শনিবার, 19 জুলাই 2025
Logo
  • শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫

কী করলে, কী খেলে ব্রেন দৌড়বে ঘোড়ার মতো?

আমেরিকান স্ট্রোক অ্যাসোসিয়েশন এবং আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের যৌথ উদ্যোগে এক সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। সমীক্ষার ফলাফল অনুসারে ছোট থেকেই প্রত্যেক ব্যক্তিকে ব্রেন ফিট রাখার জন্য সাতটি ধাপ অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। 

কী করলে,  কী খেলে  ব্রেন দৌড়বে ঘোড়ার মতো?

দেবাঞ্জন পান: আমেরিকান স্ট্রোক অ্যাসোসিয়েশন এবং আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের যৌথ উদ্যোগে এক সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। সমীক্ষার ফলাফল অনুসারে ছোট থেকেই প্রত্যেক ব্যক্তিকে ব্রেন ফিট রাখার জন্য সাতটি ধাপ অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, হৃৎপিণ্ড, স্ট্রোক— এসবের সঙ্গে ব্রেন সতেজ রাখার সম্পর্কটা কোথায়? এক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে, কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ-এর মধ্যে ব্রেন এবং হার্ট উভয় অঙ্গই অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এই ধরনের সংগঠন একসঙ্গে কাজ করলে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। আমরা বরং ওই সংগঠনের বলে দেওয়া পথের সুবিধাগুলির কথা ভাবি। ফিরে আসি আলোচনায়। দু’টি সংগঠনের পক্ষ থেকে সম্মিলিতভাবে সাতটি ধাপ অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে।
সেগুলি কী কী? দেখা যাক—
১) এক্সারসাইজ, ২) স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ, ৩) বিএমআই অনুসারে স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা, ৪) কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ (এই বিষয়টি খাদ্যাভ্যাস এবং এক্সারসাইজের অভ্যেসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত), ৫) রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ, ৬) রক্তচাপ বাড়তে দিলে চলবে না, 
৭) ধূমপান বাদ। 
নিয়মগুলি মেনে চললে মস্তিষ্ক সতেজ থাকতে বাধ্য।
এবার দেখা যাক কী কী লাভ হতে পারে উপদেশগুলি মেনে চললে।
এক্সারসাইজ
ছোটবেলা থেকে খেলাধুলোর অভ্যেসে বাড়ে স্মৃতিশক্তি, মনোনিবেশের ক্ষমতা। এছাড়া ব্রেনের চারটি অংশে বাড়ে গ্রে ম্যাটারের পরিমাণ। জায়গাগুলি যথাক্রমে—  ফ্রন্টাল লোব, সাব কর্টিকাল রিজিয়ন, টেম্পোরাল রিজিয়ন এবং ক্যালকেরাইন কর্টেক্স। ব্রেনের এই চারটি অংশ মূলত একজিকিউটিভ ফাংশন বা কোনও কর্ম সম্পাদনের জন্য দায়ী। আর জটিল কর্ম সম্পাদনের জন্য প্রয়োজন হয় বেশ কতকগুলি বিষয়ের যথা—
