শনিবার, 19 জুলাই 2025
Logo
  • শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫

তৃষ্ণার শান্তি রকমারি শরবত

 তীব্র তাপদগ্ধ দিনে শরীর মন স্নিগ্ধ সতেজ করতে সুস্বাদু, সুবাসিত শীতল পানীয় হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার গরম দেশগুলোয় যুগযুগ ধরে শরবত অত্যন্ত জনপ্রিয়।

তৃষ্ণার শান্তি রকমারি শরবত

শম্পা চক্রবর্তী: তীব্র তাপদগ্ধ দিনে শরীর মন স্নিগ্ধ সতেজ করতে সুস্বাদু, সুবাসিত শীতল পানীয় হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার গরম দেশগুলোয় যুগযুগ ধরে শরবত অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিভিন্ন ধরনের ফলের রস, ফুলের পাপড়ি, দুধ, দই, ঘোল, মধু, চিনি, গোলাপজল, কেশর, হিবিস্কাস, চন্দন, ল্যাভেন্ডার, তুলসী, পুদিনা, আদা, দারচিনি, ইত্যাদি অসংখ্য প্রাকৃতিক উপাদান মিশিয়ে বহু প্রাচীনকাল থেকেই নানাধরনের অতি সুস্বাদু পানীয় তৈরি হয়, যা অতিথি আপ্যায়ন থেকে তৃষ্ণা নিবারণ সবক্ষেত্রেই অপরিহার্য। দ্বাদশ শতকের প্রাচীন পার্শিয়ান পুঁথিতে শরবতের উল্লেখ থেকে জানা যায় সে সময়েও মানুষ শরবতের ব্যবহার জানতেন। যদিও শরবতের আবিষ্কর্তা হিসেবে ১৬০০ শতকে অ্যান্টনিও ল্যাটিনির নামের উল্লেখ আছে, যিনি প্রথম শরবতের প্রস্তুত প্রণালী লিপিবদ্ধ করেন। আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের শৌখিন শরবতের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর ক্ষেত্রে মুঘল সম্রাটদের অবদান অনস্বীকার্য। তবে শরবত যে শুধু তৃষ্ণা নিবারক সুস্বাদু পানীয়ই নয়, বিভিন্ন শারীরিক সমস্যাতেও সমান উপকারী।
হরেক রকমের সুস্বাদু শরবত—
নানা ধরনের শরবতের মধ্যে কোনটার স্বাদ আপনার পছন্দ, কোনটা কার জন্যে উপকারী বা কোন কোন উপাদানগুলো আপনার কাছে সহজলভ্য সেইমতো নীচের তালিকা থেকে পছন্দসই সুস্বাদু, দেহমন স্নিগ্ধকারী শীতল পানীয়টিকে নিজেই বেছে নিতে পারেন।
(১) নুন-লেবুর শরবত
উপকরণ: পাতিলেবুর রস, বিটনুন, চিনির গুঁড়ো, জল ও বরফকুচি।
উপকারিতা: প্রাকৃতিক ওআরএস হিসেবে নিমেষে দেহমনকে চাঙ্গা করে তোলে। ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধ করে, দেহের ওয়াটার-ইলেকট্রোলাইট ব্যালান্স ঠিক রাখে, লেবুর রসের ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, অ্যানেমিয়া, দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত পড়া, ঠোঁটের কোণে ঘা ইত্যাদি সমস্যা দূর করে। সর্দিকাশি ও জ্বরেও এই শরবত অত্যন্ত উপকারী। তবে বরফ বা ঠান্ডা জল ব্যবহার করা যাবে না। সাধারণ ঘরের তাপমাত্রায় পান করতে হবে এই পানীয়।
(২) কাঁচা আম পোড়ার শরবত:
উপকরণ: পোড়ানো বা সেদ্ধ করা কাঁচা আম, চিনি, বিটলবণ, গোলমরিচ গুঁড়ো, ভাজা জিরে গুঁড়ো, জল।
উপকারিতা: দেহের জল ও ইলেকট্রোলাইটিস ব্যালান্স ঠিক রাখে, ডিহাইড্রেশন দূর করে, হজম ভালো রাখে, কনস্টিপেশন দূর করে। কাঁচা আমের পটাশিয়াম রক্তের উচ্চচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে (তবে এক্ষেত্রে শরবতে লবণ ব্যবহার করা যাবে না), ডায়াবেটিকরা চিনি ছাড়া এই শরবত খেতে পারেন। পটাশিয়াম রেস্টিকটেড ডায়েটে থাকলেও চলবে না এই শরবত।
(৩) বেলের শরবত
উপকরণ: পাকা বেলের শাঁস, গুঁড়ো দুধ বা দই, নুন, গুড় বা চিনি, বরফ, জল।
উপকারিতা: বেলে প্রচুর পরিমাণে সল্যুবল ডায়েটারি ফাইবার, ক্যারোটিনয়েডস, ভিটামিন সি, পটাশিয়াম ইত্যাদি ছাড়াও যথেষ্ট পরিমাণে স্টার্চ ও কিছু পরিমাণে প্রোটিন আছে। কনস্টিপেশন, ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম, হজমের সমস্যা, হাইপারটেনশন, হাইপার লিপিডেমিয়া, আন্ডারওয়েট, অনিদ্রা ইত্যাদি বিভিন্ন রোগে বেলের শরবত উপযুক্ত। বেলের শরবতে ব্যবহৃত দুধ বা দই ক্যালশিয়াম ও প্রোটিন সমৃদ্ধ হওয়ায় হাড় মজবুত রাখতে সাহায্য করে। রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে এই শরবত।
