দুর্ঘটনা আর আঘাত যোগ আছে; সতর্ক হোন। মানসিক উত্তেজনায় লাগাম দিন, বাক বিতণ্ডা এড়িয়ে চলুন। ... বিশদ
কলেজ থেকে টর্চার সেল
![](https://bartamanpatrika.com/userfiles/1669473257_jorabagan_thana_old.jpg)
সাল ১৯৭২। তীব্র বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল নিমতলা ঘাট স্ট্রিট। ছিন্নভিন্ন কলকাতা পুলিসের এক কর্মীর দেহ। ভেঙে পড়ল জোড়াবাগান থানার একাংশ। আহত হলেন বহু পুলিস কর্মী। সেই থেকেই ধুঁকছে পেল্লাই বাড়িটি। অবশেষে ১৯৮৮ সালে থানা সরানো হল নতুন জায়গায়। কিন্তু পুরনো ভবনের কোনও পরিবর্তন হল না। আজও আবর্জনার স্তূপের উপর দাঁড়িয়ে পথচলতি মানুষকে অবাক করে ওই জীর্ণ অট্টালিকা। ৭৪, নিমতলা ঘাট স্ট্রিটের এই বাড়ির ইতিহাস কিন্তু এইটুকু নয়। স্কুল তৈরির জন্য ১৮ হাজার টাকায় জমিটি কিনেছিলেন আলেকজান্ডার ডাফ। সেখানেই তৈরি হয় ‘ডাফ কলেজ’। ২৮টি ঘর, তিনটি হল, দু’টি গ্যালারি, লাইব্রেরি এবং ল্যাবরেটরি নিয়ে ১৮৫৭ সালে বাড়িটির প্রথম আত্মপ্রকাশ। কিন্তু ১৮৬৩ সালে হঠাত্ই দেশ ছেড়ে চলে যান ডাফ সাহেব। আর ফেরেননি। কালক্রমে অন্য বাড়িতে উঠে যায় ‘ডাফ কলেজ’ বা ‘ফ্রি চার্চ ইনস্টিটিউট’। ১৯২০ সালে বাড়িটি কিনে নেয় কলকাতা পুলিস। তৈরি হয় থানা। তখন জোড়াবাগান থানার দায়িত্বে কুখ্যাত চার্লস টেগার্ট। বিপ্লবী বাঘাযতীনের হত্যাকারী বাহিনীর অন্যতম সদস্য। তাঁর নেতৃত্বে গোটা ভবনটি পরিণত হয় টর্চার সেলে। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এনে চলত অকথ্য অত্যাচার। সেসব দিন শেষে একসময় স্বাধীন হয় দেশ। কিন্তু জোড়াবাগানে অশান্তি থামেনি। শুরু হয় নকশাল আমল। ’৭২ সালে তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া দু’বাক্স পেটো ভুলবশত নিষ্ক্রিয় না করেই রেখে দেওয়া হয়েছিল মালখানায়। তা আদালতে নিয়ে যাওয়ার সময় চাপ লেগে ঘটে বিস্ফোরণ। বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাড়িটির হাড়-পাঁজর বেরিয়ে এসেছে। দেওয়ালে ঝুলছে ‘বিপজ্জনক বাড়ি’র নোটিস। ঘোরানো সিঁড়ি, কড়ি-বর্গার ছাদ, আর লম্বা খড়খড়ির জানলা দেখে গা ছমছম করে। ২০১৬ সালে বাড়িটিকে হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়। তারপরও ফেরেনি হাল। — ছবি: অতূণ বন্দ্যোপাধ্যায়
মহাভারতেও যা নেই
![](https://bartamanpatrika.com/userfiles/1669473391_mayudwaj_rajbari.jpg)
কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষী! তাম্রলিপ্ত রাজবাড়ি নিয়ে তাই আজও কৌতূহল কমেনি। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক হান্টার বলেছেন, মহাভারতীয় যুগে বিষ্ণুভক্ত রাজা ময়ূরধ্বজ এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তার সাক্ষী রাজবাড়িতে থাকা এই রাজবংশের কোর্ষিনামা। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরব পক্ষে অংশ নিয়েছিল তাম্রলিপ্তের সৈন্যবাহিনী। রাজ পরিবারের বর্তমান সদস্যদের দাবি, তাঁরা ময়ূরধ্বজের বংশের ৬৪তম প্রজন্ম। তাম্রলিপ্ত রাজবাড়ির কুলদেবতা হলেন শ্রী শ্রী রাধামাধব জীউ। মন্দিরের মধ্যে খোদাই করা আছে, তাম্রলিপ্ত ময়ূরধ্বজ রাজবংশ। মধ্যোত্তর যুগের এক অপূর্ব স্থাপত্যকলা এই রাজবাড়ি। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার (এএসআই) মতে, ইন্দো-ইসলামীয় এবং নব্য-ধ্রুপদী স্থাপত্য শিল্পের এক অপূর্ব মিশ্রণ। বর্তমানে তার পুরনো কাঠামো ধ্বংসপ্রাপ্ত। নীচে মিলেছে সুড়ঙ্গের হদিশ। বহিঃশত্রু থেকে রক্ষা পেতে এই সুড়ঙ্গ খুঁড়ে রাখা হয়েছিল বলে অনুমান ঐতিহাসিকদের। ২০০৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তাম্রলিপ্ত রাজবাড়িকে জাতীয় সৌধ হিসেবে ঘোষণা করে এএসআই। শুরু হয় রক্ষণাবেক্ষণ। বসে লোহার রেলিং। পাঁচের দশকে রাজবাড়ি ক্যাম্পাসে খোঁড়াখুঁড়ি করে অনেক পুরনো স্থাপত্য ও শিল্পকলার হদিশ পাওয়া যায়। তমলুকের বিশিষ্ট শিক্ষক তথা ইতিহাসবিদ রাজর্ষি মহাপাত্রের দাবি, সিন্ধু সভ্যতার থেকেও পুরনো হাড়গোড় এবং অন্যান্য জিনিসপত্রের সন্ধান মিলেছে। কয়েকজন বাসিন্দা সেইসব জিনিস নিয়ে পুরসভার একটি ঘর ভাড়া করে মিউজিয়াম গড়েছিলেন। পরে এএসআই সেইসব সামগ্রী নিয়ে শহরে পাঁশকুড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সাইট মিউজিয়াম বানিয়েছে। আগামী ২৫-২৭ ডিসেম্বর রাজবাড়ির চত্বরেই আয়োজন করা হয়েছে তমলুকের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বিষয়ক আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্রের। — শ্রীকান্ত পড়্যা, ছবি: চন্দ্রভানু বিজলি
অনাদরে শায়িত বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকরা
![](https://bartamanpatrika.com/userfiles/1669473578_kabar.jpg)
হলুদ রঙের তোরণ। দেওয়ালে লেখা ‘কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস’। ভিতরে এক অন্য পৃথিবী। চারদিকে জঙ্গল। মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে সারি সারি বিষণ্ণ ক্রস। বারাকপুরের এই কবরস্থানেই শায়িত প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েকজন সৈনিকের দেহ। ঢুকতেই নজরে আসে ছ’টি পিলার বিশিষ্ট এক স্থাপত্য। তার নীচে ১৮৭১ সাল থেকে শায়িত আলেকজান্ডার লান্ডাল। অদূরে কয়েকটি সাদা ফলক। নাম ও মৃত্যুদিন লেখা। জঙ্গলের একটু ভিতরে রয়েছে আরও বেশ কয়েকটি কবর। যাঁদের কবর তাঁদের বাড়ির লোক কি আসেন? উত্তর দিলেন এসকে আলম। বংশ পরম্পরায় এই কবরস্থানের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে। জানালেন, অনেকের বাড়ির লোক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চার্চে টাকা পাঠান। মাঝে মধ্যে কেউ কেউ আসেন। আসার দু’দিন আগে খবর আসে। তখন চারপাশ সাফাই হয়। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের প্রাক্তন ক্যাপ্টেন স্টিভ ওয়া এসেছিলেন একবার। তাঁর এক পূর্বপুরুষের কবর দেখতে। গাছপালায় ঢাকা পড়েছে সেই কবর-ফলক। ২০১৯ সালে হেরিটেজ তকমা পেয়েছে এই কবরস্থানটি। তবে দেখভালের ভার এখনও চার্চের হাতেই। পরিস্থিতি বদলাবেই, অপেক্ষায় আলম। — সোহম কর
যুদ্ধজয়ের স্মারক বারোদুয়ারি
![](https://bartamanpatrika.com/userfiles/1669473793_baroduari.jpg)
ইতিহাসের শহর বর্ধমান। ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র ঐতিহাসিক স্থাপত্য। অধিকাংশই সরকারি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। সেই তালিকার অন্যতম কাঞ্চননগরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা বারোদুয়ারি তোরণ। প্রাচীন এই ফটকে কান পাতলে আজও যেন শোনা যায় রাজারানিদের নানা কাহিনি। বয়স শুনে অনেকের চক্ষু চড়কগাছ হতে বাধ্য। ১৭৩৭ সালে মহারাজা কীর্তিচাঁদের আমলে এটি তৈরি হয়। তারপর বহু কিছু বদলে গিয়েছে। অবসান হয়েছে রাজ আমলের। কিন্তু বারোদুয়ারির