ক) মনোনিবেশ, খ) ওয়ার্কিং মেমোরি বা যে স্মৃতি দ্বারা দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা করি, গ) সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, ঘ) পরিকল্পনা করার ক্ষমতা, ঙ) আবেগ নিয়ন্ত্রণ গ্রে ম্যাটার বেশি থাকলে উপরিউক্ত পাঁচটি বিষয়ে ক্ষমতাও বাড়ে। ফলে যে কোনও জটিল কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ করা যায় সহজে। এছাড়া গ্রে ম্যাটার বাড়লে একজন ব্যক্তির মোটর ফাংশনও বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ পেশির সঞ্চালনের ক্ষমতাও বাড়ে। বৃদ্ধি পায় চোখ এবং ব্রেনের কাজের মধ্যে সমন্বয়। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। পড়াশোনা করার সময়ে সবসময় যে লাইনের পর লাইন আমাদের মনে থাকে তা তো নয়। অনেক সময় গোটা পাতাটাই হয়তো ছবি হিসেবে আমাদের মাথায় গেঁথে যায়। কিংবা কোনও বানান, তাও আমরা কখনও কখনও ছবির মতোই মনে রাখি। খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন, পরীক্ষার হলে অনেক সময় কোনও কোনও লাইন মনে থাকে না। তবে চোখে দেখার স্মৃতি অনেকসময় সেক্ষেত্রে ভুলে যাওয়া বানান, বইয়ের কোনও অংশ মনে করতে সাহায্য করে। একইরকমভাবে কান ও ব্রেনের সংযোগসাধনেও বিশেষভাবে সাহায্য করে অংশগুলি।
এখানেই শেষ নয়, দেখা গিয়েছে নিয়মিত শরীরচর্চা করলে বয়স্ক মানুষেরও চিন্তা করার ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং স্মৃতিশক্তি বাড়ে। 
প্রশ্ন হল, কোন ধরনের এক্সারসাইজ করবেন? শরীরচর্চার মধ্যে সবচাইতে ফলদায়ী এক্সারসাইজ হল এরোবিক এক্সারসাইজ। অর্থাৎ হাঁটাহাঁটি, জগিং, স্কিপিং, সাঁতার, সাইক্লিং-এর মতো এক্সারসাইজ।
দেখা গিয়েছে একটানা ছয় সপ্তাহ বা দেড় মাস ২০ মিনিট ধরে হাই ইনটেনসিটি এক্সারসাইজ করলে (অবশ্যই অন্য কোনও শারীরিক সমস্যা থাকলে চলবে না) স্মৃতিশক্তির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়। বাড়ে মনোনিবেশের ক্ষমতা।
খাদ্যাভ্যাস: বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ব্রেন সতেজ এবং সক্রিয় রাখতে যে খাদ্য সবচাইতে বেশি সাহায্য করে তা হল মেডিটেরিনিয়ান ডায়েট। মেডিটেরিনিয়ান ডায়েটে সবচাইতে বেশি থাকে সবুজ শাকসব্জি, ফল, চাল বা অন্য ধরনের শস্যদানা, ডিম, বাদাম, বীজ এবং অলিভ অয়েল। তার সঙ্গে খেতে হবে অল্প মাত্রায় ডেয়ারি প্রোডাক্ট— যেমন ঘি, মাখন, পনির ইত্যাদি। আর পাতে অবশ্যই রাখতে হবে সামুদ্রিক মাছ।
গবেষণা বলছে, আমাদের ব্রেনে প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন নিউরোন তৈরি হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া অনবরত চলতেই থাকে। আবার আমাদের শরীরের অন্যান্য কোষের মতো নিউরোনেরও একসময় মৃত্যু ঘটে। এই পরিণতি অনিবার্য। মেডিটেরিনিয়ান ডায়েট এই অনিবার্য পরিণতিকেই প্রলম্বিত করার চেষ্টা করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে আমাদের বাঙালি খাবারের সঙ্গে মেডিটেরিনিয়ান ডায়েটের অনেকখানি মিল আছে। শুধু বাঙালি খাদ্যের ভাজাভুজিগুলো বাদ দিলেই চলে। তবে শুধু মেডিটেরিনিয়ান ডায়েটই নয়। রয়েছে আরও অনেক খাদ্য যা মস্তিষ্ক সতেজ রাখতে সাহায্য করে। সেগুলি কী কী? দেখা যাক—