ডায়াবেটিকরা বেলের শরবত খেতে চাইলে অল্প পরিমাণে খাবেন এবং এতে চিনি মেশানো যাবে না। বয়স্ক মানুষজনের জন্যে বেলের শরবত অত্যন্ত উপকারী। কারণ, হজমশক্তি ভালো রাখা, কনস্টিপেশন দূর করা, হাড়ের ভঙ্গুরতা প্রতিরোধ করা, ক্যাটারাক্ট বা ম্যাকুলার ডিজেনারেশন প্রতিরোধ করা এবং ক্যান্সার ও অ্যালঝাইমার্স প্রতিরোধে সাহায্য করে এই বেল পানা বা বেলের শরবত।
(৪) আনারসের শরবত
উপকরণ: পাকা আনারস, জিরে ভাজার গুঁড়ো, বিটলবণ, গোলমরিচের গুঁড়ো, চিনি বা চিনির সিরাপ, লেবুর রস, জল, বরফকুচি।
উপকারিতা: আনারসে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টস, ক্যালশিয়াম এবং ডায়েটারি ফাইবার থাকে।
জ্বরজারি, সর্দিকাশি, ব্রঙ্কাইটিস, বদহজম, কনস্টিপেশন, জন্ডিস, জিভ ও ঠোঁটে ঘা, অস্টিওপোরোসিস ইত্যাদি সমস্যা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে আনারস। দেহের ওয়াটার ইলেকট্রোলাইট ব্যালান্স ঠিক রেখে ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধে সাহায্য করে আনারসের শরবত। আনারসের ব্রোমেলিন এনজাইম হজম ও বিপাক ভালো রাখে এবং দেহের বাড়তি ওজন কমায়। ওবেসিটিতে এই আনারসের শরবত অত্যন্ত উপকারী। তবে তা হতে হবে চিনি ও লবণবিহীন। রক্তে যাঁদের কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি তাঁরাও চিনি ছাড়া এই শরবত খেতে পারেন। আনারসের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স মাঝারি ধরনের, তাই ডায়াবেটিকরা মাঝেমধ্যে খেতে পারলেও খাবেন অল্প পরিমাণে এবং অবশ্যই চিনি ছাড়া।
যাঁদের আনারস বা সাইট্রাস ফ্রুটে অ্যালার্জি আছে তাঁরা আনারসের শরবত খাবেন না। যাঁরা হজম সংক্রান্ত সমস্যা বা অত্যধিক অ্যাসিডিটিতে ভোগেন তাঁদেরও চলবে না এই শরবত। হার্টের রোগীরাও অবশ্যই মাত্রামাফিক খেতে পারেন আনারসের শরবত।
(৫) শসার শরবত
উপকরণ: কচি শসা, ধনেপাতা কুচি, বিটলবণ, লেবুর রস, পুদিনাপাতা, চিনি বা স্টিভিয়া, জল, বরফ, কাঁচালঙ্কা।
উপকারিতা: শরীরকে শীতল ও সতেজ  রাখতে এই শরবতের জুড়ি নেই। যাঁরা ওজন কমাতে চাইছেন, তাঁরা প্রাণভরে পান করতে পারেন অত্যন্ত লো-ক্যালরির ভিটামিনস ও মিনারেলস সমৃদ্ধ এই শসার স্মুদি। ডায়াবেটিস থেকে হার্টের রোগী, ক্যান্সার থেকে কনস্টিপেশন, বদহজম থেকে গেঁটে বাত প্রায় সবক্ষেত্রেই চলতে পারে এই দুর্দান্ত টকঝাল শরবত। চিনির বদলে প্রাকৃতিক বিকল্প চিনি হিসেবে স্টিভিয়া ব্যবহার করতে পারেন।
(৬) তরমুজের শরবত
উপকরণ: তরমুজ, চিনি বা সুগার সাবস্টিটিউট, পাতিলেবু, বিটলবণ বা লো সোডিয়াম সল্ট।
উপকারিতা: তরমুজে ক্যালরির পরিমাণ অত্যন্ত কম, জলীয় ভাগ খুব বেশি হওয়ায় তীব্র দাবদাহের সময়ে এক গ্লাস ঠান্ডা ঠান্ডা তরমুজের শরবত পান করতে পারলে নিমেষে দেহের শুষ্কতা ক্লান্তি, দুর্বলতা দূর হবে, দেহ-মন হয়ে উঠবে তরতাজা। তরমুজে প্রচুর পরিমাণে লাইকোপিন জাতীয় তীব্র শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টস থাকে যা ব্রেস্ট ও প্রস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লাইকোপিন ও ভিটামিন সি যুক্ত তরমুজের শরবত জ্বরজারি ও সর্দিকাশিতেও বেশ উপকারী। যাঁরা ওজন কমাতে চান তাঁরাও নির্ভয়ে খেতে পারেন অত্যন্ত কম ক্যালরির সুস্বাদু, পুষ্টিকর এই পানীয়। তবে বাদ দিতে হবে চিনি ও লবণের অংশ। অনেকেই মনে করেন ডায়াবেটিকদের তরমুজ খাওয়া উচিত নয়। তরমুজের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স সামান্য বেশি হলেও এতে কার্বোহাইড্রেট বা সুগারের পরিমাণ অনেকটাই কম হওয়ায় গ্লাইসেমিক লোড অর্থাৎ রক্তে সুগার ধারণ ক্ষমতা বাড়ায় না। ফলে ডায়াবেটিকরাও নির্ভয়ে খেতে পারেন চিনিবিহীন তরমুজের শরবত। তবে অবশ্যই মাত্রামতো।
তরমুজে পটাশিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকায় হার্ট ও কিডনির বিশেষ বিশেষ অসুখে যেখানে উচ্চ পটাশিয়ামযুক্ত খাবারে নিষেধাজ্ঞা থাকে, সেখানে এই শরবত চলবে না।
(৭) আঙুরের শরবত বা আঙুরের জুস
উপকরণ: কালো বা সবুজ আঙুর, বিটলবণ, লেবু, চিনি বা সুগার সাবস্টিটিউট, জল, বরফ।
