বৃহস্পতিবার, 17 জুলাই 2025
Logo
  • বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫

জলের গুরুত্ব

পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, মবি ডিক-এর শুরুতেই রয়েছে জলের সঙ্গে মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা। বিশাল জলরাশির সামনে মানুষের মন শান্ত হয়, বারিধারায় মানুষের আত্মা খুঁজে পায় জীবনের গহন সত্য। 

জলের গুরুত্ব

ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল: পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, মবি ডিক-এর শুরুতেই রয়েছে জলের সঙ্গে মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা। বিশাল জলরাশির সামনে মানুষের মন শান্ত হয়, বারিধারায় মানুষের আত্মা খুঁজে পায় জীবনের গহন সত্য। এই উপন্যাসের নায়ক ইসমাইল, জীবনের সব দুঃখ কষ্টের সমাধান খুঁজে পেত সমুদ্রযাত্রায়, বারিধির কোলে সময় কাটিয়ে। মহাভারতে বলা হয়েছে,
‘পানীয়স্য গুণা দিব্যা পরলোকে গুণাবহাঃ।’ 
অর্থাৎ, জলের যে দিব্য গুণ, সেটা ইহকালের পর পরকালেও বজায় থাকে। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে, জলে অমৃত আছে। জল ছাড়া শুধু মানুষ কেন, পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীজগৎই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু অতিরিক্ত জলও আমাদের ক্ষতি করে। তাই একঝলকে দেখে নেওয়া যাক যে আমাদের শরীরে জলের প্রয়োজন কতটা। 
প্রথমেই দেখা যাক আমাদের শরীরে স্বাভাবিক অবস্থায় জলের পরিমাণ কতটা। একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের শরীরে জলের ভাগ ৬০ শতাংশের আশপাশে। আর প্রাপ্তবয়স্ক নারীর শরীরে জলের ভাগ ৫০-৫৫ শতাংশের কাছাকাছি। ষাট বছর বয়সের পর উভয় লিঙ্গের শরীরেই জলের ভাগ আরও কিছুটা (৪-৫ শতাংশ) কমে যায়। তবে আমাদের সব অঙ্গে জলের পরিমাণ সমান নয়। যেমন মস্তিষ্কের প্রায় ৭০ শতাংশ হল জল, বা মাংসপেশির ৭৫ শতাংশ হল জল। কিন্তু আবার অস্থির মাত্র ৩০ শতাংশ হল জলীয় ভাগ। 
জলের আরেক নাম জীবন, সেটা তো সবাই জানি। কিন্তু আমাদের শরীরে জলের প্রধান কাজ কী কী? নীচের সারনিতে দেখুন।
জল ছাড়া জীবন 
সুতরাং, এককথায় বলতে গেলে, জল ছাড়া কিন্তু আমাদের শরীরের মেটাবলিজম থেমে যাবে। কতক্ষণ থাকতে পারে একজন মানুষ জল ছাড়া? এই বিষয়ে বিশ্বরেকর্ড রয়েছে অস্ট্রিয়ার অ্যানড্রিয়া মিহাভেজ নামে একজনের। ১৯৭৯ সালে ১৮ বছর বয়সি মিহাভেজকে বেসমেন্টের জেলে বন্ধ করে রেখে পুলিস চলে গিয়েছিল। তারপর ১৮ দিন তিনি ওইভাবে বন্দি ছিলেন। সৌভাগ্যবশত তিনি ১৮ দিন পরও বেঁচেছিলেন, যদিও এই সময় তাঁর প্রায় ২৪ কেজি ওজন হ্রাস পেয়েছিল। এটা চরম উদাহরণ। সাধারণ অবস্থায় একদম জল ছাড়া একজন মানুষ ৩-৪ দিনের বেশি বাঁচবে না। শিশু হলে তো আরও কম। তবে এটা নির্ভর করে সেই মানুষের শরীর থেকে কতটা জল নানা পথে বেরিয়ে যাচ্ছে, তার ওপর। যেমন প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ায়, যেখানে ক্রমাগত শরীর থেকে ঘাম বেরিয়ে যাচ্ছে, সেখানে কিন্তু জলের অভাবে দু’দিনেই মৃত্যু হতে