শরবতের গুণ
শরবত সুস্বাদু সুমিষ্ট পানীয়। রমজানে সাবুদানার শরবত তরমুজের টুকরো দিয়ে তৈরি করে পান করার রীতি দীর্ঘ দিনের। শব্দটি এসেছে আরবি ভাষা থেকে। এখন ওটাই যেন খাঁটি বাংলা হয়ে গেছে।

বর্তমান ওয়েবডেস্ক
এপ্রিল ২৭, ২০২৫
ডাঃ সুবলকুমার মাইতি: শরবত সুস্বাদু সুমিষ্ট পানীয়। রমজানে সাবুদানার শরবত তরমুজের টুকরো দিয়ে তৈরি করে পান করার রীতি দীর্ঘ দিনের। শব্দটি এসেছে আরবি ভাষা থেকে। এখন ওটাই যেন খাঁটি বাংলা হয়ে গেছে।
বাঙালির অনেক ব্রতপালনে সাবুদানা (সাগু দানা) ভিজিয়ে রেখে তাতে দুধ ও মিষ্টান্ন এবং কলা প্রভৃতি একসঙ্গে চটকে পাতলা করে খাওয়ার রীতি প্রচলিত। এটি একেবারে পাতলা শরবত না হলেও একটু গাঢ় শরবতের মতো হয়ে থাকে। সহজে পানীয়ের মতো খাওয়া যায়।
গ্রাম বাংলায় আজও ঔষধি দ্রব্য দিয়ে নানা প্রকারের শরবত ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিদের খাওয়ানোর রীতি দেখা যায়। ঋতুভেদে সেটির ব্যবহারের তারতম্য পরিলক্ষিত হয়।
চিরকালীন শরবত
১) নুন, লেবু, চিনি ও জল পরিমাণমতো নিয়ে তৈরি শরবত সারা বছর খাওয়া হয়ে থাকে। নানা সমস্যায় ব্যবহৃত হয়।
২) প্রকৃতির তৈরি শরবত: ডাবের জল, নারকেলের জল। কোনও কিছুই করতে হয় না। ডাব কাটুন আর খান। নারকেলের জল ডাবের মতো সহজ লভ্য নয়, সহজে কেউ খেতে চান না, ক্ষেত্র বিশেষে খাওয়ার বিধান রয়েছে। সুগারের রোগীরা কচি ডাবের জল খাবেন ২০০-২৫০ মিলি লিটার। খেতে যেন কষাটে হয়, সেটিই এঁদের পক্ষে ভালো। সকলের জন্য মাত্রা একই।
ডাবের জল জীবাণু মুক্ত, শীতল পানীয়। শরীরে সোডিয়াম ও পটাশিয়ামের সমতা বজায় রাখে। সারা বছরই খাওয়া চলে।
যাঁরা অপুষ্টিতে ভোগেন, তাঁরা প্রত্যহ ভাত খাওয়ার পর মাঝারি ধরনের একটা ডাবের জল খাবেন। ভেতরে নরম শাঁস থাকলে সেটিও খেয়ে নেবেন। জলটি মিষ্ট স্বাদের হওয়া চাই, ২০০-২৫০ মিলি হলেই ভালো।
রোজ যাঁরা নানা ওষুধ খেয়ে থাকেন, তাঁরা সপ্তাহে ৩-৪টি ডাবের জল খাবেন। দুপুরে ভাত খাওয়ার পর, কষাটে বা মিষ্ট স্বাদের। এতে শরীরে টক্সিন জমতে পারবে না, আর ওষুধের অব্যবহৃত অংশও মূত্রের সঙ্গে বেরিয়ে যাবে।
মূত্রাল্পতায়, মূত্রগ্রন্থির সংক্রমণে দুপুরে ভাত খাওয়ার পর পূর্বের মতো ডাবের জল খাবেন। প্রয়োজনে দিনে ২ বার। তবে কিডনি ফেলিওরের সমস্যা থাকলে, ডাবের জল খাবেন না।
ডাবের জল খেলে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমবে। ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে। শরীরের ওজনও বাড়বে না।