উপকারিতা: অত্যন্ত সুস্বাদু, অভিজাত এই ফলের রস ভিটামিন সি, ভিটামিন বি, ম্যাঙ্গানিজ, পটাশিয়াম ও ফ্ল্যাভোনয়েডস জাতীয় বিভিন্ন অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টের গুণে সমৃদ্ধ হওয়ায় আর্থ্রাইটিস, অ্যাজমা, বদহজম, কনস্টিপেশন, প্রি-ম্যাচিওর এজিং, ত্বকের র‌্যাশ, অ্যালার্জি, সানবার্ন এবং বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে আঙুরের রস। ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে চিনি ছাড়া আঙুরের শরবত। ডায়াবেটিসেও মাত্রামতো চলতে পারে এই  শরবত, তবে চিনি ছাড়া, বলাই বাহুল্য। আঙুরে থাকে লিউটিন, জি-জ্যানথিন, কোয়েরসেটিন, অ্যান্থোসায়ানিন রেসডেরাট্রল ইত্যাদি বিভিন্ন শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টস, যা হৃদরোগ থেকে ক্যান্সার বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
অতিরিক্ত পরিমাণে এই শরবত খাওয়া হলে ডায়েরিয়া, পেটব্যথা, অ্যালার্জি ও কিডনির সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। ডায়াবেটিস ও ওবেসিটিতে বিশেষজ্ঞের নির্দেশ মেনেই এই শরবত খাবেন।
(৮) ডাবের শরবত
উপকরণ: ডাবের জল, ডাবের শাঁস, স্বাদমতো লবণ ও চিনি (দরকার হলে), জল ও বরফ।
উপকারিতা: কচি ডাবের জল সুদৃশ্য আধারে সংরক্ষিত অত্যন্ত সুস্বাদু ও সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এক উৎকৃষ্ট মানের শরবত যা একাই একশো। ডাবের জলে পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ফসফরাস ও কিছু পরিমাণ বি-ভিটামিনস আছে। তৃষ্ণা মেটানো ছাড়াও দেহকে জলশূন্যতা থেকে রক্ষা করে। ওয়াটার-ইলেকট্রোলাইটস ব্যালান্স ঠিক রাখে, দেহের তাপমাত্রার সাম্যতা রক্ষা করে। উচ্চরক্তচাপ, বদহজম, ডায়েরিয়া, পেটের গোলমাল, ক্লান্তি, জ্বর, আইবিএস, ওবেসিটি, জন্ডিস ইত্যাদি সমস্যার মোকাবিলাতে ডাবের জল অত্যন্ত উপকারী। ডাবের জল মিষ্টি হলেও ডায়াবেটিস রোগীরা স্বচ্ছন্দে খেতে পারেন। অকালবার্ধক্য প্রতিরোধেও সাইটোকাইনস যুক্ত ডাবের জল বেশ উপকারী।
তবে যাঁদের পটাশিয়াম রেস্ট্রিকশন আছে তাঁরা ডাবের জল খাবেন না।
(৯) আপেল শরবত
উপকরণ: আপেল, লবণ, চিনি, পুদিনাপাতা, জল, বরফ। চিনির বদলে মধু ব্যবহার্য।
উপকারিতা: বিভিন্ন ভিটামিনস, মিনারেলস ও ফাইটো নিউট্রিয়েন্টস সমৃদ্ধ আপেলের শরবত বা আপেলের জুস হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অ্যানেমিয়া, হাইপারলিপিডেমিয়া, আর্থ্রাইটিস, জ্বরজারি, কনস্টিপেশন, চোখের সমস্যা ও বিভিন্ন প্রদাহজনিত অসুখ-বিসুখ প্রতিরোধে সাহায্য করে। ডিহাইড্রেশন, বদহজম, গাউট ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যাতেই অত্যন্ত উপকারী আপেলের শরবত।
(১০) আখের গুড়ের শরবত
উপকরণ: আখের গুড়, লেবুর রস, পুদিনাপাতা, জল।
উপকারিতা: এই শরবতে ক্যালরির মাত্রা বেশি এবং আয়রন, ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, বি-ভিটামিনস ইত্যাদি কিছু পরিমাণে থাকে। গরমের সময় শরীর শীতল রাখতে এবং দ্রুত ক্লান্তি দূর করতে আখের গুড়ের শরবতের জুড়ি নেই। হজমের সমস্যা দূর করে পেট ঠান্ডা রাখতেও সাহায্য করে এই শরবত। বাড়ন্ত বাচ্চা, অপুষ্টি বা রক্তাল্পতায় বেশে ভালো কাজ দেয় আখের গুড়ের শরবত। তবে আখের গুড় যেন অত্যন্ত বিশুদ্ধ হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতেই হবে।
ডায়াবেটিস, ওবেসিটি বা প্রদাহজনিত সমস্যা থাকলে চলবে না এই শরবত।
(১১) লিচুর শরবত
উপকরণ: পাকা সুমিষ্ট লিচু, লবণ, লেবুর রস, গোলমরিচের গুঁড়ো, পুদিনাপাতা, জল, বরফকুচি।
উপকারিতা: অত্যন্ত সুস্বাদু, সুবাসিত এই পানীয় ভিটামিন সি, ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, কপার ও বিভিন্ন রোগপ্রতিরোধী অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট সমৃদ্ধ। তীব্র গরমে শরীরে ওয়াটার ইলেকট্রোলাইট ব্যালান্স ঠিক রাখতে সাহায্য করে লিচুর শরবত। ঋতু পরিবর্তনের সময় জ্বর ফ্লু প্রতিরোধে এই শরবত বেশ উপকারী। ফ্ল্যাভোনয়েডস ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ লিচু ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। তবে লিচুতে কার্বোহাইড্রেট ও ক্যালরির মাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ায় ডায়াবেটিক ও স্থূলকায়াদের জন্য উপযুক্ত নয়।
