কখন কতটা জল খাবেন?
সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপান’ নাটকের পথিক এক বৃদ্ধকে বলেছিলেন, ‘তা মশাই আপনার জল আপনি মাথায় করে রাখুন— আপাতত এখন এই তেষ্টার সময়, যা হয় একটু জল আমার গলায় পড়লেই চলবে।’

বর্তমান ওয়েবডেস্ক
এপ্রিল ২৭, ২০২৫
ডাঃ সুবর্ণ গোস্বামী: সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপান’ নাটকের পথিক এক বৃদ্ধকে বলেছিলেন, ‘তা মশাই আপনার জল আপনি মাথায় করে রাখুন— আপাতত এখন এই তেষ্টার সময়, যা হয় একটু জল আমার গলায় পড়লেই চলবে।’ কিন্তু খাবার জল যদি মিলে যায়, তবে কার প্রতিদিন কতটা জল গলায় পড়তেই হবে? দিনে কয় গ্লাস? পৌষের কনকনে শীতে আর ভাদ্র মাসের গুমোট গরমে কি শরীরে জলের প্রয়োজনে কোনও তারতম্য হয়? হার্টের ব্যামো আর পেটখারাপে জল পানের কম-বেশি হয় কেন? কী বললেন, জানতে চান? নাটকের মামা চরিত্রের কথা ধার করে বলতেই হয়, ‘আ হা হা! কী উৎসাহ! শুনেও সুখ হয়।’ আসুন, জলের মতো করে বুঝিয়ে বলা যাক।
প্রথমেই জানতে হবে জল আমাদের শরীরে কোথায় কতটা থাকে এবং তার কাজ কী? সাধারতভাবে পুরুষদের শরীরের মোট ওজনের প্রায় ৬০ শতাংশ ও নারী শরীরের ৫০ শতাংশই আসলে জল। মহিলাদের স্নেহের আধিক্যের জন্য এই পার্থক্য, কেননা স্নেহপদার্থে জল কম থাকে। শিশুদের শরীরে জলের শতাংশ আরও বেশি। শরীরের অন্দরমহলে নানা অঙ্গে জলের পরিমাণ কম-বেশি থাকে। সবচেয়ে বেশি থাকে আমাদের মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ও বৃক্কে। এই অঙ্গগুলির ৮০ শতাংশেরও বেশি হল জল। পেশি, যকৃত্ ত্বকের ৭০ শতাংশ বা তারও বেশি হল জল। রক্তের অর্ধেকটাই আসলে জল। এমনকী হাড়েও সিকিভাগ জল। তবে দাঁতে জল কম থাকে, প্রায় ১০ শতাংশ। তার চেয়েও কম জল থাকে চর্বিতে।
জল আমাদের শরীরে মূলত তিনটে কাজ করে—তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, কোষের ভিতরের বিপাকীয় কার্যকলাপ ও বর্জ্য নিষ্কাশন।
একজন মানুষের দৈনিক কতখানি জল পান করা প্রয়োজন, তা অনেকগুলি বিষয়ের জটিল মিথোস্ক্রিয়ার উপর নির্ভর করে। তবে সাধারণভাবে শীতপ্রধান অঞ্চলে বা শীতকালে শরীরে জলের চাহিদা কম থাকে। ফলে জল পানের পরিমাণ না কমালে ঘনঘন মূত্রত্যাগ করে শরীর অতিরিক্ত জল বের করে দেয়। আবার গ্রীষ্মপ্রধান দেশে বা গরমকালে শরীরে জলের চাহিদা বাড়ায় আমরা তৃষ্ণার্ত হই। অর্থাৎ স্থানভেদে বা ঋতুভেদে দৈনন্দিন শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপ চালিয়ে যেতে যতখানি জল প্রয়োজন, শরীর নিজের থেকেই তা জানান দেয়। তাই ওই বিষয়গুলিকে বিবেচনায় না রেখে সাধারণভাবে একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের দৈনিক কতটা জল পান করা দরকার, তা নির্ণয় করতে গেলে জানতে হবে তাঁর শরীরে জলের অনুপাত ঠিক কতখানি রয়েছে। অর্থাৎ, স্বাভাবিকের চেয়ে তা কতটা কম বা বেশি। এই নির্ণয়ের জন্য ডাঃ পি ই ওয়াটসনের এক ফর্মুলা ব্যবহার করা যেতে পারে, যা মামুলি পাটিগণিতের সাহায্যে কোনও মানুষের শরীরে জলের শতাংশের একটা অনুমান দেয়। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই ফর্মুলাটি হল—
২.৪৪৭ + (০.০৯১৫৬ x আপনার বয়স যত বছর) + (০.১০৭৪ x আপনার উচ্চতা যত সেন্টিমিটার) + (০.৩৩৬২ x আপনার ওজন যত কিলোগ্রাম) = আপনার শরীরে মোট জলের পরিমাণ (লিটারে)।