আমরা গরমের দিনগুলোতে ডাবের জল খেতে বেশি পছন্দ করি। অন্য সময় হিসেব করে খেলে আপনি ভালো থাকবেন, পরিবারের সকলকে ভালো থাকতে সাহায্য করবেন। এখন বোতলবন্দি ডাবের জল পাওয়া যাচ্ছে। সেটি কতটা বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সংরক্ষিত হচ্ছে, তা জেনে খাওয়া উচিত। তাছাড়া জলটি প্লাস্টিক বোতলে রাখার জন্য কোনও সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে কি না তা জানা দরকার। তবে এটি মনে রাখা খুবই দরকার—ডাবের টাটকা জল সঙ্গে সঙ্গে খেতে পারলে উপকার বেশি। এমনকী ডাব থেকে জল বের করে গ্লাসে করে খেতে পারেন, তবে কিছুক্ষণ রেখে খাবেন না। বাতাসের সংস্পর্শে এলে গুণগতমান নষ্ট হয়।
গরমের দিনে শরবত
১) প্রত্যহ লিটার খানেক পান্তা ভাতের জলে সামান্য নুন মিশিয়ে কাচের বোতলে রাখুন। সারাদিন ৪-৫ বার খান। বাকি দেড়-দু’লিটার সাধারণ জল খাবেন। ফলে শরীর কেবল ঠান্ডাই হবে না, এই জলে প্রচুর পরিমাণে আয়রন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম, ভিটামিন-বি পাওয়া যায়। প্রথমে এক/দু’ গ্লাস করে খাবেন। সহ্য হলে লিটার খানেক খাবেন। এটাই আমানির শরবত।
২) টক দই, ঘোল, লস্যি, ছানার জল প্রভৃতিতে পরিমাণ মতো গুড়/ চিনি/ নুন প্রভৃতি মিশিয়ে দুপুরে যে কোনও একটি ২০০/২৫০ মিলি খেতে পারেন। গরমে সরাসরি টক দই খাবেন না। তাতে ২ গুণ বা ৪ গুণ জল মিশিয়ে ভালোভাবে ফেটিয়ে খাবেন। সবচেয়ে ভালো ছানার জলের শরবত। এ সবই উপাদেয় সুস্বাদু পানীয়। কোনটা কখন খাবেন, বুঝতে না পারলে চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেবেন।
৩) তরমুজ, লিচু, সবেদা, পাকা আম, পাকা পেঁপে, পাকা বেল, পাকা কাঁঠাল, পাকা আনারস প্রভৃতির যে কোনও একটির শরবত বানিয়ে গ্রীষ্মের দাবদাহে শরীরের ক্লান্তি দূর করতে খেতে পারেন। প্রতিদিন এক একটির শরবত খেলে রুচি ফিরবে। শরীরের বল বৃদ্ধি হবে, হজম ক্ষমতা বাড়বে, হৃদযন্ত্রটি ভালো থাকবে। শরীর থেকে দূষিত পদার্থ বা টক্সিন বেরিয়ে যাবে। পরিমাণমতো ফলের টুকরো ও জল নিয়ে চটকে নিলে শরবত তৈরি হবে। প্রয়োজনে নুন ও চিনি বা গুড় মেশাবেন। সুগারের রোগীরা ভেবেচিন্তে খাবেন।
৪) কাঁচা আমপোড়ার শরবত মাঝে মাঝে খেতে পারলে খুবই ভালো। পরিমাণ মতো নুন মেশাবেন। তবে চিনি মেশাতে হলে অবস্থা বুঝে মেশাবেন।
৫) আখের রস শরবতের মতো মাঝেমধ্যে খাওয়া যায়।
৬) মুসম্বি, কমলালেবু ও আঙুরের শরবত খেতে পারেন। সামান্য বীটনুন মেশালে ভালো।
৭) গরমে ছাতুর (ছোলার ছাতু) শরবত সহ্য হলে খাবেন। লেবুর রস ও নুন পরিমাণমতো মেশালে খুবই সুস্বাদু হয়। পেটটিও ভরে যায়। এটি সকালের দিকে খাওয়াই ভালো।
৮) কচি তালের নরম শাঁস চটকে শরবত বানিয়ে খাওয়া যায়। এখন শহরেও এটি পাওয়া যায়। তবে বেশি খেতে নেই।
শীতের শরবত