পারে। এর মানে হল, যদি কেউ মরুভূমিতে ট্রেক করতে যান এবং সেখানে সঙ্গের জলের রসদ ফুরিয়ে যায়, তাহলে কিন্তু তার দ্রুত মৃত্যু হতে পারে। তাহলে একজন মানুষ সারাদিনে কতটা জল পান করবেন? এটার এককথায় কোনও উত্তর হয় না। কতটা জল পান করবেন, সেটা নির্ভর করে সারাদিনের কাজের ওপর। যদি আপনি কৃষিজীবী হন আর আপনাকে এপ্রিল মাসের রোদে মাঠে সারাদিন কাজ করতে হয়, তাহলে আপনার জলের প্রয়োজন অনেকটাই বেশি। কিন্তু আপনি যদি সারাদিন ঠান্ডা ঘরে বসে থাকা আই টি পেশাদার হন, তাহলে আপনার জলের প্রয়োজন অনেক কম। আর এই সঙ্গে এ কথাও মনে রাখবেন যে শুধুমাত্র জল পান করলেই যে আপনার শরীরে তরল প্রবেশ করছে, তা কিন্তু নয়। বাঙালি মূলত ভাত খেতেই অভ্যস্ত। ভাতে কিন্তু ওজনের ৬৫-৭০ শতাংশ হল জল।  ফলে আপনি যখন ভাত খাচ্ছেন, তখন কিন্তু আপনার শরীরে বেশ কিছুটা জল প্রবেশ করছে। তরমুজ, আপেল জাতীয় ফলেও ওজনের বেশিরভাগ অংশই হল জল। সুতরাং জল একটু কম খেলেও আপনি যে অন্যান্য শক্ত খাবার খাচ্ছেন, সেখান থেকেও কিন্তু আপনার শরীরের জলের প্রয়োজন অনেকটাই মিটে যাচ্ছে। কতটা জল খাবেন, এই প্রশ্নের সেরা উত্তর হল, যখন তেষ্টা পাবে, তখন জল খাবেন। কোনও অনলাইন বিশেষজ্ঞের কথা শুনে জোর করে বোতল বোতল জল পানের যেমন দরকার নেই, তেমন আবার তেষ্টা পেয়েছে, কিন্তু জোর করে শুকিয়ে থাকাও অর্থহীন। 
অবশ্য এই নিয়মের একটি ব্যতিক্রম আছে, সেটি হল যদি বাড়িতে কোনও রোগী থাকে, যার কথা বলার বা উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে (যেমন স্ট্রোক বা ডিমেনশিয়া রোগী)। এইসব রোগীদের তৃষ্ণা বোঝার ক্ষমতা লোপ পায়। তাঁরা কিন্তু কখন শরীরে জলের ঘাটতি হচ্ছে, সেটা বলতে পারবেন না। তাঁদের সময় হিসেব করে নির্দিষ্ট পরিমাণ জল খাওয়াতে হয়। এই বিষয়ে চিকিৎসক সঠিক দিশা দেখাতে পারবেন। 
খেলাধুলায় জল 
উন্নত দেশে এখন অ্যাথলিটদের যখন ট্রেনিং শুরু হয়, তখন তাদের শরীর থেকে ঘণ্টায় কতটা জল বেরিয়ে যাচ্ছে, সেটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রথমে মাপা হয়। প্রত্যেক মানুষের শরীরের কার্যপ্রণালী আলাদা। ফলে প্রত্যেক অ্যাথলিটের জন্য আলাদাভাবে হিসেব করা হয় যে তার শরীরে ঘণ্টায় জলের প্রয়োজন কতটা। সেই হিসেব করে ফুটবল ম্যাচ বা ম্যারাথন দৌড়ের সময়ে তাদের মেপে মেপে পানীয় দেওয়া হয়। উন্নত দেশের ওলিম্পিক বা ক্রিকেট টিমের সঙ্গে এত সাপোর্ট স্টাফ থাকে, তাদের অনেক কাজের মধ্যে এটাও একটা। সঠিক পরিমাণ পানীয় না পেলে সেই খেলোয়াড়ের পারফরম্যান্স হ্রাস পেতে বাধ্য। 
পশ্চিমের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন একটা ম্যারাথন দৌড় শুরু আর শেষের মধ্যে একজন অ্যাথলিটের তিন-চার কেজি ওজন হ্রাস পেতে পারে শুধু জলীয় অংশ বেরিয়ে যায় বলে। ফলে যদি ঠিকমতো তরলের অভাব পূরণ না হয়, তাহলে কিন্তু দৌড়তে দৌড়তে সেই ব্যক্তি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন বা তাঁর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হতে পারে। দু-তিন ঘণ্টার একটা ম্যারাথন দৌড়ের মধ্যে যদি শরীর থেকে চার