ব্যবসা ও পেশায় ধনাগম ভাগ্য আজ অতি উত্তম। বেকারদের কর্ম লাভ হতে পারে। শরীর স্বাস্থ্য ... বিশদ
১৯৭৫ সালে একটি রুশ রকেটের সাহায্যে আর্যভট্ট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে ভারতের মহাকাশ যাত্রার সূচনা হয়েছিল। ২০০৮ সালের ২২ অক্টোবর ভারতের চন্দ্রযান-১-এর সাফল্যে নড়েচড়ে বসেছিল বিশ্বের তাবড় দেশগুলির মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলি। চাঁদের কক্ষপথের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে ভারতীয় চন্দ্রযান-১ তুলে এনেছিল তাক লাগানো বেশ কিছু অজানা তথ্য। সেই তথ্যে ভর করেই চাঁদের মাটিতে জলের অস্তিত্বের কথা অনুমান করেছিলেন ভারতীয় বিজ্ঞানীরা।
২০১৯-এর ২২ জুলাই ৪৮ দিনের মহাকাশ সফর শুরু করেছিল চন্দ্রযান-২। ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার কিলোমিটার পথ। হিসেবমতো সেপ্টেম্বরের শুরুতেই চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছেও গিয়েছিল। কিন্তু শেষরক্ষা আর হয়নি। পাখির পালকের মতো নামার কথা ছিল চাঁদের বুকে। তার বদলে অবতরণের সময় গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে একরাশ হতাশা নিয়ে মুখ থুবড়ে পড়তে হয়েছিল চন্দ্রযান-২-এর অরবিটের থেকে ছিটকে যাওয়া ল্যান্ডার ‘বিক্রম’কে। গবেষণার জন্যে বিক্রমের শরীরে তিনটি যন্ত্র বসানো হয়েছিল। সেগুলি চাঁদের আবহাওয়ায় তাপমাত্রা, ইলেকট্রনের পরিমাণ বা ঘনত্ব, চাঁদের মাটির তাপমাত্রা এবং চাঁদে ভূকম্পনের ধরন ও তীব্রতা পরীক্ষা করত।
অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটায় সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্র থেকে ২০২৩ সালের ১৪ জুলাই চন্দ্রযান-৩ মহাকাশযানের সফল উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। চন্দ্রযান-৩ ২০২৩ সালের ২৩ আগস্ট চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফলভাবে ‘সফট ল্যান্ডিং’-এর মাধ্যমে অবতরণ করে। এর আগে চাঁদের বুকে সফলভাবে মহাকাশযান অবতরণ করাতে পেরেছে তিনটি দেশ। তালিকায় রয়েছে রাশিয়া, আমেরিকা ও চীন। আর চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে অবতরণের দিক থেকে ভারতই হল প্রথম দেশ। এই অঞ্চলে আগে পরীক্ষানিরীক্ষা চালায়নি অন্য কোনও দেশ। চাঁদের এই অংশ অনেক বেশি রুক্ষ। এখানকার পরিবেশ মহাকাশযান অবতরণের অনুকূল নয়। রয়েছে বিশালাকার গর্ত, উঁচু পাহাড়। সূর্যের আলো পৌঁছয় না। অতিরিক্ত ঠান্ডা পরিবেশ। আর এইসব পরিস্থিতি মহাকাশযান অবতরণের প্রতিকূল। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এই মিশন ছিল অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। চন্দ্রযান-৩-এর চাঁদের ল্যান্ডার যে বিন্দুতে অবতরণ করেছিল, সেটি এখন শিবশক্তি নামে পরিচিত।
চাঁদের মাটিতে চন্দ্রযান-৩ পদার্পণ করে ইতিহাস রচনা করেছে ভারত। এক ইতিহাস রচনা হতে না হতেই পরবর্তীর জন্য কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা। এবার চন্দ্রযান-৪। চন্দ্রযান-৪ মিশন হতে চলেছে যৌথ অভিযান। ভারতের সঙ্গে এই অভিযানে হাত মেলাবে জাপান। চন্দ্রযান-৪ অভিযানের জন্য জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা জাপান এরোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সির সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো)। যৌথ উদ্যোগে ‘লুপেক্স’ (লুনার পোলার এক্সপ্লোরেশন মিশন) মহাকাশযানটিকে