শনিবার, 19 জুলাই 2025
Logo
  • শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫

অতিরিক্ত জল পান বনাম হার্ট

হার্ট ফেলিওর কী? 
 হার্ট ফেলিওর হার্টের এমন অবস্থা যেখানে হার্টের ঠিকমতো হৃদসংকোচন হয় না, অর্থাৎ হার্ট ঠিকমতো পাম্প করে বিশুদ্ধ রক্ত ধমনীর (Artery) মাধ্যমে সারা শরীরে পৌঁছে দিতে পারে না। 

অতিরিক্ত  জল পান  বনাম হার্ট

ডাঃ অঞ্জনলাল দত্ত:  হার্ট ফেলিওর কী? 
 হার্ট ফেলিওর হার্টের এমন অবস্থা যেখানে হার্টের ঠিকমতো হৃদসংকোচন হয় না, অর্থাৎ হার্ট ঠিকমতো পাম্প করে বিশুদ্ধ রক্ত ধমনীর (Artery) মাধ্যমে সারা শরীরে পৌঁছে দিতে পারে না। অর্থাৎ হার্টের সিস্টোলিক ফাংশন বা হৃদসংকোচন যদি কমে আসে তাকে আমরা চিকিৎসার পরিভাষায় হার্ট ফেলিওর বলি। এক্ষেত্রে দুটি সমস্যা দেখা দেয়, ১) পায়ের দিকে অর্থাৎ গোড়ালিতে, পায়ের গোছে জল জমা শুরু হয়, আর ২) শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, কারণ শরীরের রক্ত সংবাহিত হয়ে ফুসফুসে পৌঁছে অক্সিজেন নিয়ে শরীরের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ ব্যাহত হয়, মানে হার্টের সংকোচন পর্যাপ্ত হয় না, যাতে করে শরীরে ঠিকমতো রক্ত সঞ্চালন হতে পারে। ফলে সারা শরীরেই ফোলা ফোলা ভাব তৈরি হয়, যাকে আমরা ইডিমা বলি। সুস্থ মানুষের হার্টের সংকোচন এবং প্রসারণ খুব সুন্দরভাবে হয়, যা বোঝা যায় না, সেই কাজে ব্যাঘাত ঘটলেই হার্ট ফেলিওর শুরু হয়। 
 হার্ট ফেলিওরের সঙ্গে শরীরে জল জমার সম্পর্ক কী? 
 হার্ট ফেলিওরের সঙ্গে শরীরে জল জমে যাওয়ার নিবিড় সম্পর্ক আছে। কারও যদি হার্ট ফেলিওর হয় তাহলে শরীরের বিভিন্ন প্রান্তে জল জমা শুরু হয়, বিশেষ করে পায়ে। এক্ষেত্রে একটা বিশেষ দিক লক্ষ করা যায়, দীর্ঘক্ষণ শুয়ে থাকলে বা রাতে ঘুমনোর পর সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখা যায় পা ফোলাটা অনেক কমে যায়। কারণ সে সময়ে পা এবং সারা শরীর একই সরলরেখায় থাকে। তাই জল ধীরে ধীরে পায়ে জমতে পারে না, জল নিম্নগামী হওয়ার সুযোগ পায় না। কিন্তু সেই মানুষটা যদি সারাদিনে অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকেন বা সারাদিনে কাজের শেষে বসে বিশ্রাম করেন তখন দেখা যায় তার পায়ে ধীরে ধীরে জল জমে পা ভারী হতে শুরু করে। পায়ে এই জল জমাকে চিকিৎসার ভাষায় বলা হয় পেডাল ইডিমা (Pedal idema)। 
হার্ট ফেলিওরের রোগীদের জল কম খেতে বলার কারণ বলার আগে দুটো বিষয় আমাদের জানা দরকার। হার্ট ফেলিওরের কারণে সারা শরীরে রক্তপ্রবাহ ব্যাহত হয় দুটি কারণে— 
১) ইস্কিমিক হার্টের কারণে। এক্ষেত্রে হার্টের পাম্পিং ফাংশনটা অর্থাৎ সংকোচনের ক্ষমতা কমে গিয়ে সিস্টোলিক হার্ট ফেলিওর হয়। সেটা তখনই হয় যখন হার্টের সংকোচনের মাত্রা ৫০ শতাংশ বা তার কম হয়। সাধারণভাবে হার্টের এই পাম্পিং ক্ষমতা (Ejection fraction) ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ হয়। আর যদি হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা ৫০ শতাংশের কম হয়ে যায়, তখন হার্ট ফেলিওর শুরু হয়। হার্টের ইজেকশান ফ্রাকশান নির্ণয় করা হয় হার্টের ইকো কার্ডিওগ্রাফি (Echo Cardiography) পরীক্ষার মাধ্যমে। আর হার্ট ফেলিওর শুরু হলেই শরীরে জল জমতে শুরু করে। 