(১২) খাট্টা-মিঠা শরবত
উপকরণ: টকদই, কাজুবাদাম, কিসমিস, খেজুর, আখের গুড় বা চিনি, লবণ, জাফরান, বরফ ও জল।
উপকারিতা: অত্যন্ত সুস্বাদু উৎকৃষ্ট মানের এই শরবতে আয়রন, ক্যালশিয়াম, প্রোটিন, ক্যালরি, পটাশিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিনস ইত্যাদি পুষ্টি উপাদান থাকে। অপুষ্টি, ক্লান্তি, দুর্বলতা, আন্ডারওয়েট, অ্যানিমিয়া প্রভৃতি সমস্যা দূর করতে এই শরবতের জুড়ি নেই। গর্ভবতী মায়েদের জন্যেও উপকারী এই শরবত। শরীরের ওয়াটার ইলেকট্রোলাইটস ব্যালান্স ঠিক রাখা ও গরমে শরীরকে স্নিগ্ধ শীতল রাখা ছাড়াও ইনস্ট্যান্ট এনার্জি দেয় এই শরবত।
(১৩) দইয়ের  শরবত/ দইয়ের ঘোল/ ছাচ
উপকরণ: টকদই, চিনি/ মধু, বিটলবণ, পুদিনাপাতা, জিরে ভাজার গুঁড়ো, এসেন্স, বরফ, জল।
উপকারিতা: গরমে শরীর শীতল রাখার জন্যে বাঙালির ঘরে ঘরে দইয়ের শরবত পানের রেওয়াজ আছে। নানা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ সুস্বাদু এই পানীয়। প্রোটিন, ক্যালশিয়াম, আয়রন, বি ভিটামিনস এবং  প্রোবায়োটিকের গুণাগুণ থাকায় এই দইয়ের শরবত বা দইয়ের ঘোল হজমে সাহায্য করে। কনস্টিপেশন দূর করে, দাঁত ও হাড় ভালো রাখতে সাহায্য করে, মেটাবলিজম বাড়ায় ও রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। হাইব্লাডপ্রেশার, অ্যানিমিয়া, আইবিএস, গলব্লাডার স্টোন, ডায়াবেটিস এবং হার্টের রোগেও চলতে পারে দইয়ের ঘোল। তবে স্বাস্থ্যকর উপায়ে লস্যি বা দইয়ের ঘোল বানাতে হলে চিনিবিহীন, ননফ্যাট দই ব্যবহারই বাঞ্ছনীয়। ওজন কমাতে চাইলে অবশ্যই ডায়েটে রাখতে হবে এই উপকারী শরবত।
দক্ষিণ ভারতে এই দইয়ের শরবতের সঙ্গে বিভিন্ন পছন্দসই মশলা, আদার রস, হার্বস ইত্যাদি মেশানো হয়— যাকে বলে নিরমোর। আবার অন্ধ্রপ্রদেশে একে বলে মাজ্জিগা।
আম পান্না
উপকরণ: কাঁচা আম, চিনি, গোলমরিচ, জিরে ভাজার গুঁড়ো, কাঁচালঙ্কা, পুদিনাপাতা, ঠান্ডা জল, তুলসীপাতা, বরফ।
উপকারিতা: তীব্র গরমের দাবদাহ থেকে শরীর শীতল ও সতেজ রাখতে আম পান্নার জুড়ি নেই। মরশুমের জ্বরজারি, সর্দিকাশি ও হজমের গোলমাল দূর করতেও সাহায্য করে কাঁচা আম পান্না। কাঁচা আমে পর্যাপ্ত পরিমাণে পটাশিয়াম, ভিটামিন সি ও অন্যান্য ফাইটোকেমিক্যালস থাকে এবং পুদিনাপাতা, তুলসীপাতা, হার্বস ইত্যাদি পেট ঠান্ডা রাখে ও রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
এছাড়াও বাদামের শরবত, মৌরি মিছরির শরবত, পাকা আমের শরবত, স্ট্রবেরির শরবত, কালোজামের শরবত, আখের শরবত ইত্যাদি অগণিত রকমের শরবত আছে যা বিভিন্ন প্রাদেশিক অঞ্চল ভিত্তিতে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এইসব শরবতের উপকারিতাও অনেক। যেমন পেট ঠান্ডা রাখতে ও লিভার ভালো রাখতে মৌরির শরবত, আখের শরবত, ব্লাডসুগার নিয়ন্ত্রণে কালোজাম বা স্ট্রবেরির শরবত, অপুষ্টি দূর করতে বাদাম বা আমের শরবত ইত্যাদি।
শরবত কিন্তু শরবত নয়
কাঠফাটা রোদ্দুর আর ঘেমো গরমের দিনগুলোতে তীব্র দহনজ্বালা জুড়োতে বাজারে হাজির নানা ধরনের ফ্রুটজুস, মকটেল, স্মুদি ইত্যাদি। এগুলো শরবতের মতো পানীয় হলেও ঠিক শরবত নয়। বৈচিত্র্যময় স্বাদ, গন্ধ ও রঙের বিচারে এই বিভিন্ন ধরনের পানীয় শিশু থেকে বৃদ্ধ যে কোনও বয়সের ক্রেতাসাধারণের মনোরঞ্জনেই  সিদ্ধহস্ত।
বিভিন্ন ধরনের ফ্রুটজুসে এক বা একাধিক রকমের ফল যেমন আপেল, আম, আনারস, স্ট্রবেরি, ক্যানবেরি, অরেঞ্জ, লাইম, লেমন, মেথন ইত্যাদি ব্যবহৃত হতে পারে।
স্মুদি
স্মুদিতে বিভিন্ন ধরনের লেবু জাতীয় ফল, কলা, আপেল, পাকা আম, পাকা পেঁপে, পিচ, বেরি, আনারস, টম্যাটো, আঙুর, সবেদা ইত্যাদি ছাড়াও  শসা, পালং, লেটুস, পার্সলে, বাঁধাকপি, গাজর ইত্যাদি নানারকম আনাজপাতিও ব্যবহৃত হতে পারে। স্মুদির স্বাদ বাড়ানোর জন্যে হরেক কিসিমের ফল ও সব্জির পাশাপাশি দই, ক্রিম, আইসক্রিম, বাদাম, সিডস ইত্যাদিও ব্যবহার করা হয়।
