দুর্ঘটনা আর আঘাত যোগ আছে; সতর্ক হোন। মানসিক উত্তেজনায় লাগাম দিন, বাক বিতণ্ডা এড়িয়ে চলুন। ... বিশদ
২০১৮’য় তাঁকে ঘিরে স্বপ্ন দেখেছিল পর্তুগাল এবং রাশিয়া। প্রাক্তন বান্ধবী ইরিনা শায়েকের দেশ বলে রেড স্কোয়ারের পাশের একটি দোকানে রোনাল্ডোর কাট-আউট এখনও চোখে ভাসে। কিন্তু স্বপ্নপূরণ হয়নি। এবার কাতারেই সম্ভবত অধরা মাধুরী স্পর্শের শেষ সুযোগ। তার চেয়েও বড় কথা, মধ্যপ্রাচ্যে ভালো খেললে তালা পড়বে সমালোচকদের (পড়ুন, এরিক টেন হ্যাগ) মুখে।
ক্লাব ফুটবলে রোনাল্ডোর মতো অবহেলার মুখোমুখি হতে হয়নি বিশ্ব ফুটবলে তাঁর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মেসিকে। কিন্তু কাতারেই শেষবার বিশ্বকাপের মঞ্চে নামবেন বাঁপায়ের জাদুকর। ২০১৪’য় ফাইনালে জার্মানির কাছে হার এখনও ভুলতে পারেননি এলএমটেন। ভোলা সম্ভবও নয়। কেরিয়ারের সায়াহ্নে এসে মেসির মনে হয়, গঞ্জালো ইগুয়েন যদি সেদিন গোল করতে পারত। তবে বাস্তবের চিত্রনাট্যে তো রি-টেক হয় না। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যাক। কাতারের রাজধানী দোহায় পা রাখার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আলাপ সেবাস্তিয়ানের সঙ্গে। মাঝবয়সি ভদ্রলোকের ঠিকানা রোজারিও। পেশা সাংবাদিকতা। ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে বললেন, ‘আমার শহরে দুই কিংবদন্তির জন্ম। প্রথমজন চে গেভারা। আর দ্বিতীয় লিও। দু’জনের মধ্যে অসম্ভব মিল। চে’র মতো মেসিও বিপ্লবী। সবুজ ঘাসের ক্যানভাসে বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের গোলাগুলি এড়িয়ে জাল কাঁপানোয় ওর জুড়ি মেলা ভার। ব্রাজিল বিশ্বকাপে মেসি সেরা ফর্মে ছিল। ইগুয়েনের জন্য সেবার আমরা চ্যাম্পিয়ন হতে পারিনি। এবার অনেকেই বলছেন, ওর হাতে বিশ্বকাপ দেখলে খুশি হবেন। আমি একটু ঘুরিয়ে বলব, সুদৃশ্য ট্রফি ওর স্পর্শ পেলে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাবে।’ একনাগাড়ে কথা বলে কয়েক মুহূর্তের বিরতি। তারপর ঠিক চে’র মতো ঢংয়ে সিগারে লম্বা টান। আকাশের দিকে মুখ তুলে দার্শনিকের মতো ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছেড়ে ফের মেসির আলোচনায় ফিরলেন সেবাস্তিয়ান, ‘আমাদের দল খুব ভালো। কোচ স্কালোনির হাতে একাধিক বিকল্প রয়েছে। তবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য লিওই একমাত্র ভরসা।’