বাদাম: নানা গবেষণায় দেখা গিয়েছে বিভিন্ন ধরনের বাদাম যেমন পেস্তা, কাজুবাদাম, আখরোট খাওয়ার অভ্যেস মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ায়। এই যে বাইরের পৃথিবীর বিভিন্ন তথ্য আমরা প্রতিনিয়ত পাচ্ছি, সেই তথ্য সংগ্রহ করা এবং সঞ্চিত রাখার ক্ষেত্রে বাদামের নানা উপকারী উপাদান বিশেষভাবে সাহায্য করে।
এছাড়া কগনেটিভ ফাংশনেরও উন্নতি ঘটায়। অর্থাৎ কোনও কিছু বুঝে বিশ্লেষণ করে তারপর ব্রেনে সঞ্চিত রাখা ও সঠিক সময়ে সেই তথ্য মনে করে উচিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে ঠিকঠাক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ হল কগনেটিভ বিহেভিয়ার। বয়সের সঙ্গে কগনেটিভ বিহেভিয়ার স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে নিয়মিত বাদামের সেবন।
তাই বলে আমাদের অতিপরিচিত চিনাবাদামকেও হেলাফেলা করা যাবে না। ব্রেনে সর্বক্ষণ নানা ধরনের ক্ষয় হয় তা পূরণ করতে সাহায্য করে চিনাবাদাম। এছাড়া বাড়ায় স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও।
বীজ ও বাদাম: ভিটামিন ই-এর খুব বড় উৎস বীজ এবং বিভিন্ন ধরনের বাদাম। মস্তিষ্কের নিউরনের মধ্যে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে ভিটামিন ই। একজন ব্যক্তির যত বয়স বাড়ে ততই তার অক্সিডেটিভ স্ট্রেস-এর মাত্রাও বাড়ে। ব্রেনের স্নায়ুকোষগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে বৃদ্ধি পায় ডিমেনশিয়া, অ্যালঝাইমার্সের আশঙ্কা। তাই নিয়মিত নানাভাবে  খেতে হবে সূর্যমুখী বীজ, কুমড়ো বীজ। এছাড়া প্রতিদিন একটা দুটো আমন্ড, হেজেলনাট-এর মতো বাদামজাতীয় খাদ্যও খাওয়া দরকার।
ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড: ব্রেনের কোষ তৈরিতে এবং নার্ভ ফাইবার তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা নেয় ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। তেলযুক্ত মাছে থাকে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। স্যামন, টুনা, সার্ডিনে মেলে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। আমাদের দেশে আর ওসব পাবেন কোথায়? তবে মাছের রাজা ইলিশ মেলে বর্ষায়। সেই মাছেও খুব ভালো ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে। তাই ইলিশ রাখতে পারেন পাতে। এছাড়া আজকাল ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড ক্যাপসুল আকারেও বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের অভাবে ডিপ্রেশন, কাজ করার উদ্যমের অভাব দেখা যেতে পারে।
ডার্ক চকোলেট এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্ট: ডার্ক চকোলেটে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কী কাজে লাগে? আমাদের দৈনন্দিন নানা অভ্যেস যেমন ধূমপান, মদ্যপান, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ থেকে শরীরে একধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে (অক্সিটেটিভ স্ট্রেস) ও নানা ক্ষতিকর পদার্থ তৈরি হয়। এই ধরনের ক্ষতিকর উপাদানের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে শরীরে হানা দেয় ক্লান্তি,  হ্রাস পায় কোনও কিছু মনে রাখার ক্ষমতা, পরিবর্তন ঘটে মনমেজাজের। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এই ধরনের অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে তৈরি হওয়া উপাদানগুলিকে ধ্বংস করতে সাহায্য করে। আসলে ডার্ক চকোলেটের কোকার মধ্যে থাকে ফ্ল্যাভোনয়েড নামে বিশেষ উপাদান যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। ফ্ল্যাভোনয়েড মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালনে সাহায্য করে। সহায়তা মেলে নতুন কিছু শেখা এবং স্মৃতি ধরে রাখার ক্ষেত্রেও। বিশেষ করে মস্তিষ্কের যে যে অংশগুলিতে শেখার জায়গা আছে, সেইসব অংশগুলিতে নিউরোনের বৃদ্ধি ঘটে ফ্ল্যাভোনয়েডের ইতিবাচক প্রভাবে। এমনকী ডার্ক চকোলেট ‘ব্রেন প্লাস্টিসিটি’ বাড়ায়। পরিবেশের প্রয়োজন অনুসারে ব্রেনের কোষের সজ্জা পরিবর্তন করে নেওয়ার ক্ষমতাকে বলে নিউরোপ্লাস্টিসিটি বা ব্রেন প্লাস্টিসিটি। গবেষণা বলছে, নিউরোপ্লাস্টিসিটি বা ব্রেন প্লাস্টিসিটি নতুন কিছু দ্রুত শিখতে সাহায্য করে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কর্মপদ্ধতি দ্রুত শিখে নিয়ে সেই অনুসারে কার্য সম্পাদনের ক্ষমতা বাড়ায়। 
বেরি: বিভিন্ন ধরনের বেরি জাতীয় ফলেও রয়েছে ফ্ল্যাভোনয়েড। এই ধরনের ফল তাই ব্রেনের কার্যকারিতা বাড়ায়। উদাহরণ হিসেবে স্ট্রবেরি, ব্ল্যাক বেরি, ব্লু বেরি, ব্ল্যাক কারেন্ট-এর মতো ফল ব্রেন ডেভেলপমেন্টে বিশেষ উপকারী। এই ধরনের ফল মস্তিষ্কের বিভিন্ন ধরনের নিউরোনের মধ্যে সংযোগ বাড়ায়। দ্বিতীয়ত সারা শরীর ও মস্তিষ্কের মধ্যে প্রদাহ কমানোর চেষ্টা করে। স্ট্রেসের মুখে শান্ত হয়ে কাজ করার দক্ষতা বৃদ্ধি করে।
কফি: কফিতে মেলে ক্যাফিন। মস্তিষ্কের মধ্যে নিজস্ব যে মেটাবলিজম, তার ফলে তৈরি হয় অ্যাডিনোসিন। অ্যাডিনোসিন ঘুম ঘুম ভাব আনতে সাহায্য করে। ক্যাফিন এই তন্দ্রাভাব আনতে বাধা দেয়। দেখা যাচ্ছে শুধুমাত্র একজন ব্যক্তিকে সজাগ করাই নয়, তার সঙ্গে মস্তিষ্কের তথ্য বিশ্লেষণ ব্যবস্থাকেও সমৃদ্ধ করে। এই কারণে কফি খেয়ে বহু মানুষ কাজের জন্য আলাদা করে উদ্দীপনা অনুভব করেন।
কফিতে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। ফলে ভুলে যাওয়ার অসুখও প্রতিরোধ করে। তবে তাই বলে প্রচুর পরিমাণে কফি খেলে চলবে না। সারাদিনে ১ থেকে ২ বার কফি পান চলতে পারে। তবে বেলা ২টার পর কফি পান না করাই উচিত।
ডিম: ভিটামিন বি ১২ এবং ফোলিক অ্যাসিডের খুব ভালো উৎস ডিম। ধারাবাহিকভাবে ডিম খাওয়ার অভ্যেস মস্তিষ্ক শুকিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া মন্থর করতে পারে। ফলে ডিমেনশিয়া সহ অ্যালঝাইমার্স প্রতিরোধ করে। বাচ্চাদের প্রতিদিন একটি করে ডিম দেওয়া যায়। বড়রাও ডিম খেতে পারেন নিয়মিত।
