট একজন মানুষের স্বভাব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য তৈরি করে।
মা-বাবা ও সন্তানের মধ্যে মানসিক 
প্রভেদ কেন হয়?
নিউরোসায়েন্স, জেনেটিক ও এপিজেনেটিক— এই তিনের মধ্যে কোনটা কার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা নেবে ও কোনটি প্রচ্ছন্ন থাকবে এটি ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন হয়। আমাদের কেউ খুব সাবধানী, কেউ ঝুঁকিপ্রবণ, কেউ খুব দুঃসাহসী, কেউ জীবনে ব্যালান্স করে চলতে জানেন। আমাদের চারপাশের কোনও কঠিন পরিস্থিতি বা স্ট্রেস আমাদের স্বভাবকে প্রভাবিত করে। একান্নবর্তী বা নিউক্লিয়ার পরিবার— যেখানেই শিশু বেড়ে উঠুক, তার চারপাশের পরিবেশ তার মানসিক বিকাশের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। মা-বাবা খুব আঁটসাঁট নিয়মে বড় হয়ে নিয়মানুবর্তী হয়েছেন, কিন্তু সন্তানকে একটু শিথিলভাবে বড় করেছেন, ফলে সে অত নিয়মশৃঙ্খলার ধার ধারেনি এমন প্রচুর উদাহরণ রয়েছে। তাই মা-বাবা যেমন, তার মতোই সন্তান হবে, বিজ্ঞান এ কথা বলে না। জিন, মস্তিষ্কের রসায়ন ও পারিবারিক অভিজ্ঞতা সবের যোগফল একজনের স্বভাব-চরিত্র গড়ে। 
খারাপ জিন-ভালো পরিবেশ ও ভালো জিন-খারাপ পরিবেশ! কী হবে?
এখানে একটি শব্দ আসে, যার নাম জেনেটিক লোডিং। কিছু কিছু সমস্যা যেমন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার ইত্যাদির ক্ষেত্রে জিনের প্রভাব বেশি। একজনের মস্তিষ্কে কতটা ডোপামিন, সেরাটোনিনের ভারসাম্য রয়েছে, তার উপরেও মানুষের স্বভাব নির্ভর করে। যাঁর মস্তিষ্কে নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্য ভালো, তিনি যে কোনও প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে সামলে নেবে, যাঁর কম, তিনি বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠবেন। তাই বংশে এই ধরনের সমস্যা থাকলে বা সন্তানের মধ্যে এমন সমস্যা দেখা দিলে, খুব ছোটবেলা থেকেই তাঁকে উত্তম পরিবেশ, মূল্যবোধ তৈরি হওয়ার শিক্ষা, উৎকৃষ্ট সংসর্গ দিতে হবে। সঙ্গে কাউন্সেলিং থেরাপি ও কিছু মেডিকেশনও প্রয়োজন হয়। এতে জিনগত প্রভাবকে ছাপিয়ে পরিবেশগত প্রভাব বড় হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই প্রথম থেকে মনোবিদদের পরামর্শ নিন। যত দ্রুত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা হবে, সন্তানের ততই মঙ্গল। 
সহোদর ও যমজরা কেন স্বভাবে আলাদা?
বাবা-মায়ের মধ্যে যাঁর জিনের প্রভাব সন্তানের জিনে প্রকট, সন্তানের স্বভাবের মধ্যে সেই প্রবণতা বেশি থাকে। এখানে জিনের সঙ্গে নিউরোট্রান্সমিটার কার কেমন, পরিবেশ, জীবনে অন্য মানুষদের প্রভাব কতটা, এসবের উপরও ব্যক্তি কেমন হবে, তা নির্ভর করে। সবটাই খারাপ হলে সেও খারাপ হবে। ভালো-খারাপ মিলেমিশে থাকলে যেটির প্রভাব বেশি, সেটিই ব্যক্তির স্বভাবগঠনে বড় ভূমিকা নেবে। দুই সন্তানের মধ্যে কারও জিনে হয়তো বাবার জিনের বৈশিষ্ট্য প্রকট, কারও ক্ষেত্রে মায়ের। নিউরোট্রান্সমিটারও দু’জনের দু’রকম। তাই পরিবেশ এক হলেও অন্য ফ্যাক্টরগুলোর জন্য ফারাক হয়। তাই সন্তানকে ‘সুসন্তান’ করে গড়ে তুলতে নিজেরা ভালো হওয়ার চেষ্টা করুন, তার সঙ্গে ভালো পরিবেশ, মূল্যবোধ তৈরি হওয়ার শিক্ষা দিন। 
                                                                                                                            লিখেছেন মনীষা মুখোপাধ্যায়