বাজারের কেনা স্মুদিতে চিনির পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। ফ্রুটজুস, কর্নসিরাপ, বিভিন্ন ধরনের আর্টিফিশিয়াল কালার ও এসেন্স বেশি থাকার জন্যে বাজার চলতি স্মুদি বা রেস্তরাঁর লোভনীয় স্মুদিতে পুষ্টিগুণ অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়।
অন্যদিকে খুব সহজেই ঘরে সামান্য খরচে বানিয়ে নেওয়া যায় হেলদি টেস্টি স্মুদি। ঘরে বানানো স্মুদিতে পুষ্টিগুণ অনেকাংশেই অবিকৃত রেখে স্বাদও বাড়ানো যায়। স্মুদির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একাধারে পানীয় ও খাদ্য। অত্যন্ত ব্যস্ততাময় সকালে কর্মরতা মহিলারা ব্রেকফাস্ট বানানোর জন্যে আলাদা করে সময় না পেলে আপেল, কলা, মুসম্বি, আঙুর, আনার, পেঁপে, পিচ, ইত্যাদি পছন্দসই ফলের সঙ্গে ওটস, বার্লি, আমন্ড, সিয়াসিড, টকদই, কিসমিস, খেজুর ইত্যাদি মিশিয়ে বানিয়ে নিন অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর স্মুদি। এই ধরনের স্মুদিতে ডায়েটারি ফাইবার, ভিটামিন সি, ক্যারোটিনয়েডস, আয়রন, ক্যালশিয়াম, প্রোটিন, বি-ভিটামিনস ও বিভিন্ন অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টস পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকায় একটা কমপ্লিট হোলসাম মিল হিসেবে গণ্য হয়, অনেকক্ষণ পেটভরা থাকে ও এনার্জেটিভ রাখে।
অন্যদিকে কনস্টিপেশন, ডায়াবেটিস টাইপ-টু, ওবেসিটি হাইপারলিপিডেমিয়া ইত্যাদি সমস্যা থাকলে স্মুদিতে ফলের বদলে মেশান বিভিন্ন ধরনের সব্জি, হার্বস ও সবুজপাতা শাক।
অনেক বাচ্চা ও বৃদ্ধ মানুষ আছেন, যাঁরা মোটেই পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার খেতে চান না, অরুচি বা হজমের সমস্যা আছে, সলিড খাবারের সমস্যা আছে তাদের জন্যে নানা ধরনের স্মুদি খুবই উপকারী। তবে এক্ষেত্রে কোন কোন ধরনের সমস্যায় কোন কোন রকমের স্মুদি চলতে পারে বা পারে না, সে ব্যাপারে ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ মেনে চলা উচিত। যেমন ডায়াবেটিস বা ওবেসিটিতে চলবে না হাইগ্লাইসেমিক ইনডেক্স যুক্ত ফল, কিডনি বা হার্টের বিশেষ কিছু সমস্যায় চলবে না হাইপটাশিয়াম যুক্ত ফল ও সব্জি, গ্যাসের সমস্যা থাকলে চলবে না চিনি বা সুগার সাবস্টিটিউটস ও কিছু সাইট্রাস ফল ইত্যাদি।
মকটেল: অ্যালকোহল বিহীন, বিভিন্ন ধরনের ফল ও ফলের রস, সিরাপ হার্বস ও বিশেষ বিশেষ মশলাসহ সুগন্ধি মিশ্র পানীয়ই হচ্ছে মকটেল। সারা পৃথিবীতে অগণিত রকমের মকটেল প্রচলিত আছে। যা অত্যন্ত জনপ্রিয় যেমন ভার্জিনমেরি, আরনল্ড পামার, ভার্জিন কোলাডা, রয় রজারাস, ফঁ মার্গারিটা, ক্রিস্টাল লাইট, ভার্জিন মোহিটো, পিনাকোলাডো, শার্লি টেম্পল, ব্লু লেগুন, সানসেট মকটেল, ম্যাঙ্গো পাঞ্চ মকটেল ইত্যাদি, যা অত্যন্ত সুস্বাদু ও রিফ্রেশিং পানীয়। মকটেলের প্রধান উপকরণ হিসেবে সাধারণত বিভিন্ন রসাল ফল যেমন পাকা আম বা কাঁচা আম, তরমুজ, কালো ও সবুজ আঙুর, আনারস, মুসম্বি, কমলালেবু বিশেষত ভ্যালেন্সিয়া অরেঞ্জ, বেদানা, বেরি, শসা ইত্যাদি এবং পাতিলেবুর রস, চিনি বা সুগার সিরাপ, আদা সোডা ওয়াটার, কোল্ড ড্রিঙ্ক, জল, বরফ, পুদিনা এসেন্স ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। অনেক সময়েই তাজা ফলের বদলে ফ্রুট এসেন্সযুক্ত বিভিন্ন ধরনের ফ্রুট সিরাপ ব্যবহার করা হয় বাজার চলতি বিবিধ মকটেলে। কখনও কখনও বিভিন্ন রকমের কালার ও ফ্রুট সল্টও ব্যবহার করা হয়। তবে মকটেলে শুধুই যে ফল ব্যবহার করতে হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। কফি, চকোলেট, ক্যারামেল, দুধ, বরফ, আইসক্রিম, ক্রিম ইত্যাদি সুস্বাদু উপাদানের সমন্বয়ে অনেক সময় সুস্বাদু ও রিফ্রেশিং মকটেল মুহূর্তমধ্যে দেহ-মনের ক্লান্তি দূর করে মুড ভালো করে দেয়, কাজে নতুন এনার্জি জোগায়।