চাঁদে পাঠানো হবে। লুপেক্সেরই অন্য নাম চন্দ্রযান-৪। চাঁদের মাটিতে জল আছে কি? শুধুমাত্র এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই রওনা দেবে সেটি। বিগত কয়েক বছরে মহাকাশে নজরদারি চালাতে গিয়ে একাধিকবার চাঁদের বুকে জলের অস্তিত্বের ইঙ্গিত মিলেছে। ভবিষ্যৎ মহাকাশ অভিযানের কথা মাথায় রেখে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া জরুরি। কারণ জলের খোঁজ পাওয়ার অর্থ, তাকে কাজে লাগিয়ে চাঁদের বুকে স্থায়ী ঠিকানা গড়ে তোলা সম্ভব। চন্দ্রযান-৪ সেই গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়ে রওনা দেবে। এখনও পর্যন্ত যে তথ্য মিলেছে, সেই অনুযায়ী চাঁদের মেরু অঞ্চলে জলের খোঁজ চালাবে চন্দ্রযান-৪। সেই জলের সন্ধান পাওয়া গেলে, সেই জলের গুণমান কেমন, কত পরিমাণ জল রয়েছে এবং তাকে কোন কাজে লাগানো যেতে পারে, সেই নিয়ে চলবে গবেষণা।
এর আগে একাধিক দেশের মহাকাশ গবেষণায় উঠে এসেছে চাঁদ সম্পর্কিত নানা চমকপ্রদ তথ্য। চাঁদের বুকে ৬০ হাজার কোটি কিলোগ্রাম বরফ রয়েছে, যা দিয়ে বৃহদাকার ২ লক্ষ ৪০ হাজার সুইমিং পুল ভর্তি করা সম্ভব। এই অনুমান আদৌ কতটা সঠিক, তাতে সিলমোহর দেওয়ার আগে তা নিয়ে বিস্তারিত তথ্যতালাশ করবে ভারত-জাপানের যৌথ উদ্যোগে তৈরি চন্দ্রযান-৪। পৃথিবী থেকে কোনও উপায়ে চাঁদে জল সরবরাহ করা যায় কি না, করা গেলেও ভবিষ্যতের অভিযানের জন্য কত পরিমাণ জল বয়ে নিয়ে যেতে হবে, চাঁদের মাটি থেকেই বা কত জল তোলা যাবে, সেই সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ এবং হিসেব-নিকেশের কাজ করবে চন্দ্রযান-৪। চাঁদের মাটিতে জল পাওয়া গেলেই হল না, সেই জল আদৌ ব্যবহারের উপযোগী কি না, কোথা থেকে তার উৎপত্তি—এসবও খতিয়ে দেখবে চন্দ্রযান-৪। জল সংরক্ষণ, প্রাণ ধারণে তার ব্যবহার, ওই জলের চালিকাশক্তিও পরখ করে দেখা হবে। এর জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে চন্দ্রযান-৪ তৈরিতে।
চন্দ্রযান-৪ মহাকাশযানে থিন-ফিল্ম সোলার সেলস ব্যবহার করা হবে, যার মাধ্যমে আলোকশক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা রয়েছে। আলট্রা-হাই-এনার্জি-ডেনসিটি ব্যাটারি থাকবে যাতে রাতে বা অন্ধকার জায়গায় বিদ্যুৎ সংযোগে কোনও সমস্যা তৈরি হয়। চাঁদের মাটিতে দীর্ঘদিন টিকে থাকার উপযোগী করে তোলা হবে চন্দ্রযান-৪ মহাকাশযানকে।
চাঁদে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অত্যন্ত কম। তাই উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে চন্দ্রগর্ভ পর্যন্ত অন্বেষণ করে দেখবে চন্দ্রযান-৪। শুধু চাঁদই নয়, চন্দ্রযান-৪ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে মঙ্গল অভিযান আরও সহজ হবে বলেও মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ২০২৮ সালে চাঁদের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে পারে চন্দ্রযান-৪।
ইসরোর বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন ২০২৮ সালের মিশনটি বেশ কয়েকটি ধাপে পরিচালিত হবে। চন্দ্রযান-৪-কে সফলভাবে চন্দ্রপৃষ্ঠে এমন একটি স্থানে অবতরণ করা হবে, যা এখনও অনাবিষ্কৃত বলে ইসরোর তরফে করা হয়েছে দাবি। তবে, বিষয়টি বেশ চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করছেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা।