ব্রকোলি: এই সব্জিতে ক্যালোরির মাত্রা থাকে সামান্য। অথচ থাকে প্রচুর পরিমাণে ডায়েটরি ফাইবার। এছাড়া গ্লুকোসিনোলেটস নামে জৈবিকভাবে সক্রিয় একটি বিশেষ গ্রুপের উপকারী উপাদান রয়েছে ব্রকোলিতে। পরিপাক ক্রিয়ার ফলে  গ্লুকোসিনোলেটস আইসোথায়ানেডস-এ ভেঙে যায় যা অক্সিডেটিভ স্ট্রেসকে অনেকটাই কমায়। এর ফলে নিউরোজেনারেটিভ স্ট্রেস কমে। এছাড়া ব্রকোলি ছাড়াও গ্লুকোসিনোলেটস-এর বড় উৎস হল বাঁধাকপি, ফুলকপি ইত্যাদি।
সয়াবিন: সয়াবিনের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে পলিফেনল থাকে যা একধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। পলিফেনল ডিমেনশিয়া প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। পলিফেনল আসলে এক ধরনের আইসোফ্ল্যাভোন। আমরা জানি আইসোফ্ল্যাভন একধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট।
ব্রেন সাপ্লিমেন্ট
অনেক ক্ষেত্রে  ব্রেন সতেজ রাখতে কিছু কিছু ব্রেন সাপ্লিমেন্ট বিশেষ কাজে আসে। প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি এই ধরনের ব্রেন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করলে উপকারই। তাই ব্রেকফাস্টে এমন কিছু সহায়ক খাদ্য থাকুক যার মধ্যে ভিটামিন ডি, সি, ই, বিটা ক্যারোটিন এবং ম্যাগনেশিয়াম আলাদাভাবে যোগ করা হয়েছে।
খাদ্য এবং সতর্কতা
 অতিরিক্ত শর্করা এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাট মস্তিষ্কের ক্ষতি করে। তাই চিনি, মিষ্টি, পেস্ট্রি, ভাজাভুজির মতো খাদ্য এড়িয়ে চলুন।
 সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ওমেগা থ্রি এবং সিক্স-এর যে অনুপাত থাকা দরকার তার পরিবর্তন হলে অবসাদ, নিউরোনের ক্ষয়ের মাত্রা বাড়তে পারে। আমাদের পূর্বপুরুষের যে ডায়েটের অভ্যেস ছিল তাতে ওমেগা থ্রি-এর মাত্রা অনেক বেশি ছিল। ওমেগা থ্রি এবং ওমেগা সিক্স-এর অনুপাত ছিল ১:১। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ওমেগা ৬ ফ্যাটি অ্যাসিডের মাত্রা ১০ :১ বা ১৮:১ হয়ে গিয়েছে যা অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার এবং ডিপ্রেশনের অন্যতম বড় কারণ। ব্রেন সতেজ রাখতে, তাজা রাখতে এক্সারসাইজ এবং খাদ্য যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা নিয়ে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। তবে এগুলির পাশাপাশি আরও কিছু কাজ করা দরকার। সেগুলি কী কী?
ভাষা শেখা: রাশিয়ার মস্কোর হায়ার স্কুল অব ইকোনমিকস এবং ফিনল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব হেলসিঙ্কির একদল গবেষক গবেষণা করে দেখেছেন বয়স কম হোক বা বেশি, বিদেশি ভাষা শিখলে ব্রেন প্লাস্টিসিটি বৃদ্ধি পায়। এছাড়া মস্তিষ্কের তথ্য গ্রহণ করার সঙ্গে সেই তথ্য ব্রেনে গেঁথে রাখার ক্ষমতা বাড়ায় বিদেশি ভাষার শিক্ষা।
ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গ-এর একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে দুই বা তার বেশি বিদেশি ভাষা শিখলে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ার স্বাভাবিক প্রবণতা দীর্ঘায়িত হয়। অর্থাৎ পরিণত বয়সে দু’টি বা তিনটির বেশি ভাষা শিখলে ভবিষ্যতে যে দ্রুততার সঙ্গে বয়সের সঙ্গে মস্তিষ্কের ক্ষয় হয় সেই আশঙ্কা হ্রাস পায়।
