কাজকর্মে নতুন সুযোগ আসতে পারে। কর্ম সাফল্যে আনন্দ লাভ। ব্যবসায় উন্নতি। গবেষকদের পক্ষে শুভ। ... বিশদ
যেতে হবে।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘোড়ার অবদান উল্লেখযোগ্য। ঘোড়ার খুরের শব্দ সভ্যতার চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। সাম্রাজ্য বিস্তার থেকে সেনাবাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি— ঘোড়া ছিল সভ্যতার অগ্রগতির অন্যতম স্তম্ভ। মানুষের প্রয়োজনীয়তার নিত্যসঙ্গী। তার ব্যতিক্রম নয় ভারতবর্ষও। একসময়ে ভারতবর্ষে ঘোড়ার আমদানি করা হতো পারস্য থেকে। বিজয়নগর সাম্রাজ্যে ঘোড়া আসত পর্তুগাল থেকে। সুলতানি ও মুঘল আমলে সাম্রাজ্যের নীতি নির্ধারণের মূল হাতিয়ার ছিল ঘোড়া। পুরাণ, মহাকাব্য থেকে ইতিহাস, এমনকী বর্তমানেও ঘোড়ার উপস্থিতি সর্বত্র।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের পাশাপাশি বিনোদনের মাধ্যম হয়ে উঠল ঘোড়া। শুরু হল ঘোড়ার দৌড় বা হর্স রেস। যার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন রাজা মহারাজারা। ১৭৭৭ নাগাদ মাদ্রাজে প্রথম অনুষ্ঠিত হল ঘোড়ার দৌড়। ব্রিটিশদের দৌলতে এই ঘোড়ার দৌড়ের প্রতিযোগিতা সুসংবদ্ধ রূপ পায়। ক্রমে ‘হর্স রেস’ ঘিরে শুরু হল বাণিজ্যিক জুয়া। ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে শুরু করল রেস ট্র্যাক। প্রতিষ্ঠা হল ‘বোম্বাই টার্ফ ক্লাবের’।
ব্রিটিশ আধিপত্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজ সেনাদের বেস ক্যাম্পগুলোতে অবসর বিনোদনের জন্য আয়োজিত হতে শুরু করল হর্স রেস। ফলে ব্রিটিশদের দৌলতে হর্স রেস একটা অন্য মাত্রা পায়। আর ঘোড়দৌড়ের সঙ্গে জুয়া অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
কলকাতার কাছে প্রথম ঘোড়দৌড়ের আয়োজন হয় ১৭৬৯ সালের ১৬ জানুয়ারি। উদ্যোক্তা ছিল ব্রিটিশ ক্যাভারলি। প্রথমদিকে মূলত চারটি ঘোড়া নিয়ে রেস চালু হয়। ক্রমে কলকাতায় ঘোড়দৌড় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠল। কিন্তু ১৭৯৮ সালে পশুপ্রেমী গভর্নর লর্ড ওয়েলেসলি হর্স রেস বন্ধ করে দেন। যদিও ১৮০৩ সালে গড়ে ওঠে ‘বেঙ্গল জকি ক্লাব’। ১৮০৯ সালে কলকাতা ময়দানে এই ক্লাব স্থানান্তরিত হয়। এরপর ১৮২০ সালে ‘কলকাতা রেস কোর্স’ প্রতিষ্ঠিত হয়। বেঙ্গল জকি ক্লাবের সঙ্গে ইংল্যান্ডের জকি ক্লাবের এই সময় একটা যোগাযোগ তৈরি হয়। উভয়ের উদ্যোগে ১৮৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি স্থাপিত হয় ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব। যা বর্তমানে পরিচিত রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব নামে। ১৯১২ সালের ৪ জানুয়ারি রাজা পঞ্চম জর্জ ও রানি মেরি আসেন কলকাতার রেস কোর্সে। সেই থেকে ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের সঙ্গে ‘রয়্যাল’ শব্দটি যোগ করা হয়। যা বিশ্বের ঘোড়দৌড়ের ইতিহাসে হয়ে ওঠে এক সুপরিচিত নাম। ১৯৩০ সাল থেকে ক্যালকাটা ডার্বি হয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে রাজকীয় ও ধনী ডার্বি। সাধারণত ১ জানুয়ারি শীতকালীন ডার্বি হয়।