১) শরীরের বয়স বাড়লে শীতের দিনে জবুথুবু মনে হয়। যত বেলা পড়তে থাকে, ততই মন বিষণ্ণ হয়ে যায়। তখন আমন্ড ও পেস্তার শরবত বানিয়ে খেলে শরীর তরতাজা হয়ে ওঠে। ৫-৬টি আমন্ড ও ১০-১২টি পেস্তা ৩/৪ ঘণ্টা জলে ভিজিয়ে রাখার পর উপরের খোসা ছাড়িয়ে বেটে তাতে দুধ, জল ও চিনি মিশিয়ে মোট ২৫০ মিলি শরবত বানিয়ে বিকেলের দিকে কয়েকটা দিন খেতে পারেন। আবার ৩০০ গ্রাম আঙুর ১ লিটার জলে চটকে তাতে নুন, মরিচচূর্ণ ও লেবুর রস পরিমাণ মতো মিশিয়ে শরবত বানাবেন। প্রয়োজন মতো মাত্রায় বানাতে হলে আঙুর কম-বেশি নেবেন। সুগার ও প্রেশার বেশি থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খাবেন।
২) দিনে ২ বার এক কাপ গরমজলে তাল মিছরির শরবত চায়ের মতো খেতে পারলে, শরীরে কফের প্রবণতা নষ্ট হবে।
৩) শরীরকে চাঙ্গা রাখতে নাগকেশর ফুল একটি বা দুটি শিলে বেটে, ২০০ মিলি জল মিশিয়ে পরিমাণমতো চিনি দিয়ে ভালোভাবে গুলে ছেঁকে শরবতটি খান সকালে টিফিনের পর। ৮-১০ দিন টানা খেলে বুঝতে পারবেন শরীরটা বেশ চাঙ্গা হয়েছে। শুকনো নাগকেশর ফুল দশকর্মার দোকানে পাওয়া যায়। ভুলে আবার নাগচাঁপা ফুল খাবেন না। এই শরবতটি বছরের যে কোনও সময় সপ্তাহে একদিন করে খেতে পারেন।
সাধারণ কয়েকটি রোগে শরবতের ব্যবহার
১) হঠাৎ শরীরে জলের অভাব হলে: ২০০ মিলি জলে এক চামচ চিনি ও এক চিমটে নুন মিশিয়ে শরবত বানিয়ে বারে বারে খাবেন। অথবা ORS-এর পাউডার ১ প্যাকেট এক লিটার জলে মিশিয়ে ২০০ মিলি করে ৫ বার খেতে পারেন।
২) অজীর্ন-অগ্নিমান্দ্য ও অরুচিতে: নুন, লেবু ও জল দিয়ে শরবত তৈরি করে দু’বেলা ভাত খাওয়ার পর কয়েক দিন খান। অথবা পুদিনার পাতা ও নরম ডগা ৮-১০ গ্রাম আন্দাজ নিয়ে বেটে, সেই বাটা এক গ্লাস জলে মিশিয়ে তাতে সামান্য লবণ, মরিচের গুঁড়ো, কাগজি বা পাতিলেবুর রস ৮-১০ ফোঁটা। প্রয়োজনে সামান্য চিনি বা মিছরি একসঙ্গে মিশিয়ে গুলে, ছেঁকে এই শরবতটি সকালে ও বিকালে দু’বার হালকা টিফিনের পর খেলে উপকার পাবেন। নিয়মিত কিছুদিন খাওয়া দরকার। এর দ্বারা অজীর্ণ-অরুচি-অগ্নিমান্দ্য তো যাবেই, এছাড়া পেট ফাঁপা, পেট ব্যথা, কোষ্ঠবদ্ধতা, অতিসার, পাকস্থলীর প্রদাহ, মূত্রকৃচ্ছ্রতা, দুর্বলতা, হিক্কা, বমি ভাব প্রভৃতিও ধীরে ধীরে কমে যাবে।
৩) পাতলা দাস্তে: নুন, লেবু, চিনির শরবত বারে বারে খেতে হবে। যতবার দাস্ত বা পায়খানা হবে, প্রতিবারে এক গ্লাস করে খেতে হবে। সমস্যা বাড়লে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
৪) অত্যধিক ঘাম হলে: আমপোড়ার শরবত, পাকা বেল, পাকা আম, তরমুজ প্রভৃতির শরবত খেতে পারেন। পাকা বেলের শরবত বেশিদিন খেতে নেই।
৫) গরমে বুক ধড়ফড় করা, সঙ্গে ঘাম হলে: পাকা কাঁঠালের ৪-৫টি কোয়া ভালোভাবে এক গ্লাস জলে গুলে খেলে সঙ্গে সঙ্গে উপকার পাবেন। এভাবে পাকা সবেদার শরবতও খেতে পারেন। সুগারের রোগীদের জন্য এটি মোটেই উপাদেয় নয়।
৬) গরমে প্রস্রাব কম হলে: দিনে ৪-৫ গ্লাস আমানির (পান্তাভাত) শরবত খান। এতে সামান্য নুন মেশাতে পারেন। এছাড়া ঘোল কিংবা তরমুজের শরবত খেলে প্রস্রাব হবে।