মকটেলে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের তাজা রসাল মরশুমি ফল থেকে সোডিয়াম পটাশিয়াম, ভিটামিন সি, তরল, ক্যারোটিনয়েডস, ফ্ল্যাভোনয়েডস ও নানা ধরনের পলিফেনলস, বি-ভিটামিনস, কিছু পরিমাণ ডায়েটারি ফাইবার ফ্রুকটোজ পাওয়া যায়। দেহের ওয়াটার-ইলেকট্রোলাইট ব্যালান্স ঠিক  রাখা, ডিহাইড্রেশন ও সানস্ট্রোক প্রতিরোধ করা, ক্লান্তি দূর করা, হজম ও বিপাক ঠিক রাখা, সিজনাল ফ্লু ও জ্বর সর্দিকাশি প্রতিরোধ করা, রক্তে হিমোগ্লোবিন ও প্লেটলেটস লেভেল ঠিক রাখা, নাইট ব্লাইন্ডনেস, ক্যাটারাক্ট ও ম্যাকুলার ডিজেনারেশন প্রতিরোধ করা, স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্ম বজায় রাখা, রক্তসঞ্চালনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখার মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে মকটেলের অবদান আছে।
মকটেলের খারাপ দিক:
অতিরিক্ত চিনি, সোডা বা নরম পানীয়, কৃত্রিম রং, এসেন্স বা ফ্রুট সিরাপ, ক্রিম ইত্যাদি মকটেলের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত সামগ্রী দিনের পর দিন শরীরে অতিমাত্রায় প্রবেশ করলে তা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। স্থূলত্ব, টাইপ টু ডায়াবেটিস, কিডনির সমস্যা, গ্যাসট্রিক আলসার, দাঁত ও হাড়ের ক্ষয়, লিভারের সমস্যা, থাইরয়েড গ্রন্থির ক্যান্সার, ADHD অ্যালার্জি সহ বিভিন্ন সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে মকটেলে ব্যবহৃত এইসব ক্ষতিকর উপাদান শরীরে অতিমাত্রায় প্রবেশ করলে। তাই এটি বুঝেশুনে খাওয়া উচিত।
হোম কুকদের হেঁসেল থেকে কিছু স্বাস্থ্যকর মকটেলের হদিশ
বাজার চলতি মকটেলকে রিপ্লেস করুন স্বাস্থ্যকর উপাদানে তৈরি ঘরোয়া মকটেলের সাহায্যে। যেমন আনারসের মকটেল, গ্রিন ম্যাঙ্গো মকটেল, গ্রিন অ্যাপেল, ম্যাঙ্গো মিউল, গ্রিন-টি কিউকাম্বার মকটেল, সানসেট মকটেল, ম্যাঙ্গো পাঞ্চ মকটেল, আনারস-বেদানার মকটেল, কালোজাম-আঙুরের মকটেল, ব্ল্যাক গ্রেপস মকটেল, গোয়াভা চিলি মকটেল ইত্যাদি।
ঘরোয়া পদ্ধতিতে তৈরি মকটেলকে স্বাস্থ্যকর করার জন্যে চিনির বদলে মধু বা স্টিভিয়র ব্যবহার করুন, সোডা বা নরম পানীয়র বদলে থাক লেবুর  রস, সাধারণ লবণের বদলে বিটলবণ বা পিঙ্কসল্ট ব্যবহার করতে পারেন। দুধ বা দই ব্যবহার করতে চাইলে ফুলক্রিমের বদলে ফ্যাট ফ্রি অপশন বেছে নিন।
ইনফিউসড ওয়াটার
সুস্বাদু, রিফ্রেশিং ও ম্যাজিকাল ড্রিংকস হিসেবে নানা ধরনের শরবত, ফ্রুটজুস আর মকটেল এক্কেবারে লা-জবাব! কিন্তু তাই বলে দিনের পর দিন তো এসব খেয়ে শরীর জুড়নো যায় না! কারণ ভালো লাগার বাইরে এইসব ড্রিংকসের ক্ষতিকর দিকের কথাও মাথায় রাখতে হবে। অগত্যা উপায়? ‘ওয়েলকাম টু দ্য ওয়ার্ল্ড অফ ইনফিউসড ওয়াটার।’ এ প্রসঙ্গে আমার মেয়ের নিজের হাতে বানানো কয়েক ধরনের ইনফিউসড ওয়াটারের রেসিপি পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার না করে পারছি না।
ভ্যালেন্সিয়া অরেঞ্জ ইনফিউশন: এখন বাজারে বেশ সুস্বাদু, রসাল, উজ্জ্বল কমলা রঙের ভ্যালেন্সিয়া অরেঞ্জ উঠছে। এই ধরনের অরেঞ্জ খোসাসহ পাতলা পাতলা স্লাইস করে কেটে তার সঙ্গে পুদিনাপাতা, অ্যাপেল সিডার ভিনিগার, স্টিভিয়া বা সামান্য মধু মিশিয়ে কাচের মেসেঞ্জারে জলে পূর্ণ করে ফ্রিজে এক-দেড় ঘণ্টার জন্যে রেখে পান করে দেখুন। অত্যন্ত রিফ্রেশিং, হেলদি, গিল্ট ফ্রি ড্রিংকস হিসেবে এর তুলনা নেই।
 মিন্ট-মেলন ইনফিউশন: তরমুজের স্লাইজের সঙ্গে লেবুর রস, পুদিনাপাতা আর জল মিশিয়ে ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করে খান। চমৎকার। তরমুজের লাইকোপিন অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট ক্যান্সার ও বিভিন্ন রোগবিসুখ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
 লেটুস-মিন্ট-কিউকাম্বার ইনফিউশন: পদ্ধতি একই, উপকার অনেক। বদহজম ও ওবেসিটিতে দারুণ উপকারী। একই পদ্ধতিতে গাজর পালং, কালোজাম, বাতাবি লেবু, মুসম্বি, কমলালেবু, আঙুর, আনার ইত্যাদি বিভিন্ন রসাল ফল এবং বিশেষ বিশেষ কিছু সব্জি দিয়ে বানিয়ে নিতে পারেন এই হেলদি টেস্টি ড্রিংকস। ওয়াটার ইলেকট্রোলাইট ব্যালান্স, ডিহাইড্রেশান প্রতিরোধ, ডিটক্সিফিকেশান, বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ এবং কনস্টিপেশন ও বদহজমের সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে এই ধরনের ড্রিংকস।
ফ্রুট জুস কতটা ভালো?