লিটার জল বেরিয়ে যায়, তাতে কিন্তু নানা ক্ষতি হতে পারে, যদি না সেই তরলের ঘাটতি হিসেব করে পূরণ করে দেওয়া হয়। শরীরে দ্রুতগতিতে জলের ভাগ কমে গেলে কিন্তু কিডনি কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে, রক্ত বেশি ঘন হয়ে হৃৎপিণ্ডের ওপর চাপ সৃষ্টি হতে পারে। তাই সফল অ্যাথলিট হতে গেলে অন্যান্য ট্রেনিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের শরীরের জলগ্রহণের পরিমাণ করাটাও জরুরি। আজকের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ম্যারাথন দৌড়বীর, কেনিয়ার এলিউদ কিপচোগী নিজের প্রত্যেক দৌড়ের আগে কোথায় কোথায় কতটা পানীয় নেবেন, কঠোরভাবে হিসেব করে নেন এবং সেই প্ল্যান অনুযায়ী তাঁকে ম্যারাথনের মাঝে মাঝে পানীয় পৌঁছে দেওয়া হয়। 
এবার দেখা যাক আমাদের শরীরের কোন অঙ্গে জলের গুরুত্ব কতটা। 
ত্বক 
শরীরে জলের অভাব হলে তার প্রভাব পড়ে ত্বকের ওপরেও। শীতকালে সবাই দেখেছেন বয়স্ক তো বটেই, কমবয়সি মানুষের ত্বকও শুকিয়ে যায়, জেল্লা হারিয়ে যায়। শীতকালে জল পান অনেকটাই কম হয়। ফলে শরীরে ডিহাইড্রেশান হতে পারে। জলপান ঠিকমতো না হলে ত্বকের অবস্থা পরিবর্তন হবে না। ত্বকের ওপর ডিহাইড্রেশানের ছাপ পড়ে খুব তাড়াতাড়ি। তাই আগেকার দিনে যখন কলেরা হতো, তখন চিকিৎসকরা রোগীর শরীরে জলের অভাব বোঝার জন্য চামড়ায় ভাঁজ পড়ে গেছে কি না, সেটা পরীক্ষা করতেন। বিশেষত, শিশুদের ক্ষেত্রে এই ক্লিনিক্যাল সাইন খুব তাড়াতাড়ি ফুটে ওঠে। 
আবার বেশি জল ঘাঁটলেও কিন্তু ত্বকের ক্ষতি। যেমন অনেকক্ষণ জলে হাত ডুবিয়ে কাজ করলে চামড়া কুঁচকে যায়। যারা রান্নাঘরে অনেকক্ষণ কাজ করেন, তাঁদের হাতে এরকম ত্বকের অসুখ প্রায়ই দেখা যায়। অনেকের অভ্যাস থাকে বারবার সাবান বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়া। হাত পরিষ্কার রাখা দরকার ঠিকই। কিন্তু অতিরিক্ত হাত ধুলেও চামড়ার অসুখ হতে পারে। হাতে সবসময় জল লেগে থাকলে ছত্রাকের সংক্রমণ হতে পারে। নখে এরকম সংক্রমণ হলে নখ নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের চামড়ায় কোটি কোটি উপকারী ব্যাকটেরিয়া আছে। এরা চামড়াকে সুস্থ রাখে। বেশি হাত ধুলে বা বার বার সাবান দিয়ে স্নান করলে কিন্তু এইসব ব্যাকটেরিয়া মরে যায়। তখন নানারকম চামড়ার অসুখ এবং সংক্রমণ শুরু হয়। 
তবে একটা কথা জানা দরকার। জল পানের সঙ্গে কিন্তু চামড়ার কোষ ভালো থাকার কোনও সম্পর্ক নেই। অনেকে পরামর্শ দেন বেশি করে জল খেলে নাকি ত্বক ভালো থাকবে। এর কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। শরীরে জলের অভাব হলে ত্বক খারাপ হয়ে যায়, এটা ঠিক। কিন্তু উল্টোটা ঠিক নয়। স্বাভাবিক যেটুকু জল পান করেন, সেটাই করবেন। অতিরিক্ত জল খেলে ত্বকের কোনও উপকার হবে না। 
ইউরিনারি ইনফেকশান