৭) হাই প্রেশার: ওষুধ যা চলছে চলুক। গরমের দিনগুলোতে সকালে টিফিনের পর ১ চা-চামচ সাদা চন্দন ঘষা এক গ্লাস জলে মিশিয়ে শরবতের মতো খান। সুগারের সমস্যা না থাকলে সামান্য চিনি মেশাতে পারেন।
৮) শরীরের অভ্যন্তরীণ বিষ বের করতে হলে: পুদিনা পাতায় শরবত সারা বছর খান। তবে সপ্তাহে ২-৩ দিন খাবেন।
৯) জন্ডিসে: ওষুধ ও বিশ্রাম চলতে থাকবে। সঙ্গে প্রতিদিন আখের রসের শরবত খান। আখের রসে সামান্য লেবুর রস মেশালে হয়ে যায় আখের শরবত। দিনে একবার আখের গুড়ের শরবত খেলে দ্রুত আরোগ্য হবে। ১০-১৫ গ্রাম গুড় এক গ্লাস জলে গুলে সামান্য লেবুর রস মিশিয়ে খেতে হবে।
১০) সাধারণ দুর্বলতায়: পাকা পেঁপের শরবত প্রত্যহ এক গ্লাস করে ১০/১৫ দিন খেলে উপকার পাবেন। এটি না পাওয়া গেলে পাকা সবেদা, কাঁঠাল, তরমুজ প্রভৃতির যে কোনও একটির শরবত খেলেই হবে।
১১) অজীর্ণ ও দুর্বলতায়: রাতে এক গ্লাস জলে ১০/১৫ গ্রাম মেহেন্দি পাতা একটু মুচড়ে দিয়ে ভিজিয়ে রাখুন। পরদিন সকালে ছেঁকে ওই জলে মিছরি বা বাতাসা পরিমাণ মতো মিশিয়ে শরবত তৈরি করে খেতে হবে মাসখানেক।
১২) যন্ত্রণাদায়ক মেনস্ট্রুয়েশন : প্রায় অল্প বয়সি মেয়েদের এটি হয়ে থাকে। উলটকম্বল গাছের শিকড় ৮/১০ গ্রাম বেটে, তাতে কাপখানেক দুধ ও পরিমাণ মতো চিনি মিশিয়ে শরবত বানিয়ে প্রত্যহ সকালে খালি পেটে খেতে হবে। একদিন ছাড়া ছাড়া মাস দুই-তিন খেলে অসুবিধা চলে যায়। তারপর মেনস্ট্রুয়েশন শুরু হওয়ার ৮/১০ দিন আগে থেকে ওই কয়েকটা দিন একটি ছাড়া একদিন খাওয়াবেন। কয়েকটা ঋতুচক্র খেলে স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে।
পরিশেষে সতর্কতার কিছু কথা বলে রাখি। পাকা বেলের শরবত বেশি খাবেন না। মাঝে মাঝে খাবেন। বেশি খেলে পাকস্থলীতে ক্ষত হতে পারে। আনারসের শরবত গর্ভবতী মায়েরা খাবেন না। গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া যে কোনও শরবত খাওয়ার আগে একটু সতর্ক হলে ক্ষতি নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন মনে করলে নিতে পারেন। পাকা ফলের শরবত সুগার কিংবা প্রেশারের রোগীরা খেতে পারবেন কি না তা জেনে বুঝে খাবেন বা খাওয়াবেন। কোনও কোনও শরবত সারা বছর ধরেই মাঝে মাঝেই খেতে পারেন।
লেখক ভারত সরকারের আয়ুর্বেদ গবেষণা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত
চিকিৎসা বিজ্ঞানী, অধ্যাপক, বনৌষধি গবেষক, আয়ুর্বেদ চিকিৎসক।
যোগাযোগ: ৯৮৭৫৫০৫৩৩৯
related_post
অমৃত কথা
-
অবিদ্যা
- post_by বর্তমান
- জুলাই 17, 2025
এখনকার দর
-
ইউরো
- post_by Admin
- জুলাই 17, 2025
-
পাউন্ড
- post_by Admin
- জুলাই 17, 2025
-
ডলার
- post_by Admin
- জুলাই 17, 2025
-
নিফটি ব্যাঙ্ক
- post_by Admin
- জুলাই 16, 2025
-
নিফটি ৫০
- post_by Admin
- জুলাই 16, 2025
-
রুপোর দাম
- post_by Admin
- জুলাই 17, 2025
-
সোনার দাম
- post_by Admin
- জুলাই 17, 2025