গরমের দিনে পথচলতি মানুষজনের তৃষ্ণার শান্তি হিসেবে প্যাকেটবন্দি সুস্বাদু সুরভিত শীতল ফলের রসের দুর্নিবার আকর্ষণের কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। শিশুদের আবদার মেটানোর জন্যেও অনেক সময় বড়রা শিশুর হাতে ক্যানড বা প্যাকেট ফ্রুট জুস তুলে দিয়ে নিজেদের গিল্ট ফ্রি রাখার চেষ্টা করেন। ভাবেন, কোল্ড ড্রিংকস তো আর নয়, ফলের রস! সুতরাং অসুবিধে কোথায়!
বিভিন্ন নামী দামি কোম্পানির ফলের রস যেমন তুলনামূলকভাবে বেশি দামে সহজেই বাজারে মেলে, তেমনই অনেক নামগোত্রহীন লোকাল মেড ফলের রসও বাজারে পাওয়া যায় অপেক্ষাকৃত কম দামে। দু’ধরনের ফলের রসের ক্ষেত্রেই ক্রেতাসাধারণের সংখ্যা রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো।
আম, লিচু, আপেল, পেয়ারা, স্ট্রবেরি, কমলালেবু, আনারস, মিক্সড ফ্রুট, আমলকী, মুসম্বি, বেদানা, আঙুর ইত্যাদি ধরনের মরশুমি ফল থেকে শুরু করে আজকাল ডাবের জলের মতো সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পানীয়ও পাওয়া যায় বোতল বন্দি দশায়। ক্যানড বা প্যাকড ফ্রুট জুসকে আরও অনেক বেশি বেশি করে বিজ্ঞাপিত করার জন্যে প্যাকেটের গায়ে বড় বড় হরফে লেখা থাকে ‘no added Sugar,’ ‘No added Preservatives’ ‘With goodness of fiber’, ‘With vitamin A & C’, ‘No added Colour’... ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিন্তু আদতে তা কতটা কার্যকরী? ‘No added Sugar’ লেখা থাকলেও পিওর ফলের রসে যে পরিমাণ ফ্রুকটোজ থাকে তা যে কোনও কোমল পানীয়ের সঙ্গে সহজেই তুলনীয়।
 প্রিজারভেটিভস ব্যবহার না করেও দীর্ঘদিন ফলের রসকে সংরক্ষণ করার জন্যে পাস্তুরাইজেশন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। এবং গ্লাস বটল বা টেট্রা প্যাক ব্যবহার করা হয়। তাতে ফলের রসের সংরক্ষণ সীমার মেয়াদ বাড়ানো গেলেও তাজা ফলের রসের গুণাগুণ মোটেই অবিকৃত রাখা সম্ভব নয়।
 প্রিজারভেশনের দরুণ ফলের স্বাভাবিক ভিটামিনস ও অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টস অনেকাংশেই নষ্ট হয়ে যায়। বিশেষত ক্যারোটিনয়েডস, ফ্ল্যাভোনয়েডস, ভিটামিন সি, পটাশিয়াম ইত্যাদি অপরিহার্য পুষ্টি উপাদানের অভাব থাকে ফলের রসে।
 তাজা ফল থেকে রস করে তা সংরক্ষণ করার সময় ডায়েটারি ফাইবারের মতো হেল্থ এসেনশিয়ালস ধ্বংস হয়ে যায়। অর্থাৎ তখন ফলের রস পান আর চিনিজল পান মোটামুটি সমার্থক হয়ে পড়ে।
 সংরক্ষণের দরুণ ফলের রসের সৌরভ নষ্ট হলে কৃত্রিম উপায়ে সুগন্ধিযুক্ত করে তা বাড়ানো হয়।
 রঙের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কৃত্রিম রং ব্যবহার করে ফলের রসের বা কৃত্রিম পানীয়ের রং আরও আকর্ষণীয় করে তোলা হয়।
Prevention of Food Adulteration Act অনুযায়ী ভারতে ফলের রস, সিন্থেটিক সিরাপ, ফ্রুট বেভারেজ সফট ড্রিংকস, নন কার্বোনেটেড সিন্থেটিক বেভারেজে নির্দিষ্ট কিছু কৃত্রিম রঙের মাত্রামতো ব্যবহার স্বীকৃত। যেমন টার্ট্রাজাইন (হলুদ), সানসেট ইয়েলো (হলুদ), কারমোজাইন (লাল), এরিথ্রোসাইন (লাল), পনসিউ-৪ আর (লাল), ব্রিলিয়ান্ট ব্লু (নীল), ইন্ডিগো কারমাইচ (নীল), ফাস্ট গ্রিন (সবুজ) ইত্যাদি। তবে দুঃখের বিষয় প্রায় প্রতিটি কৃত্রিম রঙেরই মাত্রাছাড়া ব্যবহার বা দীর্ঘদিনের ব্যবহারের ফলে অ্যালার্জি, টিউমার, শ্বাসকষ্ট, ভ্রুণের ক্ষতি, নার্ভাস সিস্টেমের ক্ষতি, শিশুদের অতিসক্রিয়তা, মনোযোগের অভাব এবং ক্যান্সারের মতো অসুখের ঝুঁকিও বেড়ে যেতে পারে।
একশো শতাংশ খাঁটি ফলের জুস কথার অর্থ তাতে আলাদাভাবে কোনও চিনি, প্রিজারভেটিভস, ফ্লেভার, কালার ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় না। বিশুদ্ধ ফলের রস অথবা পাল্প নির্দিষ্ট অনুপাতে জলসহ বা জলবিহীন অবস্থায় বিক্রিত হয় ১০০% খাঁটি ফলের জুস। তবে এ ধরনের  খাঁটি ফলের জুসেও  কিন্তু ফাইবার, ভিটামিনস, মিনারেলস, অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টস ইত্যাদির যেমন চূড়ান্ত ঘাটতি থাকে, তেমনই ফ্রুকটোজের পরিমাণও বেশি থাকে।
কখন পান করবেন পানীয়?