মহিলাদের ক্ষেত্রে বয়স যাই হোক না কেন, ফর্মুলাটি হল—
(০.১০৬৯ x আপনার উচ্চতা যত সেন্টিমিটার) + (০.২৪৪৬ x আপনার ওজন যত কিলোগ্রাম) - ২.০৯৭ = আপনার শরীরে মোট জলের পরিমাণ (লিটারে)।
এক লিটার জলের ওজন এক কিলোগ্রাম ধরলে আপনার শরীরে থাকা জলের ওজন কত কিলোগ্রাম তা পেয়ে গেলেন। এবার তাকে আপনার শরীরের মোট ওজন দিয়ে ভাগ করে ভাগফলকে ১০০ দিয়ে গুণ করলেই আপনার মোট ওজনের কত শতাংশ জল, তা বেরিয়ে আসবে। মোটামুটিভাবে পুরুষের ক্ষেত্রে তা যদি ৫০ শতাংশের কম ও মহিলাদের ক্ষেত্রে ৪২ শতাংশের কম হয়, তাহলে আপনাকে দৈনিক আরও বেশি জল পান করতে হবে। আর জলের শতাংশ যদি পুরুষদের ক্ষেত্রে ৬৬ শতাংশের বেশি ও নারীদের ক্ষেত্রে ৫৪ শতাংশের বেশি হয়, তাহলে দৈনিক জল পান কমাতে হবে। জল কম খেলে যেমন শরীরে জলের অভাবজনিত নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে, তেমনই জল বেশি খেলে আবার তারও বিষক্রিয়া দেখা দেয়। জল পান পর্যাপ্ত হচ্ছে কি না তা সাদা চোখে দেখে বোঝার একটা সহজ উপায় হল মূত্রের রংয়ের দিকে লক্ষ রাখা। মূত্রের স্বাভাবিক রং হাল্কা হলদেটে। জল খাওয়া কম হলে মূত্র গাঢ় হলুদ বর্ণ ধারণ করে।
কিন্তু জল পান মানে কি আক্ষরিক অর্থে শুধুই জল পান? না, তা নয়। যদিও জল আর জলপাই এক নয়, তাও জলপাই থেকে কিছুটা জল তো পাওয়াই যায়। সারাদিনে আমাদের শরীরের মোট জলের যা প্রয়োজন, তার অন্তত অর্ধেকটা বিশুদ্ধ, নিরাপদ পানীয় জলে মেটে। বাকিটা আসে অন্য বিভিন্ন পানীয় যেমন চা, কফি, দুধ, ডাল, ঝোল ইত্যাদি থেকে এবং বেশ কিছু সব্জি ও ফল, যেগুলোয় জলের পরিমাণ বেশি থাকে। অর্থাৎ, যাঁরা সারাদিনে জলে ভরা নানা ফল, সব্জি ও অন্যান্য পানীয় যথেষ্ট পরিমাণে খান, তাঁদের জল একটু কম খেলেও চলে। তবে ক্যাফেইন ও অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় বেশিমাত্রায় নিলে আখেরে তা শরীর থেকে জল বের করে দেয় প্রস্রাবের মাধ্যমে। ফলে শেষবিচারে এইসব পানীয় পান করলে দিনের শেষে শরীরে জলের চাহিদা বাড়ে বই কমে না।
শারীরিক কসরৎ আপনার শরীরে জলের চাহিদা বাড়িয়ে তোলে। ব্যায়াম বা খেলা বা দীর্ঘ পরিশ্রমসাধ্য কাজ শুরু করবার আগে ও শেষ করবার পরে তাই বাড়তি জল খাওয়া উচিত। অতিরিক্ত ঘাম নিঃসরণ হয় এধরনের কাজ করলে, উষ্ণ আবহাওয়ায় থাকলে, ডায়রিয়া ও বমি হলে বা কোনওরকম সংক্রমণের ফলে জ্বরে ভুগলে জল ছাড়াও শরীর থেকে অনেকটা লবণ বেরিয়ে যায়। ফলে শরীরে বাড়তি জলের সঙ্গে বাড়তি লবণও দরকার হয়। সেক্ষেত্রে ঘন ঘন নুন-চিনি-জল বা ওআরএস খাওয়া উচিত।
থাইরয়েডের সমস্যা, কিডনির রোগ, লিভারের সমস্যা বা হার্টের রোগ থাকলে আপনার জল পান সীমিত করতে হতে পারে। কারণ, সেক্ষেত্রে স্বাভাবিক পরিমাণে জল পান করলেও তা এই অঙ্গগুলির ক্ষতি করতে পারে। নির্দিষ্ট রোগ ও তার তীব্রতা অনুযায়ী আপনার চিকিৎসক আপনাকে উপদেশ দেবেন আপনি দৈনিক কতটা জল খেতে পারবেন। এছাড়াও বেশ কিছু ওষুধ আছে যেগুলি টানা খেয়ে গেলে আপনার শরীর জল সঞ্চয় করে রাখে। যেমন বেশ কিছু ব্যথা কমানোর ওষুধ, অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট ইত্যাদি। বয়স্ক মানুষদের আবার এমনিতেই জল পিপাসা কম পায়। তার উপর তাঁরা যদি উচ্চরক্তচাপ বা অন্য কারণে নিয়মিত ডাইইউরেটিক জাতীয় ওষুধ খান, তাহলে বাড়তি জল শরীর থেকে বেরিয়ে যায় প্রস্রাবের মাধ্যমে। এই ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে তাঁদের তৃষ্ণা পাবার জন্য অপেক্ষা না করেই নির্দিষ্ট সময় অন্তর নির্দিষ্ট পরিমাণ জল খাওয়াতে হবে।