আর এক ধরনের হার্ট ফেলিওর হয়, যখন হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা হয়তো ৫০ শতাংশ বা ৬০ শতাংশের বেশি থাকে, এক্ষেত্রে হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা কমে যাওয়ার জন্য শরীরে জল জমে না, যখন হার্টে শিরার (Vein) মাধ্যমে রক্তস্রোত ফেরত আসে। তখন হার্টের মাসল বা পেশি জল ধরে রাখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, মানে হার্টের মাসলের কার্যক্ষমতা কমে যায়। হার্টের মাসলের ইলাসটিসিটি বা স্থিতিস্থাপকতা কমে যায়। একে বলে কার্ডিয়াক মায়োপ্যাথি। এর কারণেও হার্ট ফেলিওর হয়। হার্ট যখন ডায়াস্টোলিক ফাংশানের ফলে সারা শরীরে রক্ত সুষমভাবে ছড়িয়ে দিতে না পারে, তখন ডায়াস্টোলিক হার্ট ফেলিওর হয়, এটা ঘটতে পারে স্থূলত্ব বা ওবেসিটি থেকে, বয়স বেশি হলে এবং মহিলা হলে চিকিৎসকরা উপসর্গ দেখে এবং সামান্য কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করেই কারণ বুঝতে পারেন হার্ট ফেলিওরের। 
 হার্ট ফেলিওরের রোগীদের কেন কম জল খেতে বলা হয়? 
 সাধারণত সুস্থ মানুষদের ক্ষেত্রে সারা দিনে ২.৫ লিটার থেকে ৩ লিটার জল খেলেই হয়। অবশ্য এই পরিমাণ নির্ভর করে তাঁর কাজের ওপর। তিনি যদি কৃষক হন বা সারাদিন বাইরে কাজ করেন তবে তাঁকে ৩ লিটার থেকে ৪ লিটার জল খেতে হবে। আর এই জলের পরিমাণ কিন্তু সামগ্রিকভাবে সব তরলের পরিমাণ ধরে নিয়ে, যেমন চা, কফি, ডালের জল, দুধ, ফলের রস ইত্যাদি। আর এই পরিমাণটুকু নির্ভর করবে হার্টের রোগীর অবস্থা বুঝে। রোগীর যদি শরীরে ফোলা ভাব বেশি থাকে, শ্বাসকষ্ট থাকে তাহলে অনেক সময় জলের পরিমাণ ১ লিটার থেকে ১.৫ লিটারের মধ্যেও রাখা হয়। 
 এরকম সীমাবদ্ধতার মধ্যে থাকা রোগীর যদি বারে বারে জল তেষ্টা পায় সেক্ষেত্রে কী করণীয়? 
 এরকম রোগীদের ক্ষেত্রে বলা হয় তিনি এমন কোনও ভারী কাজ করবেন না, যাতে বারে বারে জল তেষ্টা পায়। কারণ জল তেষ্টা পেলে অতিরিক্ত জল খেলে, হার্টের পাম্পিংয়ের উপর চাপ পড়ে। আর হার্টের রোগীদের পাম্পিং ক্ষমতা কমে গিয়ে থাকলে হার্ট ঠিকমতো পাম্প করতে পারে না। ফলে শরীরে জল জমা শুরু হয়। আর তা না হলে বাড়ির মানুষজনকে লক্ষ রেখে জল পরিমাণ মতো নির্দিষ্ট পাত্রে রেখে দিতে হবে। 
 হার্টের রোগীকে কখন ডাই ইউরেটিক দেওয়া হয়? 
 হার্টের ইনজেকশন ফ্রাকশান যখন ৪৫ শতাংশ বা তার কম হয়, তখন শরীরে জল জমা এবং শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। হার্টের পেশির দুর্বলতার কারণে ডায়াস্টোলিক হার্ট ফেলিওর শুরু হলে যে স্টেজেই থাকুক না কেন ডাই ইউরেটিক দিতে হবে। হার্ট ফেলিওরের চিকিৎসার মূল স্তম্ভই হল ডাই ইউরেটিকের ব্যবহার। যা শরীর থেকে অতিরিক্ত জমা জল মূত্রের সঙ্গে বের করে দেয়। সেক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, ডাই ইউরেটিক দিলে শরীরের অতিরিক্ত জল বেরিয়ে গেলে রক্তের উপাদানের কিছু পরিবর্তন হয়। তাই রক্তে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নিয়মিত পরীক্ষার দরকার হয়। 
হার্ট ফেলিওরের রোগী যারা ডাই ইউরেটিক নিচ্ছেন তাঁদের ক্ষেত্রে পরীক্ষা করাটা খুবই জরুরি। ডাই ইউরেটিকের মাত্রা যদি বেশি হয়ে যায়, তাহলে শরীরে সোডিয়ামের মাত্রা কমে যাবে। শরীরে দুর্বলতা দেখা দেবে, আর ইউরিয়া ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে গিয়ে বিপদ ঘটতে পারে। তাই দীর্ঘদিন একই মাত্রার ওষুধ ব্যবহার চলবে না, চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে ওষুধের মাত্রা ঠিকঠাক রাখতে হবে। 
 জল কম খাওয়ার ফলে শরীরে সামগ্রিকভাবে ক্ষতি হয়? 
 চিকিৎসকরা জল কম খাবার কথা বলেন প্রধানত দুটি কারণে— 
১) শরীরে অতিরিক্ত জল জমবে না। 
২) জল কম খেলে হার্টের ওপর চাপটা কমবে এবং কিডনির ওপর চাপও কিছুটা কমবে। কারণ হার্টের রোগীদের ডাই ইউরেটিক খেয়ে জোর করে শরীর থেকে জল বের করে দেওয়াটা কিডনির ক্ষেত্রে খুব একটা উপকারী নয়। কারণ ডাই ইউরেটিকের বেশি পরিমাণ ব্যবহার খুব একটা ভালো নয়, তাই জলের মাত্রা যতটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় ততই ভালো। 
লেখক: পিয়ারলেস হাসপাতাল এবং বি কে রায় রিসার্চ সেন্টারের কার্ডিওলজি বিভাগের ক্লিনিকাল ডিরেক্টর কার্ডিওলজিস্ট।
সাক্ষাত্কার: সোমা সরকার

রাশিফল