রাশিয়ায় দেখেছিলাম, মেসি-রোনাল্ডোর বৈরিতা। পর্তুগাল টিম হোটেলের উল্টোদিকে ঝুলছিল মেসির বিশাল কাট-আউট। বিশ্বযুদ্ধে নামার আগে তা মোটেই দেখতে চাইছিলেন না ক্রিশ্চিয়ানো। হোটেল কর্তৃপক্ষকে তাই পাঠান তড়িঘড়ি নির্দেশ, ‘ওই জানালা আগামী একমাস বন্ধ করে দাও।’ এর উল্টোটাও অবশ্য আছে। মস্কোয় গ্রুপের প্রথম ম্যাচে আইসল্যান্ডের বিরুদ্ধে ড্র করার পর আর্জেন্তিনা অধিনায়ক মেসির দিকে প্রশ্ন উড়ে এসেছিল, ‘রোনাল্ডো প্রথম ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেছেন। আর আপনি গোল পেলেন না। কীভাবে ব্যাখ্যা দেবেন?’ মেসির সংক্ষিপ্ত উত্তর, ‘যে হ্যাটট্রিক দলকে জেতাতে পারে না, তা বৃথা।’
পুতিনের দেশে বিশ্বকাপ এখন অতীত। চোখ ফেরানো যাক কাতারে। গ্রুপ পর্যায়ে পর্তুগালকে খেলতে হবে যথাক্রমে ঘানা, উরুগুয়ে ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে। তাই নক-আউটে পৌঁছনো খুব সহজ হবে না, তা জানেন ক্রিশ্চিয়ানো। কাতারে পা রেখেই তাই কোচ ও ফুটবলারদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে দিয়েছেন তিনি। অনুরাগীরাও জানেন, সাইড বেঞ্চে ফার্নান্দো স্যান্টোস থাকলেও মাঠের ভিতর রোনাল্ডোই শেষ কথা।
একই কথা প্রযোজ্য মেসি সম্পর্কে। লায়োনেল স্কালোনি জানেন, লিও স্বমহিমায় খেলতে পারলেই তাঁর স্ট্র্যাটেজি বাস্তবায়িত হবে। তাই দলের প্রাণভ্রমরাকে তিনি সবসময় প্রাধান্য দেন। এমনকী, ম্যাচের আগে টিম মিটিংয়ে মেসি বলে দেন, কার কী ভূমিকা। শুধু আর্জেন্তিনা নয়, পিএসজি’তেও শেষ কথা লিও।
এমনিতে বার্সেলোনা থেকে ফরাসি ক্লাবে গিয়ে ভালোই আছেন লিও। চাপ কম। প্লাতিনি-জিদানের দেশের ফুটবলে শক্তিশালী প্রতিপক্ষও কম। তাই বিশ্বকাপে সেরা ফর্মে পাওয়া যেতেই পারে মেসিকে। তবে এখনই অতদূর ভাবতে চান না আর্জেন্তাইন মহাতারকা। ম্যাচ বাই ম্যাচ এগিয়ে চলাই তাঁর লক্ষ্য। কারণ, ২০১৪ বিশ্বকাপ ছাড়াও কোপা আমেরিকা ফাইনালে পরপর দু’বার হারের স্বাদ চাখতে হয়েছে তাঁকে। কী করে তিনি ভুলবেন, ২০১৬’য় চিলির বিরুদ্ধে টাই-ব্রেকারে লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার মুহূর্ত। দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে তাঁর কান্নার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল। বাকিটা আপনাদের জানা। অবসাদে অবসর ঘোষণা এবং আবার ফিরে আসা। ২০২১’এ মারাকানায় ব্রাজিলকে হারিয়ে কোপা আমেরিকা জিতেও অবশ্য তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেননি এলএমটেন। কারণ, এই স্বাদে তাঁর মন ভরেনি।
সত্যিই তাই। অল্পেতে খুশি না হতে পারার জন্যই আজ মেসি এবং রোনাল্ডোর নাম এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয়। তাঁরা অবসর নিলে বিশ্ব ফুটবল রিক্ত হবে। এখন ফুটবল কোচেদের খেলা। তাই এরকম বর্ণময় চরিত্ররা বুটজোড়া তুলে রাখলে সবচেয়ে বেশি দুঃখ পাবেন ফুটবলপ্রেমীরা।