কোনও পরিবর্তন হয়নি। ইতিহাসবিদরা বলেন, ১৭০২ খ্রিস্টাব্দের ৩ মার্চ কৃষ্ণসায়েরে স্নান করার সময় গুপ্ত ঘাতকদের হাতে খুন হয়েছিলেন তৎকালীন রাজা জগৎরাম রায়। তাঁর জেষ্ঠপুত্র কীর্তিচাঁদ। তিনি ছিলেন যোদ্ধা। অত্যন্ত সাহসী। কোনও কিছুতে পিছু হটতেন না। একটি যুদ্ধে জয়লাভের পর স্মারক হিসেবে তিনি ১০ মিটার উঁচু, সাত মিটার চওড়া এই তোরণ নির্মাণ করেন। তবে এব্যাপারে ঐতিহাসিকদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। একাংশের মতে, রাজ আমলে বর্ধমান শহর থেকে কাঞ্চননগরে প্রবেশের জন্য নির্মিত হয়েছিল এই তোরণ। আবার কেউ কেউ বলেন, কোনও এক সময় এখানে ১২টি ফটক ছিল। যুদ্ধজয়ের স্মারক হিসাবে সেগুলির নির্মাণ করেছিলেন রাজা কীর্তিচাঁদ। কালের ফেরে সেগুলি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ঝড়, দুর্যোগ উপেক্ষা করে শুধু রয়েছে গিয়েছে এই ফটকটি। তবে এই বারোদুয়ারির অভিনবত্ব তার চূড়ায়। সেটির পশ্চিম ও পূর্বদিকে পাঁচটি করে মোট ১০টি ছোট ছোট গেট রয়েছে। দক্ষিণ এবং উত্তরদিকের চূড়াতে দেখা যায় আরও দু’টি। সেই কারণেও নামকরণ হয়ে থাকতে পারে। যাই হোক, বর্ধমানবাসী আজও এই স্থাপত্য নিয়ে গর্বিত।
![](https://bartamanpatrika.com/userfiles/1669473974_baneshwar.jpg)
কোনওটির বয়স একশো বছর। কোনওটির আবার তারও বেশি। রাজার শহর কোচবিহারে হেরিটেজ বাণেশ্বর শিবমন্দিরের দক্ষিণদিকের পুকুরে (শিবদিঘি) এদের বাস। পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে ‘মোহন’ বলে ডাক দিলেই ডাঙায় চলে আসে তারা। খাবার দিলে পরম আনন্দে খেতে শুরু করে। শুধু বয়সের নিরিখে নয়, পবিত্রতার দিক থেকেও দুর্লভ ‘সফ্ট শেল’ প্রজাতির এই কচ্ছপগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তেল-সিঁদুর মাখিয়ে মোহনদের কুর্মাবতার জ্ঞানে পুজো করেন ভক্তরা। কিন্তু সেই মোহনরা আজ বিপন্ন। গত একমাসে সাতটি মোহনের মৃত্যু হয়েছে। যা নিয়ে উদ্বিগ্ন পরিবেশপ্রেমী থেকে হেরিটেজ রক্ষা কমিটির সদস্যরা। মোহনদের মৃত্যুর জন্য দেবত্র ট্রাস্ট বোর্ড ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তুলেছেন অনেকে। বছর দু’য়েক আগে বাণেশ্বর শিবমন্দির পরিদর্শনে আসেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় পর্যটনমন্ত্রী প্রহ্লাদ সিং প্যাটেল। সেসময় তিনি জানিয়েছিলেন, আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার নতুন তালিকায় যাতে ১৬০০ শতাব্দীর এই মন্দির স্থান পায়, তার চেষ্টা করবেন তিনি। মোহনদের রক্ষায় নেওয়া হবে বিশেষ উদ্যোগ। আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। কথিত আছে, অসুররাজ ‘বান’ তার ইষ্টদেবতা শিবকে পাতালপুরীতে স্থাপনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। কোচবিহার শহর থেকে ১৩ কিমি দূরে বর্তমানে যেখানে বাণেশ্বর শিবমন্দির, সেখানেই প্রতিষ্ঠা পায় তার ইষ্টদেবতা। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের সময় মন্দিরটি পূর্বদিকে সামান্য হেলে যায়। এখনও সেই অবস্থাতেই রয়েছে। ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে জানা যায়, কোচ রাজবংশের মহারাজা নর নারায়ণ বাণেশ্বর শিবমন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ১৬৬৫ সালে মহারাজা প্রাণ নারায়ণের উদ্যোগে মন্দিরটি পুনর্নিমাণ করা হয়। — ব্রতীন দাস, ছবি: অঞ্জন চক্রবর্তী