আমাদের শরীরের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা আছে— জল বা এমনকী খাদ্য থেকে প্রাপ্ত ক্যালরি যদি ঘন ঘন সরবরাহ না করা হয়, তাহলে এগুলো জমিয়ে রাখা। ফলে আপনি যদি ঘন ঘন জল পান না করেন, আপনার শরীর বাড়তি জল সঞ্চয় করে রেখে আপনার ওজন বাড়িয়ে তোলে, আপনার শরীরের নীচের অংশ, অর্থাৎ পায়ের পাতা ও তার উপরের অংশ ফুলে ওঠে। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও পা-ফোলা আটকাতে অন্তত পক্ষে দু’ঘন্টা অন্তর কয়েক ঢোঁক জল খেতে হবে।
গর্ভাবস্থায় মহিলাদের বাড়তি জলের দরকার হয় গর্ভস্থ ভ্রুণের জন্য। তার চেয়েও বেশি জলের প্রয়োজন হয় প্রসবের পরের কয়েক মাস, মাতৃদেহে পর্যাপ্ত দুগ্ধ উৎপাদনের জন্য।
তাপমান, আবহাওয়া, পরিশ্রমের মাত্রা ইত্যাদি সমস্ত বিষয় ভেদে শরীরে জলের প্রয়োজনের তারতম্য সত্ত্বেও দৈনিক জল পানের সাধারণভাবে সারা বিশ্বে যে ফর্মুলা ব্যবহৃত হয়, তা হল— আপনার শরীরের যত পাউন্ড (এক কিলোগ্রাম = ২.২ পাউন্ড) ওজন, তার অর্ধেক আউন্স (এক আউন্স = ২৯.৫ মিলিলিটার) জল আপনাকে খেতে হবে রোজ। অর্থাৎ আপনার ওজন যদি ৭০ কেজি (১৫৪ পাউন্ড) হয়, তবে আপনাকে দৈনিক মোট ৭৭ আউন্স (২.৩ লিটার) জল খেতে হবে। আপনি যদি ব্যায়াম বা উচ্চ পরিশ্রমসাধ্য কোনও কাজ বা স্পোর্টসে যুক্ত থাকেন, তবে প্রতি আধঘণ্টা ব্যায়াম বা পরিশ্রমের জন্য ১২ আউন্স (৩৫০ মিলিলিটার) হিসেবে বাড়তি জল যোগ করবেন। গর্ভাবস্থায় দৈনিক ২৪ আউন্স (৭০০ মিলিলিটার) ও ব্রেস্টফিডিংয়ের সময়ে দৈনিক ৩২ আউন্স (৯৫০ মিলিলিটার) বাড়তি জল খেতে হবে।
উপরের হিসেব অনুযায়ী আপনার দৈনিক জল পানের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক হয়ে গেলে আপনি বারবার অল্প অল্প করে জল পান করুন যাতে ২৪ ঘণ্টায় আপনার মোট জল গ্রহণ ওই পরিমাণ হয়। বিশেষত ঘুম থেকে উঠে খালিপেটে, প্রতিবার খাবার আগে ও কিছুক্ষণ পরে, ব্যায়াম বা খেলতে নামার আগে ও পরে, প্রতিবার ব্রেস্টফিডিংয়ের আগে ও পরে জল খাওয়া উচিত। ‘অবাক জলপান’-এর ওই তৃষ্ণার্ত পথিকের মতো অনেক বাধা পেরিয়ে এক গ্লাস নিরাপদ পানীয় জল গলায় ঢেলে কোনওক্রমে তৃষ্ণা নিবারণ করার চেয়ে বাইরে বেরলে সবসময় নিজের জলের বোতল সঙ্গে রেখে তৃষ্ণা পাওয়ার আগেই একটু একটু করে জল খাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে। লেখক: জনস্বাস্থ্য আধিকারিক।
related_post
অমৃত কথা
-
‘বিবেকচূড়ামণি’
- post_by বর্তমান
- জুলাই 19, 2025
এখনকার দর
-
ইউরো
- post_by Admin
- জুলাই 17, 2025
-
পাউন্ড
- post_by Admin
- জুলাই 17, 2025
-
ডলার
- post_by Admin
- জুলাই 17, 2025
-
রুপোর দাম
- post_by Admin
- জুলাই 18, 2025
-
সোনার দাম
- post_by Admin
- জুলাই 18, 2025
-
নিফটি ব্যাঙ্ক
- post_by Admin
- জুলাই 18, 2025
-
নিফটি ৫০
- post_by Admin
- জুলাই 18, 2025