কখন ফলের রস, শরবত বা স্মুদি খাওয়ার জন্যে উপযুক্ত সময়— এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে বলা যায় ভিন্ন ভিন্ন মানুষ, ভিন্ন ভিন্ন সময়, ভিন্ন ভিন্ন তরল পানীয় নিতেই পারেন— যাঁর যেমন পছন্দ বা যাঁর যেমন সহ্য হয়। এ ব্যাপারে কঠোর কোনও নিয়মাবলি না থাকলেও বেশিরভাগ মানুষই দেখা গেছে ব্রেকফাস্টে বা ইভনিং-এ স্মুদি খেতে পছন্দ করেন। মাঝ সকালে অর্থাৎ ব্রেকফাস্ট ও লাঞ্চের মাঝে সাধারণত শরবত ও ফলের রস খান। তবে রোদ থেকে তেতে পুড়ে এলে অথবা রোদে বেরনোর আগে একগ্লাস হেলদি ড্রিংক অবশ্যই আপনাকে ডিহাইড্রেশন বা হিটস্ট্রোক থেকে মুক্ত রাখবে, সন্দেহ নেই। ওজন কমাতে চাইলে সকালে খালিপেটে একগ্লাস ইষদুষ্ণ জলের সঙ্গে পাতিলেবুর রস মিশিয়ে খেলে যে অত্যন্ত উপকার পাবেন, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। কিন্তু যাঁরা অম্বল, গ্যাস, বদহজম বা হাইপার অ্যাসিডিটির সমস্যায় ভুগছেন তাঁরা যদি সাতসকালে লেবু-জল খেয়ে ফেলেন তো সমূহ বিপদ। বিভিন্ন ধরনের ইনফিউসড ওয়াটার যেহেতু ডিটক্সিফিকেশনের কাজ করে, তাই সকালে খালিপেটে বা ব্রেকফাস্টের আগে খাওয়াই দস্তুর। অনেকের ধারণা আছে রাতের বেলা ফল খাওয়া যায় না, কিন্তু ব্যাপারটা সেরকম নয়। যে কোনও সময় ফল খাওয়া যেতে পারে। ডিনারে একটু ভারী খাওয়া হয়ে গেলে রাতে শোওয়ার আগে আপনি অনায়াসেই একগ্লাস লেবু-জল বা ডিটক্সওয়াটার খেয়ে নিতেই পারেন। ভালো বই মন্দ হবে না। আবার যাঁদের ভরপেট খাওয়ার পরে একটু মিষ্টি ফলের রস পানের অভ্যাস আছে, তাঁরা চেষ্টা করুন এ ধরনের বদঅভ্যাস বাতিল করতে, প্রি-ডায়াবেটিক বা ডায়াবেটিকদের ক্ষেত্রে এটা হঠাৎ রক্তের গ্লাইসেমিক লোড বাড়িয়ে দিয়ে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এইসব আর কী!
সাবধানতা
ক্রনিক কিডনি ডিজিজ বা পটাশিয়াম রেস্ট্রিকটেড ডায়েটে থাকলে ফলের রস এবং শরবত এড়িয়ে চলতে হবে। কতটা পরিমাণে কোন কোন ফল ডায়েটে রাখতে পারেন, সে ব্যাপারে আপনার ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নিন।
 কেনা শরবতের তুলনায় ঘরে বানানো শরবত অনেক ভালো। ঘরোয়া এই শরবতকে আরও পুষ্টিকর করার জন্যে চিনি ব্যবহার করবেন না। সাধারণ সোডিয়াম লবণের বদলে লো-সোডিয়াম সল্ট, পিঙ্ক হিমালয়ান সল্ট, বিটলবণ ইত্যাদি খুব অল্প পরিমাণে ব্যবহার করা যেতে পারে।
 অতিরিক্ত শরবত সেবনে অভ্যস্ত হলে দাঁত ও মাড়ির ক্ষতি, ডায়েরিয়া, অ্যাসিডিটি, মাইগ্রেন, ওবেসিটি, টাইপ টু ডায়াবেটিস হতে পারে , তাই রয়ে সয়ে খাওয়াই ভালো।
 সংরক্ষিত ফলের রসের বদলে সম্পূর্ণ তাজা ফল দিয়ে ঘরেই বানিয়ে নিন হোলসাম ফ্রুট জুস, যাতে ডায়েটারি ফাইবার ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মাত্রা কিছুটা অবিকৃত রাখা যায়।
 দুর্বল, অপুষ্ট, বয়স্ক মানুষজন, পোস্ট সার্জারি পিরিয়ড, জন্ডিস, গলা ও খাদ্যনালীর ক্ষতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিভিন্ন মিষ্টি ফলের রস, শরবত ইত্যাদি উপকারী হলেও ডায়াবেটিস, স্থূলত্ব, পিসিওএস ইত্যাদি ক্ষেত্রে উপকারী নয়।
 অ্যানেমিয়া, ডিহাইড্রেশন, হাইপারটেনশন, কনস্টিপেশন ইত্যাদি ক্ষেত্রে ডাবের জল এবং বিভিন্ন সাইট্রাস ফ্রুটস বা সাইট্রাস ফলের শরবত উপযুক্ত।
লেখক : কনসালট্যান্ট ডায়েটিশিয়ান
যোগাযোগ : ৯৮৩০২১৪৯৭১

রাশিফল