ফলে অ্যালঝাইমার্স, ডিমেনশিয়া হওয়ার আশঙ্কাও কমতে থাকে। 
বাদ্যযন্ত্র : ছোট বয়স থেকেই গিটার, সানাই, বাঁশি থেকে শুরু করে যে কোনও ধরনের বাদ্যযন্ত্র শেখার অভ্যেস মস্তিষ্কের বিকাশে সাহায্য করে। অনেক ক্ষেত্রে তা নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরিতেও বিশেষ ভূমিকা নেয়। আমাদের মস্তিষ্কে যে প্রচুর  নিউরোন রয়েছে এবং তারা যে হাতে হাত রেখে জোট বেঁধে কাজ করে, সেই জায়গায় সাহায্য করে বাদ্যযন্ত্র শেখার অভ্যেস। একেবারে খুদে বয়স থেকেই বাদ্যযন্ত্র শেখার অভ্যেস গড়ে তোলা গেলে তা শ্রবণ ক্ষমতার সঙ্গে ব্রেনের পূর্ণ মেলবন্ধন ঘটাতে সাহায্য করে। একই সঙ্গে যাঁদের জোরে জোরে পড়ার অভ্যেস রয়েছে তাঁদের শ্রবণ ক্ষমতা তীক্ষ্ম হয়। এছাড়া মস্তিষ্কের নিউরোনের যে নেটওয়ার্ক তা আরও শক্তিশালী হয়। বিভিন্ন শব্দকে আলাদা আলাদা করে চিহ্নিত করা ও তার সঙ্গে সঙ্গে নিজের শরীরের সচলতার সমন্বয় ব্যবস্থা আরও উন্নত হয়। 
এবারে কথা বলা যাক প্রতিদিন করা যায় এমন ব্রেন এক্সারসাইজ নিয়ে।
ব্রেন এক্সারসাইজ
জীবনে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা আসে, আর তার সঙ্গে যুঝে নেওয়ার জন্য মস্তিষ্কের যে অংশটি সবচাইতে বেশি কার্যকরী হওয়ার দরকার পড়ে সেই অংশটির নাম প্রি ফ্রন্টাল কর্টেক্স। ছোটদের ক্ষেত্রে নম্বরের ব্যাকওয়ার্ড কাউন্টিং অর্থাৎ ১০০ থেকে ১-এর দিকে গোনার অভ্যেস মস্তিষ্কের প্রি ফ্রন্টাল কর্টেক্সের কার্যক্ষমতা অনেকটা বাড়াতে সাহায্য করে। 
মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন
ছোট হোক বা বড়, মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন মনোনিবেশের ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। কেমন এই মেডিটেশন? একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক। ধরা যাক, আপনি খাবার খেতে বসেছেন। এবার মন দিয়ে লক্ষ করুন প্লেটের রং। প্লেটে কী কী খাবার দেওয়া আছে? কোন কোন খাবারের স্বাদ কেমন? কী কী মশলা দেওয়া আছে। এই প্রক্রিয়া চলাকালীন মন বিক্ষিপ্ত হবে। খাবারে মন দিন। এই যে কোনও একটা বিষয়ে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া, তার সঙ্গে মন বিক্ষিপ্ত হওয়া এবং ফের প্লেটে টেনে আনা— এই প্রক্রিয়াই হল মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন। তবে এই প্রক্রিয়ার আরও অনেক পর্যায় আছে। সেই বিষয়ে অবশ্যই একজন সাইকিয়াট্রিস্ট বা মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন এক্সপার্টের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন।  
মেমোরি কার্ড গেম বা বোর্ড গেম