শরীর থেকে জল বহির্গত হয় মূলত প্রস্রাবের মাধ্যমে। যদি শরীরে জলের অভাব হয়, তাহলে প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাবে। যাঁরা সারাদিন বাইরে কাজ করেন, বিশেষত মহিলারা, তাঁরা অনেক সময় দিনের বেলা জল কম করে পান করেন। এর মূল কারণ হল বেশিরভাগ কর্মক্ষেত্রে পরিষ্কার শৌচালয়ের অভাব। বাইরে শৌচালয়ে যাওয়ার ভয়ে অনেক মহিলাই সারাদিনে জল পান করেন না। কিন্তু এর ফলে যে প্রস্রাবের পরিমাণ কম হয়, তা থেকে কিন্তু ইনফেকশান হতে পারে। এই এক কাজ করেন বয়স্ক পুরুষেরা, রাত্রে। বয়স্ক পুরুষদের প্রস্টেট গ্ল্যান্ড বড় হবেই। এর অন্যতম উপসর্গ হল রাত্রে বারবার বাথরুমে যাওয়ার বেগ অনুভব করা। এইজন্য বৃদ্ধরা অনেক সময়েই সন্ধ্যার পর জল খাওয়া কমিয়ে দেন যাতে রাতে বারবার উঠতে না হয়। কিন্তু এর ফলে আবার ইনফেকশানের রিস্ক বেড়ে যায়। তাই এরকম উপসর্গ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রস্টেটের অসুখের ওষুধ খান। জল না খেয়ে থাকাটা কিন্তু কোনও সমাধান নয়।
জ্বরের সময় জলের পরিমাণ
গত তিন মাস ধরে ডেঙ্গু এবং অন্যান্য ভাইরাল জ্বরের আউটব্রেক চলেছে। জ্বর হলে কিন্তু জলপানের পরিমাণ বাড়াতে হয়। এমনিতেই জ্বরের সময় শরীরের তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইনসেন্সিবল ওয়াটার লস বেড়ে যায়। অর্থাৎ, আমাদের অজান্তেই শরীর থেকে প্রচুর জল বেরিয়ে যায়। এছাড়া জ্বর হলে বমি হয়, লুজ মোশান হয়, তাতেও প্রচুর তরল শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। সুতরাং জ্বর হলে জল পানের পরিমাণ অনেকটাই বাড়াতে হয়।
ডেঙ্গু জ্বরে আরেকটি বিপজ্জনক ঘটনা ঘটে। এতে মাঝে মাঝে দেখা দেয় ক্যাপিলারি লিকেজ। অর্থাৎ, শরীরের রক্তজালিকা থেকে রক্তের জলীয় অংশ টিস্যুর মধ্যে ঢুকে যায়। এরকমভাবে যদি অনেকটা জল রক্ত থেকে বেরিয়ে চারপাশের কানেক্টিভ টিস্যুতে ঢুকে যায়, তখন দেখা দিতে পারে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। ডেঙ্গু থেকে যে মৃত্যু হয়, সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর জন্য। এইজন্যই চিকিৎসকরা ডেঙ্গু রোগীদের বেশি করে জলপান করতে বলেন। এরকম সময় অবশ্যই শুধু তেষ্টা পেলে জল খাব, সেটা ভাবলে হবে না। তখন পরিমাণ মেপে জলপান করতে হবে। অনেকে আবার ভাবেন যে ইলেক্ট্রোলাইট ওয়াটারই খেতে হবে, মানে ও আর এস। সেটা খাওয়া ভালো। কিন্তু এমনি সাধারণ পানীয় জলেও কাজ হয়। আসল কথা হল শরীরে যে জলের ঘাটতি হয়েছে, সেটা পূরণ করা। সেটা ও আর এস দিয়েও হতে পারে; আবার সাধারণ পানীয় জলেও হতে পারে। 
জলের অভাব ও কোষ্ঠকাঠিন্য
কোষ্ঠকাঠিন্য এক পরিচিত সমস্যা। এর নানা কারণ রয়েছে। ফাইবার জাতীয় খাবারের কমতি, ডায়াবেটিস জাতীয় অসুখ, নানান ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি নানা কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। তবে শরীরে জলের অভাবও কিন্তু এর অন্যতম কারণ। যদি আমাদের শরীরে জলের ভাগ কম হয়, তখন অন্ত্রে নানা খাদ্যরসের ক্ষরণ কমতে শুরু করে। এর ফলেই কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। 
জলবাহিত রোগ
জলের আরেক নাম জীবন, এটা যেমন ঠিক, তেমন  খাবার জল থেকে অনেক রোগ হয়, এটাও কিন্তু বাস্তব। তাই যে জল পান করছেন, সেটা স্বাস্থ্যসম্মত কি না, সেটাও দেখা প্রয়োজন। 
জলবাহিত রোগ কী কী? 