চাঁদের মাটি থেকে পাথর খুবলে আনবে চন্দ্রযান-৪। নমুনা সংগ্রহের পর চন্দ্রযানটিকে চাঁদের কক্ষপথে বেশ কয়েকদিন রাখা হবে। পরে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার জন্য চন্দ্রযানটিকে যুক্ত করা হবে একটি মডিউলারের সঙ্গে। মিশনের চূড়ান্ত ধাপ হচ্ছে নির্বিঘ্নে চন্দ্রযান-৪-কে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা। তারপরেই চাঁদের মাটি থেকে সংগ্রহ করা পাথর সহ চাঁদের মাটি ও অন্যান্য নমুনা নিয়ে চলবে গবেষণা। জানা গেছে, নমুনা সংগ্রহের জন্য চন্দ্রযান-৪-কে চাঁদের মাটিতে ১০০ দিন রাখা হবে।
তবে চন্দ্রযান-৪ অভিযান আগের সব অভিযানের থেকে একেবারে আলাদা হতে চলেছে। কারণ চাঁদের মাটি ছোঁয়া এবং সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ফিরে আসার লক্ষ্যপূরণে পৃথকভাবে দু’দফায় মহাকাশযান উৎক্ষেপণ করা হবে। এর আগে ল্যান্ডার, রোভার ও প্রপালসন মডিউল— এই তিনটি অংশকে একত্রিত করে চন্দ্রযান-৩ গড়ে তোলা হয়। আরও বাড়তি দু’টি অংশ থাকছে চন্দ্রযান-৪ অভিযানের ক্ষেত্রে। সব মিলিয়ে মোট পাঁচটি অংশ প্রপালসন মডিউল, ডিসেন্ডার মডিউল, অ্যাসেন্ডার মডিউল, ট্রান্সফার মডিউল ও রি-এন্ট্রি মডিউল।
চন্দ্রযান-৪ মিশন দু’টি ধাপে সম্পাদিত হবে। প্রথম ধাপে ভারতের সবচেয়ে ভারী রকেট, জিওসিঙ্ক্রোনাস স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল মার্ক-৩ ব্যবহার করা হবে তিনটি মহাকাশযান মডিউল চালু করতে— প্রপালশন মডিউল, ডিসেন্ডার মডিউল ও অ্যাসেন্ডার মডিউল। প্রোপালশন মডিউল অন্য দু’টি মডিউলকে চাঁদে নিয়ে যাবে এবং তাদের একটি চন্দ্র কক্ষপথে প্রবেশ করাবে। ডিসেন্ডার মডিউলটি প্রপালশন মডিউল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করবে, একটি রোবোটিক হাত এবং নমুনা সংগ্রহের জন্য একটি ড্রিল বহন করবে। অ্যাসেন্ডার মডিউলটি প্রোপালশন মডিউল থেকেও বিচ্ছিন্ন হবে এবং চন্দ্রপৃষ্ঠের ডিসেন্ডার মডিউলের সঙ্গে ডক করবে এবং নমুনাগুলিকে একটি পাত্রে স্থানান্তর করবে। অ্যাসেন্ডার মডিউলটি তখন চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে উঠবে এবং কক্ষপথে প্রপালশন মডিউলের সঙ্গে মিলিত হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ব্যবহার হবে ভারতের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য রকেট পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকেল। মহাকাশযান মডিউল চালু করতে ব্যবহার করা হবে: ট্রান্সফার মডিউল ও রি-এন্ট্রি মডিউল। ট্রান্সফার মডিউলার রি-এন্ট্রি মডিউলটিকে চাঁদে নিয়ে যাবে এবং কক্ষপথে প্রপালশন মডিউলের সঙ্গে ডক করবে। ডকিং বিশেষভাবে দু’টি পৃথক মুক্ত-উড়ন্ত মহাকাশযানের যোগদানকে বোঝায়। ট্রান্সফার মডিউল, তারপর অ্যাসেন্ডার মডিউল থেকে নমুনা ধারকটিকে রি-এন্ট্রি মডিউলে স্থানান্তর করবে। রি-এন্ট্রি মডিউলটি ট্রান্সফার মডিউল থেকে আলাদা হবে এবং নমুনা নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসবে। রি-এন্ট্রি মডিউল পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করবে এবং প্যারাসুট ব্যবহার করে নিরাপদে অবতরণ করবে।
এখনও পর্যন্ত তিনটি দেশ এই অভিযান করতে পেরেছে। আমেরিকার অ্যাপোলো অভিযানে, সোভিয়েত ইউনিয়নের লুনা অভিযানে এবং চীনের চ্যাং অভিযানের মাধ্যমে এই কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এই চ্যাং অভিযানেরই ছ’নম্বর মহাকাশযান সদ্য সফল হয়ে ফিরেছে। এরপরে ইসরোর চন্দ্রযান-৪ অভিযান সফল হলে ভারতও বড় সাফল্যের দাবিদার হবে এবং চতুর্থ দেশ হিসাবে ওই স্বীকৃতির অধিকারী হবে।