ছোটবেলায় আমরা যে ‘ব্যবসায়ী’ নামে খেলা খেলতাম তা কিন্তু মোটেই হেলাফেলার বিষয় নয়। মজার ছলে সেই সমস্ত খেলাতেও মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ানোর ইঙ্গিত ছিল। চাইলে বাচ্চাদের ব্রেন পাওয়ার বাড়াতে এখনও সেই সকল খেলার শরণাপন্ন হওয়া যায়। এছাড়া নিউজ পেপারে ক্রসওয়ার্ড পাজল করা, সুদোকু খেলার অভ্যেস নানাভাবে ব্রেনের কগনেটিভ ফাংশনের উন্নতি ঘটায়। আবার জিগশ পাজলের মতো খেলা মস্তিষ্কের ওয়ার্কিং মেমোরি এবং কার্যকারণ বিশ্লেষণের ক্ষমতার উন্নতি ঘটায়। দাবা খেলা আমাদের স্মৃতিশক্তি বাড়াতে এবং ব্রেনের হায়ার ফাংশন বা একজিকিউটিভ ফাংশন উন্নত করতে সাহায্য করে।
কগনেটিভ ফ্লেক্সিবিলিটি এবং ভিডিও গেম
কিছু কিছু ভিডিও গেম আবার মনোযোগ, সমস্যার সমাধান এবং মস্তিষ্কের নমনীয়তা বা কগনাইটিভ ফ্লেক্সিবিলিটির জায়গাটিকে বাড়াতে সাহায্য করে। তা কেমন? এই যে আমরা ছোট থেকে বড় হই একটি পরিবারে, সেই পরিবারের নানা ধ্যানধ্যারণা ও বিশ্বাস আমাদের মস্তিষ্কে প্রোথিত হয়। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরেও এই রকম নানা ধ্যান ধারণা আমাদের মাথা থেকে সরতে চায় না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অনেকের বাড়িতেই খাবারের সময় দুই হাত ব্যবহার নিয়ে আছে ছুঁৎমার্গ। এক হাতেই খেতে হবে এমন রীতি রয়েছে প্রচলিত। দুই হাত লাগালে অন্য হাত সঙ্গে সঙ্গে ধুতে হবে, না হলে হাত এঁটো হয়ে যাবে— এমন বিশ্বাস রয়েছে। এই ব্যক্তিই যখন বাড়ি ছেড়ে অন্য কোনও জায়গায় যাবে তখন সে দেখবে লোকে ছুরি এবং কাঁটা চামচ নিয়ে দুই হাতেই খাচ্ছে! আবার কেউ হয়তো ছোট থেকে দেখেছে তাদের পরিবারে মেয়েদের বাড়ির বাইরে বেরিয়ে কাজ করার রেওয়াজ নেই। সেই লোকই যখন বড় হয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করবে, দেখবে মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে! সেই সময় তার একটা কালচারাল শক তৈরি হবে। মস্তিষ্ক বিষয়গুলিকে মানতে চাইবে না। নানাভাবে বিদ্রোহ করবে। এখন ওই ব্যক্তি যত তাড়াতাড়ি এই বিষয়টিকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারবেন ততই জীবন সহজ হবে।
প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর একজন ব্যক্তির সমগ্র জীবনটাই হল অ্যাডজাস্টমেন্ট। ফলে তাকে পরিবেশের সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চলতে হয়। এইভাবে সহজ বিষয়গুলিকে মানিয়ে নিয়ে চলার জন্য বা আপস করে নেওয়ার জন্য মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট জায়গা থাকে। এছাড়া  নিজের মতটাই যে একমাত্র সত্যি নয়, বরং অন্যদের মতবাদও গ্রাহ্যের মধ্যে আনতে হয় এই বোধটি জাগ্রত হওয়ার পিছনে দায়ী থাকে মস্তিষ্কের ওই অংশটি। বোধের এই বিকাশই হল ‘কগনেটিভ ফ্লেক্সিবিলিটি’। যার ‘কগনেটিভ ফ্লেক্সিবিলিটি’ কম সে জীবনে তত বেশি দুঃখ পায়। বহু স্বামী-স্ত্রী’র মধ্যে মতান্তর মনান্তর ঘটাতে পারে কগনেটিভ ফ্লেক্সিবিলিটির অভাব।
কগনেটিভ ফ্লেক্সিবিলিটি বাড়াতে সাহায্য করে সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে যোগদান, খেলাধুলো, তর্কবিতর্ক করার অভ্যেস ইত্যাদি।