ভাইরাল হেপাটাইটিস, টাইফয়েড, কৃমির সংক্রমণ, পোলিও, কিছু ধরণের ভাইরাল এনসেফালাইটিস, কলেরা, জিয়ার্ডিয়া ইত্যাদি অনেক ধরনের ইনফেকশান ছড়ায় জলের মাধ্যমে। যেখানেই খাবার জলের সঙ্গে অন্যান্য জলের উৎস মিশে যায়, সেখানেই এই সমস্যা হতে পারে। একদম শিশুদের আমরা জল ফুটিয়ে খাওয়াতে বলি। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে এটা সম্ভব নয়। সুতরাং এই ক্ষেত্রে একটা উপায় হল বোতলবন্দি জল কিনে খাওয়া; আর অন্য উপায় হল ইউ ভি ফিল্টার দেওয়া উৎস থেকে জলপান করা। রাস্তার বা রেল স্টেশনের কলের জল কখনওই পান করা উচিত নয়। একই কথা প্রযোজ্য রাস্তার খাবার সম্পর্কেও। দূষিত জলে যদি রান্না করা হয়, তাহলে সেই খাবারেও কিন্তু জীবাণু প্রবেশ করবে। আর এই দুটি কথা ছাড়াও খাদ্যে জীবাণুর সংক্রমণের আরেকটি কারণ হল বাসন ধোওয়ার জলে দূষণ। জলবাহিত রোগ এইজন্যই আমাদের দেশে এত বেশি। বিশেষত, বর্ষাকালে এই ধরনের রোগ বেশি ছড়ায়। এইজন্য আজকাল স্বাস্থ্য সচেতন অনেকেই চায়ের দোকানে গিয়ে বলেন মাটির ভাঁড়ে বা কাগজের কাপে চা বা কফি দিতে। সিঙ্গেল ইউজ কাপ ব্যবহার করলে জীবাণু সংক্রমণের সম্ভাবনা কম। 
কিন্তু জীবাণুর সংক্রমণ ছাড়াও জল থেকে আরও কয়েক ধরনের অসুখ হতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু জায়গায় মাটির নীচের জলে আর্সেনিক দূষণ পাওয়া গেছে। ফলে এইসব জায়গায় যাঁরা সেই জল টিউবওয়েল দ্বারা তুলে পান করছেন, তাঁদের শরীরে কিন্তু আর্সেনিক বিষক্রিয়া হতে পারে। সমস্যাটা শুধু এইখানেই শেষ নয়। ধরুন আপনি এরকম আর্সেনিক যুক্ত জলপান করেন না। তাহলেই কি নিরাপদ? যেখানে সব্জি বা ধান চাষ হচ্ছে, সেটা হয়তো আর্সেনিক কণ্টকিত এলাকা। ফলে সেই এলাকায় যে সব্জি উৎপন্ন হল, তাতেও কিন্তু আর্সেনিক থাকবে। এবার বাজারে সেই সব্জি আসতেই পারে। ফলে আর্সেনিক দ্বারা দূষিত জল পান না করলেও শরীরে অজান্তে আর্সেনিক ঢুকে যেতেই পারে। সুতরাং পানীয় জলে আর্সেনিক দূষণ একটি সামগ্রিক সমস্যা। জলে আর্সেনিক দূষণ থেকে চামড়ার নানা অসুখ তো বটেই, তা ছাড়াও লিভারের অসুখ, এমনকী ক্যান্সারও হতে পারে। এই সমস্ত অসুখ কিন্তু একদিনে হয় না। বছরের পর বছর শরীরে একটু একটু করে আর্সেনিক জমা হতে হতে একসময়ে অসুখ দেখা দেবে।
নদীর তীরে যদি কারখানা থাকে, তাহলে সেই কারখানার বর্জ্য নদীর জলেই মিশে যায়। এইসব বর্জ্যের মধ্যে অনেক রকম ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকে। এটা যে শুধু আমাদের দেশের সমস্যা, তা নয়। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই দেখা গেছে যে নদী এবং সমুদ্রের জলে অনেকরকম ক্ষতিকর রাসায়নিক রয়েছে এবং সেই রাসায়নিক জলজ প্রাণীর দেহেও মিশে যাচ্ছে। অবস্থা অনেক জায়গায় এমন যে, আমেরিকার কিছু কিছু জায়গায় সরকার থেকেই মানুষকে নদীর মাছ খেতে নিষেধ করা হচ্ছে। এর কারণ মাছের দেহে পারদ জাতীয় রাসায়নিক মিশে থাকছে এবং সেই মাছ খেলে মানুষের শরীরেও ঢুকছে এইসব বিষ। গর্ভবতী মহিলাদের তো বিশেষ করে কিছু কিছু মাছ খেতে একদম বারণই করে দেওয়া হয়। এ হল ইংল্যান্ড বা আমেরিকার কথা। আমাদের দেশে এই নিয়ে খুব বেশি গবেষণা নেই। তবে এখানেও যে মাছের দেহে একদম ক্ষতিকর রাসায়নিক নেই, সে কথা কখনওই বলা যায় না। সামুদ্রিক প্রাণীর ক্ষেত্রে তো এই আশঙ্কা আরও বেশি। মাছের নানা উপকার আছে ঠিকই, কিন্তু জলদূষণের জেরে সেই মাছ যে আর কতদিন পাতে দেওয়ার যোগ্য থাকবে, সেটা বলা মুশকিল। 
সম্প্রতি জাপান তাদের ফুকুশিমা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বর্জ্য জল সমুদ্রে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও জাপান সরকার জানিয়েছে যে দশ বছর নানাভাবে সংস্কারের পর এই জল সমুদ্রে ফেলা সম্পূর্ণ নিরাপদ, কিন্তু অনেক দেশ এবং পৃথিবীর অনেক মানুষই এই আশ্বাসে ভরসা রাখতে পারছেন না। সুতরাং, যত আমরা কয়লা এবং ডিজেল চালিত পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ করে ‘গ্রিন এনার্জি’র দিকে যাব, ততই নিউক্লিয়ার পাওয়ারের দরকার হবে। আর ততই এরকম তেজস্ক্রিয় জলদূষণের সম্ভাবনা বাড়বে। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে এটাও এক নতুন চ্যালেঞ্জ। এই তেজক্রিয়তা জমা হবে সামুদ্রিক প্রাণীর দেহে এবং সেই প্রাণী কোনও না কোনওদিন উঠে আসবে আমাদের প্লেটে। 
জল ও মানসিক রোগের প্রতিকার
২০১৪ সালে আমেরিকায় ‘ব্লু মাইন্ড’ নামে একটি বেস্টসেলার বই প্রকাশিত হয়। এই বইতে দেখানো হয়েছে বিপুল জলরাশির সংস্পর্শে থাকলে মানুষের মনের শান্তি ফিরে আসে। নানা মানসিক চাপ, অবসাদ, দুঃখ ইত্যাদি থেকে রেহাই পেতে হলে জলের কাছে মাঝে মাঝে থাকা খুব দরকার। এখন তো অনেক জায়গায় একে ‘ব্লু থেরাপি’ বলে ব্যবসাও করা হয়। এটা যে শুধু অলস কল্পনা তা কিন্তু নয়। জলের সামনে এসে মানসিক প্রশান্তি লাভের পেছনে কিছু বৈজ্ঞানিক কারণও রয়েছে। বিশাল জলরাশির সংস্পর্শে এলে যে উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং ক্রিয়েটিভিটি বাড়ে, সে কথা আজকাল অনেক লেখক, বিজ্ঞানী, অভিনেতা বা শিল্পীই নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে স্বীকার করেন। সমুদ্রের তীর বা নদীর ধারে গিয়ে কিছুদিন থেকে মনকে চাঙ্গা করাকে এখন বলা হয় ইকোথেরাপি। কিছু কিছু দেশে তো আস্তে আস্তে আইন পরিবর্তন হচ্ছে যাতে ডাক্তাররা এইরকম মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার অভ্যাস অফিশিয়ালি প্রেসক্রিপশানেও লিখতে পারেন। 
শেষের কথা
জল মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। শুধু পানীয় হিসাবেই নয়। জলের নৈকট্য মানুষের জীবনকে পূর্ণ করে তোলে। পরিবেশ দূষণ এবং ক্লাইমেট চেঞ্জের কারণে পৃথিবীর এই অমূল্য সম্পদ নষ্ট হতে বসেছে। একে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। 

রাশিফল