১৯৬১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতার রেসের মাঠে এলেন ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। আর সঙ্গে এলেন স্বামী প্রিন্স ফিলিপ। তারপর থেকে রানিকে সম্মান জানাতে শুরু হয় ২৮০০ মিটার দৌড়ের ‘কুইন্স কাপ’। যা শীতকালীন সব থেকে বেশি দূরত্বের দৌড়। আজও পুরনো প্রথা মেনে ব্রিটেনের রাজপরিবারের কাছ থেকে সেই কাপ আসে। রেসের ফলাফলও তাদের দপ্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
কলকাতা রেস কোর্সের সঙ্গে জড়িয়ে অনেক ইতিহাস। এসেছেন অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বও। আছে রেসের অনেক নিয়ম। রয়েছে ভাইসরয় কাপ, ভিক্টোরিয়া কাপ, এয়ার ফোর্স কাপ ইত্যাদি প্রতিযোগিতাও। এছাড়াও আছে ১১০০ মিটার, ১২০০ মিটার, ১৪০০ মিটার কিংবা ১৬০০ মিটারের দৌড়। ঘোড়া আর তার জকির উপর বাজি ধরেন রেস-প্রেমীরা।
তবে এই গল্প জর্জ উইলিয়ামস আর পার্লের। ১৯৩০ সালের মাঝামাঝি সময়ে এই টার্ফ ক্লাবের সদস্য ছিলেন পাঁচটি সাদা ঘোড়ার মালিক জর্জ উইলিয়ামস। সাহেবের সবচেয়ে প্রিয় ঘোড়া ছিল পার্ল। প্রতিটা ঘোড়দৌড় জেতার জন্য পার্ল পরিচিত ছিল ‘কুইন অব ট্র্যাকস’ নামে। ঘোড়া এবং ঘোড়ার মালিক ছিল একে অপরের পরিপূরক। তবে, বয়স বাড়ার সঙ্গে পার্লের ক্ষমতা ও শক্তি কমতে থাকে। একবার বার্ষিক কলকাতা ডার্বিতে হেরে যায় পার্ল। ফলে সেই রেসে প্রচুর টাকা খোয়াতে হয় উইলিয়ামসকে। পরের দিন টালিগঞ্জ রেললাইনের ধারে পার্লের গুলিবিদ্ধ দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। শোনা যায়, উইলিয়ামস সাহেব নাকি রাগের মাথায় তাঁর প্রিয় ঘোড়া পার্লকে খুন করেন। কিন্তু সেই ঘোড়া আজও রেস কোর্সের মায়া কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এখনও নাকি রাতের টার্ফ ক্লাবে একটা সাদা ঘোড়াকে মাঝে মধ্যে দৌড়তে দেখা যায়। হয়তো বা ‘কুইন অফ ট্র্যাকসে’র অশরীরী আত্মা এখনও সেই পরাজয় মানতে পারেনি! রেস কোর্সের মাঠে অনেকেই নাকি শনিবার রাতে চাঁদের আলোয় একটি সাদা ঘোড়াকে ঘুরতে দেখেছেন। তাঁদের দাবি, জর্জ উইলিয়ামসকেও নাকি তাঁর প্রিয় পার্লের সঙ্গে দেখা যায় এই রেস কোর্সে।
পার্ল আর উইলিয়ামসের এই অশরীরী কাণ্ডকারখানা অবশ্যই মানতে চান না যুক্তিবাদীরা। তবে, এই ঘোড়া ও ঘোড়ার মালিক আজও কলকাতার রেসের মাঠে মিথ হয়ে রয়েছে।