নতুন কাজ: আমাদের মস্তিষ্ক সবসময় নতুনত্ব পছন্দ করে। রুটিন মাফিক চলাফেরায় মস্তিষ্কের কোনও বৃদ্ধি হয় না। তাই ব্রেনকে চ্যালেঞ্জ করুন। রোজনামচার বাইরে বেরিয়ে কাজ করুন। নতুন কোনও কাজে দক্ষতা অর্জনও পারে ব্রেনের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে। উদাহরণ হিসেবে সাঁতার শেখার চেষ্টা বা গাড়ি চালানো শেখার কথা বলা যায়। হঠাৎ করেই শুরু করতে পারেন অঙ্কন, আবৃত্তি, মৃৎশিল্প। সবকটি কাজই মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে পারে।
দেখা গিয়েছে, বেশ কিছু স্পেশাল চিলড্রেন, যাঁদের কথা বলার ক্ষেত্রে সমস্যা আছে তাঁদের ক্ষেত্রে জোরে জোরে উচ্চারণ করে আবৃত্তি করলে মস্তিষ্কের কথা বলার যে অংশ তার কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। অটিজমে আক্রান্ত বাচ্চাকে এভাবে আবৃত্তি শিখিয়ে বিশেষ লাভ হয়েছে। নাচও খুব বড় একটা এক্সারসাইজ। কোনও কিছু অনুষ্ঠান বা কাজ সুপরিকল্পিতভাবে সংগঠিত করার ক্ষমতা বাড়ায় নৃত্য। কারণ নাচে একধরনের ছন্দ আছে। এছাড়া শরীরের যে যে অংশগুলি মস্তিষ্কের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে সেই অংশগুলিকে আরও কার্যকরী করে তুলতে সাহায্য করে নাচ। মনোনিবেশের ক্ষমতা, স্মৃতিশক্তি ধরে রাখতেও নাচের জুড়ি নেই।
ঘুম: ব্রেন সতেজ করতে হলে ঘুমের কথা বলতেই হবে আলাদা করে। মস্তিষ্কের সক্রিয়তা বাড়াতে ঘুমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সারাদিনের মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তি দূর করতে পর্যাপ্ত ঘুম অত্যন্ত জরুরি বিষয়। আমাদের শরীরে সারাদিনের মেটাবলিক যে বর্জ্য তৈরি হয় তা শরীর থেকে দূর করতে  এবং যে যে স্মৃতি সারাদিনে সঞ্চয় করা হয়েছে সেগুলিকে ঠিক ঠিক জায়গায় স্থানান্তরিত করার কাজটি হয় ঘুমের মধ্যে। এই প্রক্রিয়ায় জরুরি স্মৃতি মস্তিষ্কের আরও গভীরে প্রোথিত হয়। এই কারণেই যারা পড়াশোনা করছে তাদের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম অত্যন্ত জরুরি। এই কারণেই পরীক্ষার আগের দিন ৩-৪ ঘণ্টা ঘুমিয়ে তারপর পরীক্ষা দিতে যাওয়ার ধারণাই অত্যন্ত ভুল। কারণ ঘুমের অভাবে স্মৃতি সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে পরীক্ষার খাতায় উত্তর লিখতে গিয়ে কোনও কিছুই সঠিকভাবে মনে পড়ে না!
হাস্যরস: সারাদিনের মধ্যে বার বার হাসার চেষ্টা করুন। হাসলে আমাদের ব্রেনের প্রাকৃতিক ওপিওয়েড রিসেপটরগুলি আরও বেশি করে সক্রিয় হয়ে ওঠে। দেখা গিয়েছে ওপিওয়েড রিসেপটরের মধ্যে দিয়েই কাজ করে মরফিন, মেথিডিন, কোডিনের মতো ড্রাগ ইত্যাদি যা ব্যথা উপশমে সাহায্য করে।
একইরকমভাবে কার্যকরী হতে পারে আমাদের দেহের বিশেষ হরমোন এন্ডোর্ফিন। 
এন্ডোর্ফিন মন-মেজাজ ভালো রাখতে, মনোনিবেশের ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। তাই সারাদিনে মাঝেমধ্যেই হাসলে আমাদের শরীরে স্বাভাবিকভাবে এন্ডোর্ফিন ক্ষরণ হবে যা ওপিওয়েড রিসেপটরগুলিকে সক্রিয় করে তুলবে। এর ফলে ব্যথা বেদনা কমবে। এড়ানো যাবে অবসাদের মতো সমস্যা। তাই হাসুন, সারাদিনে বেশ কয়েকবার হা হা হা করে হাসুন। মজা করুন, মজা নিন!
লিখেছেন সুপ্রিয় নায়েক

রাশিফল